প্রয়োজন হজযাত্রীবান্ধব ব্যবস্থাপনা

জহির উদ্দিন বাবর
| আপডেট : ২০ জুলাই ২০১৮, ২২:০২ | প্রকাশিত : ১৮ জুলাই ২০১৮, ১২:৩০
ফাইল ছবি

পবিত্র হজের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এবার যারা হজে যাবেন তাদের প্রস্তুতিও শেষ পর্যায়ে। ১৪ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে হজ ফ্লাইট। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২১ আগস্ট পালিত হতে পারে এবারের হজ। এ বছর বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ২৭ হাজার লোক হজে যাচ্ছেন। প্রতি বছরই হজযাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি ধর্মকর্মের প্রবণতাও বেড়েছে। এজন্য দিন দিন বাড়ছে হজযাত্রীর সংখ্যা। আগে যেখানে হজের কিছুদিন আগে সিদ্ধান্ত নিয়েও হজে যাওয়া যেত, এখন কমপক্ষে এক বছর আগে নিবন্ধন করতে হয় হজে যাওয়ার জন্য। যে হারে হজযাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে সামনে হজে যাওয়ার জন্য কয়েক বছর আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

একজন মুসলমানের জীবনের পরম চাওয়া থাকে একবার হলেও পবিত্র হজব্রত পালন করা। প্রিয়নবীর স্মৃতিধন্য জায়গাগুলো একবার হলেও সচক্ষে দেখার আকুলতা থাকে প্রতিটি মুমিনের। এজন্য হজ নিছক কোনো ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আবেগ ও ভালোবাসা। অন্য যেকোনো ইবাদতের চেয়ে এখানে আবেগ ও স্বতঃস্ফূর্ততার বিষয়টি বেশি অনুভব করা যায়। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এই আবেগটা নিয়ে রীতিমতো ব্যবসা করা হয়। হজযাত্রীদের সেবার নামে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা গলাকাটা ব্যবসা শুরু করে। হজযাত্রীদের পদে পদে শিকার হতে হয় প্রতারণার।

আমাদের দেশ থেকে দুইভাবে হজে যাওয়া যায়Ñ ব্যালটি ও নন-ব্যালটি। অর্থাৎ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। তবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যান মাত্র কয়েক হাজার হজযাত্রী। আর বাকি সবাই বেসরকারি ব্যবস্থাপনাতেই যান। উভয় ক্ষেত্রেই হজযাত্রীদের হয়রানির কোনো শেষ থাকে না। সরকারি উদ্যোগে হজে যেতে হলে এক ধরনের ভোগান্তি, আবার বেসরকারি উদ্যোগে ভিন্ন ধরনের জটিলতা।

হজ ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব সরকারের। ধর্ম ও বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এই কার্যক্রম দেখভালের কথা। কিন্তু প্রতি বছরই হজসংক্রান্ত কোনো না কোনো জটিলতার শিকার হতে হয় আল্লাহ্র ঘরের মেহমানদের। হজ নিয়ে নানা দুর্নীতির অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। হজসংক্রান্ত বড়ধরনের দুর্নীতিতে ধরা পড়ে মন্ত্রিত্ব হারানোর নজিরও এদেশে ঘটেছে। হজ ফ্লাইট, বাড়ি ভাড়া, বিমান ভাড়া চুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কারচুপি ও দুর্নীতির ঘটনা প্রতি বছরই কম-বেশি ঘটে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি মুসলিম দেশে হজের মতো পবিত্র একটি বিষয়ে এত অসাধু কর্মকাণ্ড বিশ্বের আর কোনো দেশে আছে কি না আমাদের জানা নেই।

হজযাত্রার বেসরকারি উদ্যোগগুলো আরও বেশি দুর্নীতিপ্রবণ। ইচ্ছেমতো হজবাণিজ্য চলে এখানে। হজ কাফেলা, হজ এজেন্সি, হজ ট্রাভেলস ইত্যাদির ছড়াছড়ি আজ সারা দেশে। এগুলোকে এই সময়ের সবচেয়ে লাভজনক ও আকর্ষণীয় ব্যবসা মনে করা হয়। হজ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই অল্প দিনেই বাড়ি গাড়ির মালিক হয়ে যাচ্ছেন। ইদানীং মাদ্রাসাপড়–য়াদের একটি অংশ এই ব্যবসার সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িয়ে যাচ্ছেন। তারা এটাকে বাড়তি উপার্জনের সহজ পথ হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। যেহেতু আলেম-উলামা এবং মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বেশি এজন্য হজ এজেন্সিগুলো তাদেরকে কাজে লাগায়।

আমাদের দেশের হজ কাফেলা ও হজ এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে নানাধরনের অভিযোগ রয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগে যারা হজ করিয়ে থাকেন তাদের দেওয়া ওয়াদা এবং কথাবার্তার আগাগোড়া তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। নানা আকর্ষণীয় প্যাকেজের মাধ্যমে প্রথমে হজ গমনেচ্ছুকদের নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করে। সারা জীবনের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে যারা হজে যাওয়ার নিয়ত করেন তাদের সবার একটা হিসাব থাকে কীভাবে কিছুটা কম খরচে সুযোগ-সুবিধাসহ হজব্রত পালন করা যায়। মধ্যবিত্ত এই শ্রেণিটিই হজ এজেন্সিগুলোর প্রধানত টার্গেট। নির্দিষ্ট প্যাকেজের আওতায় হজের টাকা জমা দেওয়ার পর থেকে পদে পদে তারা প্রবঞ্চনার শিকার হন। অতি মুনাফালোভী একদল হজ ব্যবসায়ী কৌশলে তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ও অন্যায্য অর্থ হাতিয়ে নেয়।

