তিন সিটি নির্বাচন: রাজনৈতিক সমীকরণ

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ১৭ জুলাই ২০১৮, ০৯:৪৪

খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচন খুব সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ পরিবেশে হয়েছেÑ এমন কথা হয়তো বলা যাবে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তার শরিক রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্য বলবে ভিন্ন কথা। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলেই দাবি করবে তারা। বিপরীত দিকে বিএনপি এবং তার রাজনৈতিক শরিকরা সরাসরি এ নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

সরকারি কিংবা বিরোধীদল, উভয়ের বক্তব্যেই হয়তো অনেকটা রাজনীতি আছে। কথা বলার সময় প্রকৃত বাস্তবতার চেয়ে তারা তাদের রাজনৈতিক লাভক্ষতির কথা বেশি মাথায় রাখতে পারে। বাংলাদেশে এরকম হয়ে থাকে। তারা কেবলই নিজেদের দলের কথা বলে। তাই বরং তাকানো যাক বিভিন্ন বেসরকারি পর্যবেক্ষক এবং মিডিয়াগুলোর দিকে। এদের কাছ থেকে খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা নিয়ে প্রীত হওয়ার সুযোগ কম।

বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এই দুটি নির্বাচনকে ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন’ বলে অভিহিত করেছে। গাজীপুরের জন্য তারা একটা হিসাব দিয়েছে। বলেছে, সেখানে ৪২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০১টি কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট হয়েছে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় প্রধান প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করা, বিএনপি প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি, নির্বাচনের দিন জোরজবরদস্তি করার ঘটনা ঘটেছে।

আর একটি বেসরকারি সংস্থা, ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডাব্লিউজি), এর পর্যবেক্ষণেও গাজীপুরের নির্বাচনকে একটি ভালো নির্বাচন হিসাবে বিবেচনার সুযোগ থাকছে না। তাদের মতে, ‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাড়ে ৪৬ শতাংশ কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে।’ তার মানে প্রায় অর্ধেক কেন্দ্রে অনিয়ম! এটা তো ভালো কথা নয়। অনিয়ম বলতে তারা বুঝিয়েছেÑ ‘জোর করে ব্যালটে সিল মারা, ভোটের সংখ্যা বাড়িয়ে লেখা, কেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে প্রচার চালানো ও ভোটকেন্দ্রের ভেতর অননুমোদিত ব্যক্তিদের অবস্থান।’ এই সংস্থাটি এমনও বলেছে যে, রংপুর সিটি নির্বাচনে তারা কোনো অনিয়ম পায়নি। কিন্তু গাজীপুরে পেয়েছে। তারা রংপুর, কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জের মতো নির্বাচন দেখতে চায়। খুলনা বা গাজীপুরের মতো নির্বাচন প্রত্যাশা করে না।

এগুলো বেসরকারি সংস্থা। দেশীয় সংস্থা। তাই এদের মতামতকে সরকার হয়তো তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। কিন্তু সরকারকে সামান্য হলেও নড়েচড়ে বসতে দেখা গেল, যখন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের কণ্ঠে গাজীপুর নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা উচ্চারিত হলো।

গাজীপুর নির্বাচনের পর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেন, খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনিয়ম-জালিয়াতি এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের গ্রেপ্তার-হয়রানির খবরে তার দেশ উদ্বিগ্ন। তার এমন বক্তব্যের পরই দেখা গেল সরকারের এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ব্যক্তির কণ্ঠে নানামুখী প্রতিক্রিয়া।

খুলনা বা গাজীপুর কোনো দূরবর্তী এলাকা নয়। এই দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় অনেকেরই যাওয়া-আসা আছে, অনেকের আত্মীয়স্বজনও এ এলাকায় বসবাস করেন। তাই প্রকৃত তথ্য পাওয়ার জন্য তাদেরকে যেমন আওয়ামী লীগ বা বিএনপির দ্বারস্থ হতে হয় না, তেমনি বিদেশি রাষ্ট্রদূতের উপরও নির্ভর করতে হয় না। তারা মিলিয়ে নিতে জানে।

বাংলাদেশের নির্বাচনকে সংজ্ঞায়িত করতে এখন বেশ কিছু উদাহরণ দেখা যায়। ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন, মাগুরা স্টাইলের নির্বাচন, ২২ জানুয়ারি নির্বাচন প্রচেষ্টা, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনÑ এগুলো এক একটি যেন মাইলস্টোনে পরিণত হয়েছে। কেবল এই নামটুকু উল্লেখ করলেই হয়ে যায়, ডিটেইলে আর যেতে হয় না। এসবের বিপরীতে পজেটিভ কিছু উদাহরণও আছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন, কুমিল্লা সিটি নির্বাচন, রংপুর সিটি নির্বাচন ইত্যাদি। জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কিছু ইতিবাচক উদাহরণ আছেÑ ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এগুলো আমাদের নির্বাচনের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। সদ্য হয়ে যাওয়া খুলনা এবং গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে যে গর্ব করার ন্যূনতম সুযোগও থাকবে না, সেটা এরই মধ্যে টের পাওয়া যাচ্ছে।

এরকম বাস্তবতার মধ্যেই এখন আবার সামনে আমাদের তিন তিনটি সিটি নির্বাচন। রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট। এই তিনটি নির্বাচনেই এর আগে বিএনপি প্রার্থীরা মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাজশাহী ও সিলেটে আগের বারের প্রার্থীরাই আবার দাঁড়িয়েছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থী সেবার যারা ছিলেন এবার তারাই আছেন। আর বরিশালে দু’দলেরই প্রার্থী পরিবর্তন হয়েছে। আগের বার, ২০১৩ সালে এই তিন সিটি করপোরেশনেই হেরেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। তখন অবশ্য খুলনা ও গাজীপুরেও বিএনপি প্রার্থীদের কাছে হেরেছিল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। পাঁচ বছর পর এবার দেখা গেল খুলনা ও গাজীপুরের ফলাফল একেবারে উল্টে গেছে। তবে একথাও সত্য যে, সেবার নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অনাকাক্সিক্ষত কোনো বিতর্ক দেখা যায়নি। কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা কিংবা বিদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তা বলেননি যে, নির্বাচনে কোনো অনিয়ম হয়েছে। এবার যখন ফলাফল উল্টে গেল, ওই ব্যক্তিদের মন্তব্যও যেন উল্টে গেল।

এই যে উল্টোরথের যাত্রা, সে কারণেই কি আসন্ন তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে এত আলোচনা? হতে পারে, এটা অসম্ভব কিছু না। বিএনপি এরই মধ্যে তাদের ভাঙা রেকর্ড বাজাতে শুরু করেছে। বলছে তারা, নির্বাচনে সুস্থ পরিবেশ নেই। তাদের নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতারের শিকার হতে হচ্ছে। হামলা-মামলার আতঙ্কে তাদেরকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই। বিএনপির কোনো কোনো নেতা আবার একথাও বলছেন যে, এ বছরের শেষ দিকে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে, সেটা কেমন হবে তার নমুনা দেখা যাবে এই তিন সিটি নির্বাচনে। কিছুটা কৌতুককর বিষয় হচ্ছেÑ এই একই কথা তারা খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের আগেও বলেছিলেন। তাহলে ওই দুই পরীক্ষায় তারা সরকারকে কত মার্কস দিয়েছেন? নির্বাচন কমিশনকেই বা কত মার্কস দিয়েছেন? আমি তো নিশ্চিত, দু’পক্ষের কেউই তাদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। যদি তাই হয়, তাহলে আবার তিন পরীক্ষার কথা বলা হচ্ছে কেন? তাদের কথাবার্তায় স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে, তারা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই সরকার এবং এই নির্বাচন কমিশনের উপর আস্থা রাখে না। ন্যূনতম আস্থাও তাদের নেই। তারপরও কেন তাহলে তারা এদের অধীনেই বারবার নির্বাচনে যায়? যায় আর প্রতিবারই পরীক্ষার কথা বলে? বিএনপির এটা কোন রাজনীতি?

আসলে বিএনপির রাজনীতিটা তেমন একটা অস্পষ্ট কিন্তু নয়। আমার বিবেচনায় সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো নিয়ে তারা তেমন একটা ভাবছে না। তাদের মূল লক্ষ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর মাঝে তারা সকল নির্বাচনে অংশ নেবে। আপত্তি করবে, সন্দেহ করবে, অবিশ্বাসের কথা প্রকাশ করবে, কিন্তু আবার অংশও নেবে। তারা আসলে এখন সময়ক্ষেপণের পথ অবলম্বন করছে। চাচ্ছে কোনোভাবে কেবল জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত সময় পার করতে।

মূল লক্ষ্য তাদের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়া। হয়তো যেকোনো কিছুর বিনিময়েই অংশ নেবে। বিএনপি মনে করে, সারা দেশে তাদের বিপুল সংখ্যক ভোটার রয়েছে। এরা হয়তো বিএনপির ডাকা কোন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেবে না, কিন্তু ভোটের দিন গিয়ে ভোটটা দিয়ে আসবে ধানের শীষে। তারা এমনও আশা করে যে, সেই ভোট বিপ্লবের মাধ্যম রাতারাতি তারা ক্ষমতায় চলে যাবে। আর একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে সবকিছুই নেয়া যাবে নিজের নিয়ন্ত্রণে।

আর এর আগে হতে থাকা সিটি নির্বাচনগুলো, এই তিনটি নির্বাচনও কেবলই অংশ নেয়ার জন্য নেয়া। এ কারণে নেয়া, যাতে কেউ বলতে না পারেÑ এরা নির্বাচনে বিশ্বাস করে না। এ কারণে অংশ নেয়া, যাতে তারা সরকারি দলের অনৈতিক কর্মকা-গুলোও প্রকাশিত করতে পারে জনগণের সামনে। গত কয়েক বছর দেশজুড়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হয়ে থাকে, সেটা হচ্ছেÑ এরা নাকি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাটিকেই একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে। বিএনপি হয়তো এমনও আশা করেÑ এই সিটি নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে সেই অভিযোগটি তারা জনগণের সামনে আরও বেশি নগ্ন করে উপস্থাপিত করতে পারবে।

শেষ পর্যন্ত কার প্রত্যাশা কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, সেটা হয়তো সময়েই দেখা যাবে।

মাসুদ কামাল: লেখক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :