একজন রাজীব মীর, দশ টাকা এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ!

দিলরুবা শরমিন
| আপডেট : ২১ জুলাই ২০১৮, ২৩:০৮ | প্রকাশিত : ২১ জুলাই ২০১৮, ২৩:০৬

আনুষ্ঠানিকভাবে চলে গেলেন রাজীব মীর। আমার পরিচিত একজন মানুষ। ঠিক বন্ধু বলা যাবে না। আবার বন্ধু নন কেবলই পরিচিত এই কথাটাও বলতে মন সায় দিচ্ছে না। মাঝামাঝি একটা সম্পর্ক। মোটেই দূরের নয় আবার খুব কাছের সেই দাবিও করতে পারি না।

তরতাজা একটি মানুষ সে যে কেউ হোক অবেলায়, অসময়ে চলে যাওয়া শত্রুর ক্ষেত্রেও কাঙ্ক্ষিত নয়। আবার বহুকষ্টে বেঁচে থাকারও কোনো মানে হয় না। এই পৃথিবীতে বিশেষ করে এই দেশে বেঁচে থাকা এবং মান সম্মান নিয়ে টিকে থাকা অনেক কঠিন কাজ। যেমনটি রাজীব মীরের ক্ষেত্রে ঘটেই চলেছিলো।

রাজীব মীরের সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকেই। তার পোস্টে সব সময়ই দেখতাম তার স্ত্রীর সাথে রোমান্টিক ছবি, সাথে কিছু কবিতা। পরে যোগ হয়েছিল তার মেয়ের ছবি। কখোনো কাউকে আক্রমণ, তিরস্কার বা ছোট করে কাউকে নিয়ে কিছু লিখেছেন বলে মনে পড়ছে না।

একদিন হঠাৎ ই আমাকে ইনবক্স এ জানালেন দেখা করতে চান। এলেন আমার চেম্বারে। বললেন তার সমস্যা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের করত্রপক্ষ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন সরাসরি ‘ছাত্রীদের কে যৌন হয়রানি” করার অভিযোগ। অথচ তখন অব্দি কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ দেননি । অদ্ভুত–উদ্ভট সব অভিযোগ।

অবশ্যই অভিযোগটি গুরুতর। ক্ষমাহীন অপরাধ (যদি সেটা সত্যই ঘটে থাকে)। তিনি আইনি পরামর্শ, সহযোগিতা নিতে এসেছেন আমার কাছে। সব শুনে আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মত সৎসাহস তার আছে কিনা। যদি থাকে তবে আমি তাকে সাহায্য করবো। তিনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেষ অব্দি তাকে শিক্ষকতা পদ থেকে বিতাড়িত করেই ছেড়ে ছিলেন। কিন্তু আইনে- উচ্চ আদালতের রায়ে রাজীব মীর বিজয়ী হয়েছিলেন এবং কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন রাজীব মীরের বকেয়া বেতন পরিশোধ করে স্বপদে বহাল করার জন্য। মানেননি সেটা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ। তাতে অবশ্য তাদের কিছু হয়ওনি। এমন কি রহস্যময় শক্তির কারণে আদালত অবমাননাও নয়।

বাংলাদেশের এই এক অদ্ভুত “সিস্টেম”!!!

যে কেউ, যে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আনুক যে ওমুকে আমাকে যৌন হয়রানি করেছে– ব্যস হয়ে গেলো যৌন হয়রানি। তো হোক সেটাতে আমার আপত্তি নাই। তারজন্য বিশেষ আইন আছে – বিশেষ আদালত আছে– বিশেষ আইনজীবী আছেন – বিশেষ বিচারক আছেন সব ‘বিশেষ’ই আছেন। যেখানে ফৌজদারী অপরাধের বিচারের জন্য এত “বিশেষ” এর সমাগম সেখানে কেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একচ্ছত্রভাবে এই নাম জানা, সাক্ষ্য প্রমাণবিহীন অভিযোগ আমলে এনে একজন শিক্ষককে এইভাবে বিতাড়িত করতে পারেন?

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্বয়ংসম্পূরণ, তার মানে তো এই নয় যে আমাকে তৈল মর্দন করে না বা আমার চেয়ে যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক বা আমার দল করে না তাই শেষ মরণাস্ত্র তার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনা। যার কোন ভিত্তি, প্রমাণ, সাক্ষী কিছুই আজো তারা দেখাতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। নইলে উচ্চ আদালত রায়কে চ্যালেঞ্জ করলো না কেন তারা ???

চলে গেলেন রাজীব মীর!!!

ক্ষতি হোলো কার??? কারো না। তার জন্যে না পতাকা অর্ধনমিত হবে, না শোক সভা না সূর্য অস্তমিত হবে- না চন্দ্রোদয় হবে না। সবই নিয়মমাফিক চলবে। যা কষ্ট হবে সেই মেয়েটির যে রাজীব মীরের হাত ধরে পায়ে আলতা মেখে ঘর বেঁধেছিল সুখের সংসার করার। যে কন্যা শিশুটির আগমন বারতা রাজীব মীর আনন্দ উদবেলিত কন্ঠে আমাকে জানিয়েছিলেন, আপা আজ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ !!!

সেই মেয়েটি বা সেই নাবালিকা কন্যা শিশুটির কথা কেউ ভাবছেন কি ???

একথা বলা খুব সহজ ছিল যে রাজীব মীর স্যার আমাকে যৌন হয়রানি করেছে। কি রকম যৌন হয়রানি??? আমাকে দিয়ে জোর করে তার বই কিনিয়েছে। অটোগ্রাফ দিয়েছে। আমাকে নিয়ে সিনামায় যেতে চেয়েছে ব্লা ব্লা ব্লা। আচ্ছা এই সব যদি যৌন হয়রানী হয় তো ভালো তার জন্য আইন আছে, আদালত আছে, থানা আছে, পুলিশ আছে। তাহলে কি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ১০ (দশ) ধারা অভিযোগকারীনি বা বিশ্ববিদ্যালয় করত্রিপক্ষ জানেন না? পড়েন নি? নাকি পড়তে চান না???

রাজীব মীর চলে গিয়েছেন। ভালোই হোলো। অসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে চলে যাওয়াই শ্রেয়। এই দেশে কার যে মান আছে আর কার যে নেই সেটা আজ অব্দি বুঝলাম না। মুড়ি আর মুড়কির দাম যে দেশে সমান সেই দেশে আর শিক্ষক আর সন্ত্রাসীর তফাৎকে কিভাবে পরিমাপ করবে?

রাজীব মীরের সাথে এমন সখ্যতা ছিল না যে নিত্যদিন কথা বলতে হবে আমাদের দেখা হবে। তবে দেখা হোতো- বই মেলায়। কোনো আলোচনা সভায়। দেখা হয়েছে আমার বাচ্চাদের জন্মদিনে। অবলীলায় মিশেতে দেখেছি তাকে মানুষের সাথে। কোনো সংকোচ নাই– জড়তা নাই। কারো প্রতি বিশেষ সু বা কু দৃষ্টি নাই। আস্তে আস্তে রাজীব মীর নিয়মিত না দেখা এক নিকটজনই হয়ে গিয়েছিলেন।

বই মেলায় দল বেঁধে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখা। রাজীব মীর জোর করে এক দোকানে নিয়ে গিয়ে তার কবিতার বই এ অটোগ্রাফ দিয়ে আমার এবং সঙ্গীয় দলবলের হাতে গুঁজে দেয়া খুব সাধারণ ব্যাপার ছিলো। এই যে আমার সঙ্গীয় মানুষগুলো তারা লিঙ্গীয়ভাবে সকলেই পুরুষ। তবে ??? তাদের কে কি যৌন হয়রানি করা হোলো ???

ভারত থেকে হঠাৎই কল এলো একদিন। রাজীব মীরের বোন পরিচয় দিয়ে জানালেন যে রাজীব মীর অসুস্থ। আমি যেন তার জন্য দোয়া করি। স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম এটা শুনে। কারণ কৃষ্ণবর্ণের ঝকঝকে সাদা হাসির রাজীর মীর এত বড় অসুখের সাথে লড়াই করছেন আর আমি জানিই না ???

তার ভক্ত আমার নিকটজনদেরকে সংবাদটা দিতেই সকলে মুষড়ে পড়লেন। কিন্তু কিভাবে তাকে ঠিক সাহায্য কোরবো বুঝতে পারছিলাম না। না ফোন নং জানি না কোন ঠিকানা।

সেই কিংকরতব্য বিমূঢ় অবস্থায় একটা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গেল – বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন– রাজীব মীরের চিকিৎসার সাহায্যারথে দশ টাকার অনুদান দেবার জন্য আহবান।

বাহ !!!

একজন শিক্ষক, একজন লেখক, একজন গবেষক এবং শিক্ষিত, ভদ্র এবং আর্থিকভাবে মোটামুটি স্বচ্ছল একজন মানুষের জন্য এইভাবে বিজ্ঞাপন দেয়া কতটা শোভনীয় ছিল সে পত্রিকাওয়ালারাই জানেন। নাকি এর পেছনেও ছিল কোন প্রাসাদ ষঢ়যন্ত্র ??? প্রথম আলো না মানুষ কে “প্রথম আলো” দেখায় ??? রাজীব মীরের আলো নিভানোর জন্যই ওই বিজ্ঞাপনের ব্যবহার ছিলো কি ???

রাজীব মীর আর ফিরে আসবেন না। আসতে চাইলেও পারবেন না। আর পারলেও আসার দরকার নাই। ঘুমাক তিনি শান্তিতে। ওই পারে তো কেউ তাকে এইভাবে হেনস্তা করবে না, মানসিক যন্ত্রণা দিবে না, হয়রান হবেন না তিনি আইন আদালতে ছুটতে ছুটতে।

আমার আশংকা অন্যখানে আইনের ভুল ব্যাখ্যা, প্রশাসনের রাজনীতিকরণ বা দলীয়করণ, ছাত্রীদেরকে ব্যবহার করে শিক্ষককে হেনস্তা করা এই সব না জানি আরো কত রাজীব মীর ইহোলোক ত্যাগের আগে ন্যয়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত করবে --- ভয়ে আছি, আতংকে আছি!!!

লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :