‘ভিডিওসহ’

প্রকাশ | ১৯ জুলাই ২০১৮, ১৭:৩৩

মনদীপ ঘরাই

ইদানিং খবরের স্বাদ আস্বাদনের ধরনটাই গেছে পাল্টে। সকাল সকাল খবরের কাগজের জন্য অপেক্ষাটা এখন আর নেই। শুধু সকালই বা কেন বলি! আমার গ্রামের বাড়িতে দুপুরে পৌঁছাতো দৈনিক পত্রিকা। ততক্ষণ আমার পিতামহকে দেখতাম আগের দিনের খবরগুলোকে রিভিশন দিতেন।

এখন সময় বদলেছে। ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই খবর। অনলাইন কিংবা টিভির পর্দায়। এখন শুধু খবরেও মন ভরছে না আমাদের। চাই ঘটনার ভিডিও চিত্র। তবেই না বুঝতে পারবো ঘটনাটা ঘটেছে ঠিক ঠিক।

এই অভ্যাসটা বেশিদিনের পুরোনো নয়। তবে, একবার কোনোকিছুতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেলে মনে হয় সেটি সাথে আছে আদিকাল থেকে।

তাহলে, আজকের এই আলাপের বিষয়বস্তু দাঁড়ালো খবরের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলে ভিডিওচিত্র। তাই সংবাদমাধ্যমগুলো শিরোনামের সাথে জুড়ে দিচ্ছে (ভিডিওসহ)

তবে, এই (ভিডিওসহ) কে বিজ্ঞাপন হিসেবে কাজে খাটাচ্ছে একদল অসাধু সংঘ।

চাঞ্চল্যকর কিংবা রগরগে কোনো শিরোনামের সাথে তার জুড়ে দিচ্ছে (ভিডিওসহ)। আগ্রহ নিয়ে ভেতরে ঢুকলে দেখবেন অ্যাড অথবা অন্য ভিডিও। উদাহরণ চান?

"যে ঘটনাটি বদলে দিলো নায়ক * এর জীবন (ভিডিওসহ)"

ভেতরে ঢুকে ভিডিও লিঙ্কে ক্লিক করে দেখলেন নায়ক মনের সুখে নেচে চলেছেন কোনো গানের দৃশ্যে!

তবে, এই ভিডিওর কল্যাণে অনেক ঘটনার সত্যতাও উন্মোচিত হয়েছে। আক্রমন, খুন, লাঞ্ছনা, দুর্ঘটনা কিংবা শিশু নির্যাতনের মতো ঘটনা চোখের সামনে এনে দিয়েছে খবর প্রকাশের এই নতুন ধারা।

ভালো-মন্দ মিলিয়ে চলা এই সফরের যাত্রী কমবেশি আমরা সবাই।

এবার চলুন ঘটনার আরও একটু Deep এ অর্থাৎ গভীরে যাওয়া যাক। এত এত বাংলা শব্দের ভীড়ে আবার Deep এর ব্যবহার কেন? কারণটা আপনাতেই জানতে পারবেন আলোচনার পরের পর্যায়ে।

অনেক সময় মজা করার জন্য ভিডিওতে একজনের মুখমন্ডলের জায়গায় অন্যের মুখ বসিয়ে ভিডিও বানায় অনেকেই। ছবির ক্ষেত্রে এককথায় আমরা বলি, "ফটোশপড্"। ভিডিওর ক্ষেত্রেও একই টার্ম ভুল করে ব্যবহার করে ফেলি। আসলে  টার্মটা হবে, ফেক ভিডিও। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফেক ভিডিওর একটা না একটা ত্রুটি থাকেই, যা আপনার মনে কড়া নাড়বে, "এই ভিডিওটা আসল না"

২০১৭ সালে এসব বিশ্বাসের জায়গা লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ফেক ভিডিওর জগতে হানা দেয় DEEP Fake Video। এবার আর গলাকাটা পাসপোর্টের সিস্টেমে নয়। মুখের স্থলে মুখ বসিয়েই ক্ষান্ত হয় নি ডেভেলপাররা। মুখমন্ডলের প্রতিটি সুক্ষ্ম নড়াচড়া হতে শুরু করে অঙ্গভঙ্গি, এমনকি বাচনভঙ্গি... সবকিছুই দখলে নিয়ে নেয় ডিপফেকের সিস্টেম। এরপর আপনার মুখভঙ্গি ও কথা দিয়ে তৈরি করতে পারেন পৃথিবীর যে কোন ব্যক্তির ভিডিও। আবারও বলছি, যে কোন ব্যক্তির।

কেন এই ডিপফেকের বিষয়টি তৈরি করছে উদ্বেগ? কারণটা জানতে ঢুকতে হবে নিষিদ্ধ জগতে। ডিপফেক ভিডিও প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে ইন্টারন্যাশনাল সেলিব্রিটিদের ফেক পর্ন ভিডিও তৈরি। কেটি পেরি থেকে শুরু করে নামকরা তারকারা আছেন এ তালিকায়। ভদ্রতা বজায় রেখেও নোংরাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারেন যে কেউ। যাচাই-বাছাই করতে করতে নাম খারাপ হয়ে যাবে শতগুণ।

নীল জগতের বাইরে উদ্বেগের আরেকটি জায়গা রাজনীতি। ইতোমধ্যেই ট্রাম্প,পুতিন,ওবামার ডিপফেক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে দাবানলের মতো। যা ইচ্ছে তাই বলানো হচ্ছে এসব শীর্ষ আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের মুখ থেকে।

ক-দিন আগে ইনবক্সে জাকারবার্গের একটা ভিডিও দেখেছিলেন? ফেসবুক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি! এ সবই ডিপফেকের কারসাজি।

আমাদের দেশে ফেকের প্রচলন থাকলেও ডিপফেকের প্রচলন তেমন করে হয় নি।

এখনই সময়। ভয়ংকর এই অসুখকে রুখতে প্রতিষেধক নিয়ে চিন্তা করতে হবে এই মুহূর্ত থেকেই। আর এসব না ভেবে চোখ বুজে বসেও থাকতে পারেন। দেখবেন, কোনো এক কর্মব্যস্ত দুপুরে ম্যাসেঞ্জারে একটা ভিডিও লিঙ্ক আসলো। প্লে করে দেখলেন, আপনি পৃথিবী ধ্বংস হবার ভবিষ্যৎবাণী করছেন, যা আপনার কল্পণারও হয়তো বাইরে। গভীর প্রতারণার চলছবি রুখতে গভীরভাবে চিন্তা করার বিকল্প আছে কি?

মনদীপ ঘরাই: সিনিয়র সহকারী সচিব, বাংলাদেশ সরকার