কেউ যখন হজের খাতায় নাম লেখান তখন তার মনের অবস্থা অনেক পরিবর্তন হয়ে যায়। তার একমাত্র আকুলতা ও প্রয়াস থাকে কীভাবে বায়তুল্লাহ ও রওজায়ে পাকে গিয়ে হাজির হওয়া যায়। তাদের এই দুর্বলতার সুযোগে হজ ব্যবসায়ীরা এসব অন্যায় আচরণ করে থাকে। তবে সব এজেন্সির বিরুদ্ধে এক ধরনের অভিযোগ করা ঠিক হবে না। অনেক এজেন্সি আছে যারা অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রতি বছর হজযাত্রীদের উত্তম সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

হজ এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে সাধারণত যেসব অভিযোগ করা হয় সেগুলো হলো, তারা যে প্যাকেজ ঘোষণা করে তাতে অনেক ফাঁক-ফোকর থাকে। হজযাত্রীদের যেসব সেবা দেওয়ার কথা বলা হয় তা যথাযথভাবে দেয় না। এক্ষেত্রে খাওয়া-থাকার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অত্যন্ত নি¤œমানের খানা হজযাত্রীদের জন্য পরিবেশন করা হয়, যা খেয়ে তাদের বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা হয়ে থাকে। পবিত্র হারাম শরিফের যত কাছে ও সুবিধাজনক বাড়িতে বা হোটেলে তাদেরকে রাখার কথা বাস্তবে এর কোনো কিছুরই মিল পাওয়া যায় না। কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, কোরবানির জন্য হজযাত্রীদের প্রদত্ত টাকা যথাযথ খাতে ব্যয় করা হয় না। অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ গ্রহণের অভিযোগটি প্রায় সব এজেন্সির বিরুদ্ধেই রয়েছে।

সবচেয়ে বড় যে অভিযোগটি তা হলো, পাসপোর্ট-ভিসা সব হয়ে যাওয়ার পর যখন ইহরাম বাঁধার সময় আসে তখন বিভিন্ন অজুহাতে খরচ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। চূড়ান্ত ও দুর্বল মুহূর্তে আল্লাহ্র ঘরের মেহমানদের সঙ্গে করা হয় অন্যায্য এই আচরণটি। বিভিন্নজনের কাছ থেকে টাকা জমা নিয়ে কাফেলা বা এজেন্সির মূল কর্তা ব্যক্তিটির পালিয়ে যাওয়া ও আত্মগোপনের মতো জঘন্য ঘটনাও এদেশে কম ঘটেনি। বিভিন্ন অপকর্মের জন্য বেশ কিছু এজেন্সিকে প্রতি বছর সৌদি সরকার নিষিদ্ধ করে। বিষয়টি জানা সত্ত্বেও এর কোনো সুরাহা না করে ওই এজেন্সিগুলো হজযাত্রী সংগ্রহ করতে থাকে। এভাবে শেষ মুহূর্তে টাকা-পয়সা জমা দিয়েও অনেকেই হজে যেতে পারেন না।

একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশের হজযাত্রীদের যাবতীয় ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সরকারের। সরকারের একার পক্ষে যেহেতু এত বড় দায়িত্ব সামলানো সম্ভব নয় এজন্য বেসরকারি ব্যবস্থাপনারও দরকার আছে। দীর্ঘসূত্রতা ও আমলাতান্ত্রিক বিভিন্ন জটিলতার কারণে ব্যালটি হজযাত্রীদের সংখ্যা সাধারণত কম থাকে। টাকা বেশি লাগলেও ঝামেলা কম থাকায় নন-ব্যালটি হজযাত্রীর সংখ্যা বেশি। তবে শুধু ব্যালটিদের দায়িত্ব সরকারের আর নন-ব্যালটিদের দায়িত্ব প্রাইভেট এজেন্সিগুলোরÑ সরকারকে একথা ভাবলে চলবে না। সব হজযাত্রী নির্বিঘœ ও আরামদায়ক হজযাত্রা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের অনিয়মগুলো দূর করা যেমন সরকারের দায়িত্ব তেমনি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অন্যায্য ও অবৈধ কর্মকা-ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও খবরদারি করাও তাদেরই দায়িত্বের আওতায় পড়ে।

হজযাত্রীদের সঙ্গে যারা অন্যায্য ব্যবসায় লিপ্ত হন তাদেরকে একবার ভেবে দেখা উচিত, তারা কাদের সঙ্গে অন্যায়মূলক এই আচরণ করছেন। যারা হজে যান তারা আল্লাহ্ ও প্রিয়নবীর ঘরের মেহমান। সেই মেহমানদের সঙ্গে প্রতারণা, ব্যবসায়িক চতুরতা কিংবা অন্যায্য মুনাফাখোরি কোনো বিশ^াসী মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। বিবেকের দায়বোধ ও দংশন থাকলে কেউ এ ধরনের জঘন্য কাজ করতে পারেন না। মনে রাখবেন, অন্য দশটি ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতারণা ও চাতুর্যতার আশ্রয় নেওয়াটা যতটা না অন্যায়ের এর চেয়ে অনেক গুণ বেশি অন্যায়ের হজযাত্রীদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ। এজন্য আপনি ব্যবসায় মুনাফা করুন, কিন্তু ধর্মীয় আবেগ নিয়ে খেলবেন না। মানুষের স্পর্শকাতর বিশ্বাসের জায়গাগুলোকে দয়া করে আপনার ব্যবসার পণ্য বানাবেন না।

জহির উদ্দিন বাবর: বার্তা সম্পাদক, ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :