রাষ্ট্র কি জাওয়াদদের মেধার মূল্য দিতে পারবে?

প্রকাশ | ১৩ জুলাই ২০১৮, ১১:৩৯

শেখ আদনান ফাহাদ

জাওয়াদ বিশ্ব গণিত অলিম্পিয়াডে স্বর্ণপদক জয় করেছে। জাওয়াদ আমাদের ছেলে। আমার মত অংকে দুর্বল মানুষ জাওয়াদের মেধার মূল্যায়ন করতে পারব না। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র কি ফাইনালি জাওয়াদকে তার মেধার সঠিক মূল্য দিতে পারবে ?

ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে দেখি, জাওয়াদ বুয়েটে পড়া শেষে ইউরোপ অথবা আমেরিকায় চলে গেছে। ভবিষ্যৎ কল্পনা করে দেখি, জাওয়াদ এদেশে ডাক্তার হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্র থেকে কেবল বেতন আর ভাতা পাচ্ছে, কোনো প্রমোশন নেই, নেই কাজের কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। জাওয়াদের ক্লাসের মাঝারি মানের ছাত্রটি স্বাস্থ্য সচিব হয়ে জাওয়াদের মত বহু টপ মেধাবীর ‘স্যার’ হয়ে গেছে। জাওয়াদের ক্লাসের একদম পেছনের দিকের ছাত্ররা রাজনীতিবিদ হয়ে সচিবেরও বস মন্ত্রী হয়ে গেছেন। এই হল বাংলাদেশ। জাওয়াদদের আমরা ধরে রাখতে পারব না। বর্তমান বৈষম্যমূলক আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা সম্ভব না।

মারগারেটা মামুন এর কথা মনে আছে? বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাশিয়ান একটি মেয়ে যে কি না অলিম্পিকে গোল্ড মেডেল জিতেছিল। যে বয়সে মেয়েটি বিশ্বখ্যাত জিমন্যাস্ট, বাংলাদেশে এ বয়সের ছেলে-মেয়েরা ঢাকায় ফার্মগেটে কোচিং শেষে বাস ধরার ইঁদুর দৌড়ে শামিল হয়। এ প্লাস পেতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে।

এ প্লাস পেতে গিয়ে ছেলে-মেয়েরা এমনকি হয়ত নিজেদের সবচেয়ে বড় প্রতিভাও বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছে। কেউ হয়ত ভালো গায়ক হতে পারত, কেউ হতে পারত ভালো ক্রিকেটার, কেউ বা ভালো ফুটবলার, কেউ বা হয়ত জগৎবিখ্যাত গল্পকার।

কিন্তু সব কিছু বাদ দিয়ে ছেলে-মেয়েরা শুধু এ প্লাস পাওয়ার জন্য সমস্ত প্রতিভা কোরবানি  করে। সবচেয়ে মেধাবী ছেলে-মেয়েগুলোকে এরপরেও রেহাই দেয় না এদেশের সিস্টেম। সবচেয়ে মেধাবীরা ভর্তি হয় বুয়েট, মেডিক্যালে। বুয়েট/ডুয়েট জাতীয় প্রতিষ্ঠান কিংবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বিভাগে যারা পড়তে আসে, এরা পড়াশুনাকালীনই জানে যে, এদেশে সম্মান আর সুযোগ-সুবিধা পেতে হলে শুধু ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ হতে হবে।

কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ে একটি ছেলে বা মেয়ে কেন পুলিশ হতে যাবে, আপনারাই বলুন। সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে যদি এক্সপার্ট লাগে তাহলে তাঁদেরকে এক্সপার্ট হিসেবেই নিয়োগ দেয়া হোক। এতদিন ডাক্তারি পড়ে একজন মানুষ কেন ম্যাজিস্ট্রেট হতে যাবেন কিংবা কেন ফরেন ক্যাডারে যাবেন? তার তো ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা দিয়ে সমাজে সম্মান নিয়ে চলার কথা।

ডাক্তার যদি ডাক্তার না হয়ে অন্য কিছু হয় তাহলে ডাক্তারের কাজ কে করবে? সবচেয়ে মেধাবীরা যখন ডাক্তার হতে চাইবে না, তখন এদেশের স্বাস্থ্য সেবার কী অবস্থা হবে? পুলিশ কি অসুস্থ হয়ে পুলিশের কাছে যায়, নাকি ভালো ডাক্তারের খোঁজ করে?

স্বাস্থ্যহীন পুলিশ দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব?  একজন টিএনও সাহেব যখন অসুস্থ হন, তখন তিনি তার ডিসি স্যারের কাছে যান না চিকিৎসার জন্য, ডাক্তারের কাছেই যান। তবে কেন ডাক্তার তার মতই সমান সম্মান ও সুবিধা  পাবে না?   

জাওয়াদ কি ডাক্তার হবে? ডাক্তার হয়ে সরকারি হাসপাতালে মধ্যরাত অবধি ডিউটি করে রিকশায় করে বাসায় ফিরতে হবে জাওয়াদের। কারণ রাষ্ট্র সরকারি ডাক্তারদের জন্য বেতন-ভাতার বাইরে কোনো সুযোগ-সুবিধা রাখেনি।

জাওয়াদের সাথের ছেলে বা মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হয়ে যাবে, বিসিএসে জয়েন করা ছেলেটি প্রতাপশালী সচিব হয়ে যাবে। জাওয়াদ ডাক্তার হয়ে কলুর বলদের মত খেটে সহকারী অধ্যাপকও হতে পারবে না। প্রশাসন ক্যাডারের এক কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন, সরকারি ডাক্তারদের নাকি প্রমোশনের দরকার নেই! কারণ এরা অনেক টাকা কামাই করে!!  

জাওয়াদ কি ইঞ্জিনিয়ার হবে? যদি সে হয় সরকারি প্রকৌশলী, তাহলে ঠিকাদার আর রাজনীতিবিদদের পালা মাস্তানদের নির্দেশনা অনুযায়ী না চললে, কপালে জুটবে লাথি-ঘুষি। তবে নীতি, নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে দুষ্ট চক্রের সাথে মিশে গেলে অনেক অর্থ-বিত্তের মালিক হবে সে। কিন্তু ঘুষ-দুর্নীতির টাকায় প্রকৃত মেধাবীরা বাঁচতে চায় না। প্রকৃত মেধার সাথে দুর্নীতির আজীবনের বিরোধ। উদ্যোক্তা হবে সে? হ্যাঁ, উদ্যোক্তা হতে পারে। উদ্যোক্তা কী, কিভাবে মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা যায়, এমন কোনো কিছু কি স্কুল সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত আছে।

সমাজ বা রাষ্ট্র কি উদ্যোক্তাদের সম্মান দেয়? উদ্যোক্তাদের কি ছেলে-মেয়েদের সামনে আইডল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়?

মেধাবীদের বিরাট একটা অংশ প্রতিবছর চলে যাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মত উন্নত বিশ্বে। ইউরোপ আমেরিকায় বাংলাদেশি মেধাবীদের সবাই যে নিজের পড়াশুনা অনুযায়ী প্রপার জব করছে, তা নয়। অনেকে বড় বড় কোম্পানিতে চাকরি করেন, অনেকে আবার ট্যাক্সি চালায়, অনেককে তো আমি জানি বড় প্রতিষ্ঠানের দারোয়ানের চাকরিও করে। অন্যান্য  নিম্ন মানের চাকরি  তো আছেই। কেন এদেশের টপ মেধাবীরা বিদেশে গিয়ে ট্যাক্সি চালিয়ে হলেও সেখানে থাকতে চায়? কেউ কি কোনদিন ভেবে দেখেছেন?

কেন এমন ঘটছে বাংলাদেশে? মেধাবীরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে কেন কিংবা যার হওয়ার কথা ডাক্তার বা স্থপতি, সেও কেন শুধু ম্যাজিস্ট্রেট-পুলিশ হতে চাচ্ছে? একবার কি আমাদের নীতি নির্ধারকরা ভেবে দেখেছেন?

রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা হাতে গোনা কয়েকটি ক্যাডারের মানুষের জন্য রেখে দিলে, উৎপাদনক্ষম আসল মেধাবীরা এদেশে থাকবে না। নীতি-নির্ধারকদের অবশ্য এত কিছু ভাবার সময় কই? কারণ এদেশের মন্ত্রী-এমপি-সচিবদের ছেলে-মেয়েদের প্রায় সবাই বিদেশে পড়ে। সম্পদশালীদের সম্পদ বিদেশে পাচার তো চলছেই। কালো/সাদা টাকার বড় একটা অংশ বাইরে চলে যাচ্ছে। হিন্দুদের বড় একটা অংশ ভারতে সম্পদ পাচার করে, আর মুসলমানরা পাচার করে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায়।

বাংলাদেশের কয়েকজন মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা সুইস ব্যাংকে পাচার করা হয়েছে। এমন একটা রাষ্ট্র কীভাবে টিকে আছে তাহলে? অমিত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। এত দুর্নীতি, লুটপাট, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে উৎসারিত বৈষম্য ইত্যাদি নানা বাধা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ টিকে আছে। শুধু টিকে নাই, ভালো করছে বাংলাদেশ।অথচ আরও অনেক ভালো করতে পারত বাংলাদেশ।

একসময় ক্রোয়েশিয়া আর বাংলাদেশ প্রায় একই র‍্যাংকিং এ ছিল! বিশ্বাস হয় না? ১৯৯৩ সালের ফুটবল র‍্যাংকিং দেখুন। কিংবা ধরুন পানামার কথা। পানামা নাকি আমাদেরও নিচে ছিল!! ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের র‍্যাংকিং ছিল ১১৯, ক্রোয়েশিয়ার ছিল ১১৬ আর পানামার ছিল ১২৬! এই র‍্যাংকিং কি সত্যিই এমন ছিল? অথচ এখন বাংলাদেশ কোথায় আর ক্রোয়েশিয়া কোথায়? রাষ্ট্র যখন নিজেই শুধু এ প্লাসের পেছনে দৌড়াবে, সমাজে যখন শুধু রাজনীতিবিদ আর পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্ষমতা-সম্মান থাকবে, তখন এমনই হবে আমাদের বাস্তবতা। ১৬ কোটি মানুষ নিয়ে আজ বাংলাদেশ ভুটানের সাথেও জিততে পারার নিশ্চয়তা দিতে পারে না, অথচ মাত্র ৩ লাখ মানুষ নিয়ে আইসল্যান্ড ফুটবল বিশ্বকাপে খেলে। হয়ত আমাদের প্রবাসীদের ছেলে-মেয়েরা ফুটবল বিশ্বকাপ ঠিকই খেলবে, কিন্তু আমাদের দেশের হয়ে নয়, তাঁদের বিদেশী দেশের হয়ে।

আমি কি সবাইকে হতাশ করে দিলাম। আমার উদ্দেশ্য হতাশ করা নয়, বরং সবাইকে নিজ নিজ শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বাংলাদেশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার লড়াইয়ে আরও বেগবান হওয়ার তাগিদ তৈরির তাগিদ থেকেই এই লেখা। আমাদের গ্রামের গরিব ঘরের, এ প্লাস না পাওয়া মেয়েগুলোর দিকে একটু তাকান তো। ফুটবল এবং ক্রিকেট উভয় খেলাতেই মেয়েরা খুব ভালো করছে। অস্ট্রেলিয়ার মেয়েদের, ইরান, জর্ডান, ভারতের মেয়েদেরকে বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটবলে নিয়মিত পরাজিত করছে।

এশিয়ান ক্রিকেটে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন এখন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মেয়েরা ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। ছেলেদের ক্রিকেটে পারফর্মেন্স ইদানিং একটু খারাপ হলেও এটা সাময়িক।

অর্থনীতিতে এখন বাংলাদেশ রীতিমত বিশ্বের বিস্ময়। অর্থনীতিতে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশী সেই কৃষক আর শ্রমিকদেরকে আমাদের রাষ্ট্র কী হালতে রেখেছে? তাও গরিবের  কপাল ভালো যে, ক্ষমতায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আছেন। একজন নির্লোভ, মানবতাবাদী রাজনীতিবিদ হিসেবে শেখ হাসিনা দেশবাসী ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন করেছেন।

কিন্তু একা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে আর কত দেয়া সম্ভব? সবারই দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি দায়িত্ব আছে। সে দায়িত্ব পালন না করলে, শুধু নিজেদের আখের গোছালে দেশে তো নয়ই, বিদেশে গিয়েও কেউ শান্তিতে বাঁচতে বা মরতে পারবেন না।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়