অন্ধকার গুহায় থাই কিশোরদের বেঁচে থাকার গল্প

প্রকাশ | ১১ জুলাই ২০১৮, ২০:৪৬ | আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৮, ২০:৫৩

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

থাইল্যান্ডের একটি পাহাড়ের গুহার ভেতরে ১৭ দিন ধরে আটকা পড়ে থাকার পর ১২ জন কিশোর ফুটবলার এবং তাদের কোচকে উদ্ধার করা হয়েছে। পানিতে ডুবে যাওয়া গুহার ভেতর থেকে তাদেরকে শেষ পর্যন্ত বের করে আনতে সক্ষম হয়েছেন ডুবুরিরা। খবর বিবিসির।

তাদের আটকে পড়া, বেঁচে থাকা এবং উদ্ধার করার কাহিনি সারা বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

তাদের নিখোঁজ হওয়ার নয় দিন পর তাদের সম্পর্কে প্রথম জানা গিয়েছিল। গুহার মুখে রেখে যাওয়া তাদের সাইকেলের সূত্র ধরে ব্রিটিশ ডুবুরিরা তাদের খুঁজে বের করেন। তখনই প্রথম জানা যায় যে তারা থাম লুয়াং নামের ওই গুহার আড়াই মাইলেরও বেশি গভীরে আটকা পড়ে আছে।

গুহাটির কোথাও কোথাও এমনভাবে প্লাবিত হয়ে যায় যে সে পথ দিয়ে শিশুরা বের হয়ে আসতে পারছিল না।

তাদের খোঁজ পাওয়া আগে নয় দিন ধরে এই ফুটবলারদের দলটিকে গুহার অন্ধকারের ভেতরে বেঁচে থাকতে হয়েছে। তাদের খোঁজে কীভাবে তল্লাশি চালানো হচ্ছে সেসম্পর্কে তখনও পর্যন্ত তাদের কোন ধারণা ছিল না।

কিন্তু এই এক সপ্তাহেরও বেশি সময় কীভাবে বেঁচে ছিল তারা?

বলা হচ্ছে, পাহাড়ের ভেতরে চুইয়ে পড়া ফোটা ফোটা পানি, ওয়াইল্ড বোয়ার নামক ফুটবল দলের একজন সদস্যের জন্মদিন উপলক্ষে তারা যে স্ন্যাকস বা খাবার দাবার সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন সেসব খেয়ে এবং মেডিটেশন বা ধ্যান করেই তারা এত দিন নিজেদের জীবন রক্ষা করেছেন।

স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়েছে, তাদেরই একজনের জন্মদিন উপলক্ষে সারপ্রাইজ পার্টি করার জন্যে তারা গুহার ভেতরে ঢুকেছিলেন। কিন্তু পরে প্রবল বৃষ্টির কারণে গুহার ভেতরে পানি ঢুকতে শুরু করলে তারা পালাতে পালাতে গুহার এতটা গভীরে চলে গেছেন।

২৩ জুন ছিল পীরাপাত সম্পিয়াংজাই নামে ওই ছেলেটির জন্মদিন। সেদিন তার বয়স হয়েছিল ১৭ বছর। ওই দিনেই তারা গুহার ভেতরে ঢুকেছিল। ২৩ জুন থেকেই এই বাচ্চাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।

তার জন্মদিন উপলক্ষে দলের অন্যান্য ছেলেরা খাবার কিনে নিয়ে গিয়েছিল এবং ধারণা করা হচ্ছে গুহার ভেতরে আটকা পড়ার পর এসব স্ন্যাকস খেয়েই বাচ্চারা বেঁচে ছিল।

বলা হচ্ছে, এই কিশোর ফুটবলারদের কোচ একাপল চানতাওং, বাচ্চাদের জন্যে প্রয়োজনীয় খাবার কমে যাওয়ার আশঙ্কায় গুহার ভেতরে এসব খাবার খেতে রাজি হননি।

ফলে ২ জুলাই ডুবুরিরা যখন এই ফুটবল দলটিকে গুহার ভেতরে খুঁজে পেলেন, তখন শারীরিকভাবে সবচেয়ে দুর্বল ছিলেন কোচ একাপল। তাদের সন্ধান পাওয়ার পর তাদেরকে বাইরে থেকে খাবার দেয়া শুরু হয়।

‘এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে সহজে হজম হয় এ রকম খাবার, শক্তিদায়ক খাদ্য যেগুলোতে মিনারেলও ভিটামিন মেশানো হয়েছে। চিকিৎসকদের পরামর্শেই তাদেরকে এসব খাবার দেয়া হয়’- বলেছেন উদ্ধারকারী দল থাই নেভি সিলের প্রধান অ্যাডমিরাল আরপাকর্ন ইওকোংকাওয়ে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত জন্মদিনের খাবার খেয়েই বেঁচে ছিল তারা।

কর্তৃপক্ষ এও বলেছে, গুহার দেয়াল থেকে যেসব পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়েছে সেসব পানি খেয়েছে বাচ্চারা। কারণ গুহায় প্লাবিত হয়ে যাওয়া বৃষ্টির পানি ছিল ঘোলা ও নোংরা।

