নির্বাচনী বছরে কেন এত আন্দোলন?

প্রকাশ | ১৫ জুলাই ২০১৮, ১৭:৪৬ | আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৮, ১০:৫৫

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
ফাইল ছবি

২০১৮ সাল নির্বাচনের বছর। এ বছরের শেষেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিভিন্ন দলের মনোনয়ন-প্রত্যাশীরা নির্বাচনী এলাকায় সময় দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষও তাকিয়ে আছে নির্বাচনের দিকে। কিন্তু নির্বাচনী বছর ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে আন্দোলনের বছরে। বিগত বছরগুলোতে বিচ্ছিন্ন কিছু আন্দোলন হলেও এ বছর একের পর এক ইস্যু নিয়ে সক্রিয় হচ্ছে আন্দোলনকারীরা।

সাদা চোখে এসব আন্দোলনের মূল দাবির বাইরে অন্য কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে একটু সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, সবকিছুর পেছনেই অন্য কোনো কারণ আছে। এই কারণ হতে পারে রাজনৈতিক। নির্বাচনী বছরে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার কৌশল বলা চলে। অতীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ ধরনের অনেক অরাজনৈতিক আন্দোলন কৌশলে রাজনৈতিক সুবিধা এনে দিয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূরণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে।

এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন। কাক্সিক্ষত-অনাকাক্সিক্ষত অনেক ঘটন-অঘটনে চলমান এই আন্দোলন থেমে যায়নি। চলছে। আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। ছাত্রদের মধ্যেই এ আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে দুটো দল তৈরি হয়েছে। একটি পক্ষ চাইছে আন্দোলন এগিয়ে নিতে। অপর পক্ষ চড়াও হচ্ছে আন্দোলনকারীদের ওপর। সংঘর্ষ হয়েছে। হাতুড়ি পেটা করে পা ভাঙা হয়েছে। ছাত্ররাই ছাত্রদের ওপর হামলা করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিষয়টি নিয়ে সংসদে একাধিকবার বক্তৃতা দিয়েছেন। সবশেষে গত ১২ জুলাই জাতীয় সংসদে তিনি বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় আছে। রায়ে বলা আছে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সংরক্ষিত থাকবে। তাহলে কোটার বিষয়ে আমরা কীভাবে আদালতের এই রায় লঙ্ঘন করব? সেটা তো আমরা করতে পারছি না। এটা করলে তো আমরা আদালত অবমাননায় পড়ে যাব। এটা কেউ করতে পারবে না।’

কোটাবিরোধী এই আন্দোলনের ঘটন-অঘটন নিয়ে তোলপাড় চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। পক্ষে-বিপক্ষে বাকবিতণ্ডা হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে। সমালোচনা হচ্ছে। কেউ কোটা রাখার পক্ষে মত দিচ্ছেন। কারণ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সম্মান জানাতে কোটা পদ্ধতি রাখার ব্যাপারে মত দিচ্ছে কেউ। আবার অনেকে বলছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানাতে বাধা নেই, তবে তাদের সন্তান, সন্তানের সন্তান বা তার সন্তানদের এই কোটা সুবিধা দিতে গেলে দিনের পর পর মেধাবীরা বঞ্চিত হবে। তাই কোটা সুবিধা মুক্তিযোদ্ধাদের পর্যন্ত রাখার প্রস্তাবও এসেছে। সরকারি দল মনে করছে, এই আন্দোলন কেবল কোটাবিরোধী আন্দোলন নয়, সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপকৌশল। কারণ নির্বাচনী বছরে সরকারকে বিব্রত করতেই এটা করা হচ্ছে।

সরকারি দলের অভিযোগের বাইরেও এই আন্দোলনের সামগ্রিক বিষয়ের দিকে তাকালে রাজনৈতিক বিষয়টি আড়াল হবে না। কোটাবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর ছাত্রদের হামলার প্রতিবাদ করেছে বিএনপি। এর দায়ও তারা সরকারের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছে। অভিযোগ করেছে। তারা কোটাবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে। দলটি বলছে, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের চলমান আন্দোলন যৌক্তিক। আগামীতে ক্ষমতায় গেলে মুক্তিযোদ্ধা, নারী ও প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর কোটা ব্যতিরেকে বাকি কোটা বাতিল করবে। কোটা পদ্ধতি তো সম্প্রতি করা হয়নি। যুগের পর যুগ এটা চলছে। বিএনপি একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে। সরকার গঠন করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে কি কোটা পদ্ধতি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নিয়েছিল? তারা কি তখন কোটাকে যৌক্তিক মনে করেছিল? তাহলে ধরে নেওয়া যায়, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিএনপি এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক আবরণ দেওয়ার চেষ্টা করছে। এটাও মনে করা অমূলক হবে না যে, শুরু থেকেই আন্দোলনের পেছনে বিএনপি বা সমমনাদের ইন্ধন ছিল।

দুই.
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির জন্য দাবি নতুন কিছু নয়। বছরের কোনো না কোনো সময় এই আন্দোলন সামনে আসে। বিশেষ করে বাজেট ঘোষণার আগে এবং পরে এ নিয়ে আন্দোলন হয়। তবে এবার আন্দোলন ছিল ব্যতিক্রম। দফায় দফায় আন্দোলন করেছে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশন। জাতীয় প্রেসক্লাবের বিপরীত পাশের রাস্তায় দিনরাত এক করেছেন জ্ঞানের আলো ছড়ানোর মহান দায়িত্ব নেওয়া এসব মানুষ। তারা হয়তো ভেবেছেন নির্বাচনী বছরে সরকারের কাছ থেকে কিছু আদায় করার একমাত্র কার্যকর কৌশল আন্দোলন। আসলেই কি তাই? নাকি এর পেছনেও রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য আছে? বিগত পাঁচ বছরে তো এত কঠিন আন্দোলনে শিক্ষকদের দেখা যায়নি। জাতীয় নির্বাচনের দিন গণনা যখন শুরু হয়েছে, তখন এই আন্দোলন কতটা কার্যকর হবে? নির্বাচনী এই বছরে এমপিওভুক্তিকরণের জন্য সরকারের কাছে কি পর্যাপ্ত সময় থাকবে?

সারা দেশে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কম নয়। বরং এমপিওভুক্তির চেয়ে সংখ্যায় কয়েক গুণ বেশি। আন্দোলনের নামে দিনের পর দিন বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ বা আংশিক বন্ধ বা বিঘিœত হলে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? এতে কি সরকার বা সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে? সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে এ ধরনের আন্দোলন কি সমর্থনযোগ্য?

সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, এই আন্দোলনকারীদের একটি বড় অংশ রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলের সমর্থন আছে তাদের প্রতি। এই আন্দোলনের পেছনেও আছে নির্বাচন। এই আন্দোলনকে পুঁজি করে একটি পক্ষ রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে না- তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। বরং বাংলাদেশের রাজনীতির অতীত ঘাঁটলে এর নজির পাওয়া যাবে।

নির্বাচনী বছরে আন্দোলন-সংগ্রাম যেকোনো সরকারের জন্য বিব্রতকর। সরকারকে বাড়তি মনোযোগ দিতে হয় এসব আন্দোলন দমনে। সরকার আন্দোলনকারীদের ওপর রূঢ় হবে নাকি নমনীয় আচরণ করবেÑ এ বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ সরকারের আচরণের ওপর পরবর্তী ভোটের রাজনীতিতে সমর্থনের বিষয়টি নির্ভর করে। তবে এসব ক্ষেত্রে কৌশলী আচরণের কথা বলেন রাজনীতি বোদ্ধারা।

তিন.
নির্বাচনী বছরে আন্দোলনের হিড়িককে কখনোই সাদা চোখে দেখার সুযোগ নেই। এর পেছনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে এসব আন্দোলনকে কৌশলে মোকাবেলা করাই শ্রেয় হবে। কারণ বিরোধীদলগুলো যখন রাজপথে আন্দোলন জমাতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন এসব আন্দোলনকে তারা পুঁজি করছে। এসব আন্দোলনে সরকারবিরোধী চেতনা ছড়িয়ে দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা হচ্ছে, যা শুধু সরকার নয় দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্যই হুমকিস্বরূপ। সরকারকে বিপদে ফেললে আদতে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চা বিপদগ্রস্ত হবে। বিরোধী দলগুলোর কখনোই উচিত হবে না, ক্ষমতার লোভে এ ধরনের পথ অনুসরণ করা। বরং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ করা প্রতিটি রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। জনগণ যেন তাদের ভোটাধিকার সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করতে পারে, সেই নিশ্চয়তার দায়িত্ব সবাইকে নিতে হবে।

আন্দোলনকারীদের মৌলিক দাবির বিষয়েও সরকারকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। কোনোভাবে এসব পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে যৌক্তিক ও ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করতে হবে। কোনো পক্ষকেই হতাশ বা নিরাশ করা যাবে না। কারণ কোনো দাবিই অমূলক নয়। পাশাপাশি কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর হামলাকারীদের বিচার করতে হবে। সহিংসতা নয়, আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব।

(ঢাকাটাইমস/১৫জুলাই/এইচএফ/মোআ