এই কিশোরদের উদ্ধার করার পর চিকিৎসকরা তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে বলেছেন, তারা ভালো আছে।

‘তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো। মানসিকভাবেও তারা সুস্থ আছে’- বলেছেন থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য বিভাগের একজন পরিদর্শক থংচাই লের্তওলিরাতানাপং। তবে তিনি বলেছেন যে বেশিরভাগ শিশুরই গড়ে দুই কেজি করে ওজন কমেছে।

উষ্ণতা

সাধারণত প্লাবিত হয়ে যাওয়া কোন গুহার ভেতরে কেউ বেশি সময় ধরে আটকা পড়ে থাকলে তার হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

ব্রিটিশ কেভিং অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রধান অ্যান্ডি এভিস বিবিসিকে বলেছেন, ‘বিশ্বের ওই এলাকায় গুহার ভেতরে বাতাসের তাপমাত্রা বেশিই হয়ে থাকে।’

তারপরেও ওই কিশোররা সতর্কতা হিসেবে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিল।

থাই কর্মকর্তারা বিবিসিকে বলেছেন, ‘নিজেদের উষ্ণ রাখার জন্যে তারা গুহার ভেতরে পাঁচ মিটার গভীর একটি গর্ত খুঁড়েছিল। পাথর দিয়ে এই সুড়ঙ্গটা তৈরি করেছিল তারা। নিজেদের উষ্ণ রাখতে তারা ওই সুড়ঙ্গের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিল।’

উদ্ধারের পর বুধবার হাসপাতাল থেকে তাদের প্রথম ছবি প্রকাশিত হয়

বাতাস

শিশুরা যখন গুহার ভেতরে আটকা পড়ে তখন বাতাস প্রাথমিকভাবে দুশ্চিন্তার কোন কারণ ছিল না।

‘বেশিরভাগ গুহাই প্রাকৃতিকভাবে নিশ্বাস নিতে পারে’- বলেন যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় গুহা উদ্ধার কমিশনের সমন্বয়কারী আনমার মির্জা।

‘গুহার ভেতরেও বাতাস ঢুকতে ও বের হতে পারে। গুহার যেসব জায়গায় লোকজন যেতে পারে না সেখানে কিন্তু বাতাস প্রবাহিত হয়।’

কিন্তু তারপরেও যত দিন গড়িয়েছে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা ততটাই কমে গেছে। বলা হচ্ছে, শিশুরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল সেখানে অক্সিজেনের স্বাভাবিক মাত্রা হওয়ার কথা ছিল ২১ শতাংশ। কিন্তু সেটা নেমে গিয়েছিল ১৫ শতাংশে।

পরে বাচ্চাদের কাছে অক্সিজেন পৌঁছে দিয়েছিল ডুবুরিরা। থাই নেভির সাবেক একজন ডুবুরি গুহার গভীরে অক্সিজেনের বোতল সরবরাহ করে ফেরার পথে নিজেই অক্সিজেনের অভাবে মারা যান।

মানসিক অবস্থা

আরেকটি বড় দুশ্চিন্তা ছিল শিশুদের মানসিক অবস্থা। কারণ তাদেরকে থাকতে হয়েছে গাঢ় অন্ধকারের ভেতের, দিনের পর দিন। সূর্যের আলো বহুদিন তাদের কাছে পৌঁছায়নি। সময় সম্পর্কেও তাদের কোন ধারণা ছিল না যে কখন রাত আর কখন দিন হচ্ছে। এমনকি তাদের খোঁজে বাইরে যে বড় ধরনের তল্লাশি চলছিল সেসম্পর্কেও তাদের কোন ধারণা ছিল না।

তবে কর্মকর্তারা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে শিশুদের শান্ত রাখতে একটা বড় ভূমিকা ছিল তাদের কোচের।

মানসিক চাপ মোকাবেলায় তিনি তাদেরকে মেডিটেশন করিয়েছেন গুহার ভেতরে। ফুটবল কোচ হওয়ার আগে তিনি ছিলেন একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু।

কর্মকর্তারা বলছেন, একই সঙ্গে গুহার বাতাস যাতে বেশি ব্যবহার করা না হয়ে যায় সে বিষয়েও সচেতন ছিলেন তিনি।

পরে যখন উদ্ধাকারীরা বাচ্চাদের কাছে গিয়ে পৌঁছায় তখন তারা তাদের পরিবারের জন্যে লিখে পাঠায় চিঠি।

এ রকম এক চিঠিতে কোচ শিশুদের পিতামাতার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তাদেরকে গুহার ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু অভিভাবকরা পাল্টা জবাবে বলেছেন যে এ জন্য তারা কোচকে দায়ী করেন না।

তবে গুহার ভেতর থেকে লেখা চিঠিতে কোচ লিখেছিলেন, ‘আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, শিশুদের রক্ষা করতে আমার পক্ষে যতটা করা সম্ভব আমি তার পুরোটাই করব।’

(ঢাকাটাইমস/১১জুলাই/এসআই)