ঘুমায় না কারওয়ান বাজার

প্রকাশ | ২২ জুলাই ২০১৮, ০৮:২৮ | আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৮, ১৫:০১

কাজী রফিকুল ইসলাম, ঢাকাটাইমস

দিনের কোলাহল শেষে রাত যত বাড়ে, তত নীরবতা নামে রাজধানী ঢাকায়। তবে এই চিত্র মিলবে না রাজধানীর কারওয়ান বাজারে। সেখানে দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে ভিন্ন এক কোলাহল পুঞ্জীভূত হয় রাতে। দিনভর লেগে থাকা অলস ব্যস্ততা সন্ধ্যার পর ঝেড়ে ফেলে অন্যরূপ ধারণ করে রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজারটি।

প্রতিদিন রাত ৯টার পর এক নতুন রূপ পায় কারওয়ান বাজার। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সবজিবোঝাই ট্রাক আসতে শুরু করে এখানে। শশব্যস্ত হয়ে ওঠেন পাইকার, ক্রেতা, আড়তদার, ভ্যানচালক আর নানা কাজের শ্রমিক। তাদের সঙ্গে আছেন দোকানি, হকার, পথশিশু- কত পেশার মানুষ।

এফডিসির রেলগেট থেকে পশ্চিমে সার্কফোয়ারা, উত্তরে তেজতুরিবাজার স্ট্যান্ডার্ড চার্টাড ব্যাংক থেকে জনতা টাওয়ার হয়ে রেললাইন পর‌্যন্ত এই বাজারের ব্যাপ্তি। মধ্যরাতের পর বেচাকেনা ছড়িয়ে পড়ে বাজার এলাকা ছাড়িয়ে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউর মূল সড়কেও। ওদিকে বিজিএমইএ ভবনের বিপরীতে মাছের আড়তের বেচাকেনাও নেমে আসে সোনারগাঁও-এফডিসি রোডে। 

মালবোঝাই একেকটা ট্রাক আসে আর তার পিছু পিছু ছোটে ভ্যানগাড়ি, শ্রমিক আর পথশিশুরা। ট্রাকটি ঘিরে তখন হল্লা ওঠে।  

এই কারওয়ান বাজারই আবার দিনের বেলায় কেতাদুরস্ত। পার্কিংয়ে ও সড়কে ঝা চকচকে দামি গাড়ি, এলাকাজুড়ে সরকারি-বেসরকারি নানা অফিস-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্যুটেড-বুটেড লোকজনের আনাগোনা।

মূলত সন্ধ্যা মিলিয়ে রাত নামার পর বদলাতে থাকে দৃশ্যপট। মাথায় কিংবা কোমরে গামছা বাঁধা মানুষ দখল নিতে থাকেন এলাকার। সড়ক আর পার্কিংয়ে তখন এলোমেলো দাঁড়ানো ট্রাক। সারি সারি রিকশাভ্যান। এসব রিকশাভ্যানে আবার ব্রেক নেই। এগুলো শুধু মাল টানার কাজে ব্যবহার হয় কারওয়ান বাজারে।

সড়কবাতির আলো-আঁধারিতে হাজারো রাতজাগা মানুষের ব্যস্ততায় এক অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি হয় কারওয়ান বাজারের প্রায়ান্ধকার সড়ক আর অলি-গলিতে। এর মধ্যেই লেনদেন হয় লাখ লাখ টাকার।

পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ট্রাকে করে যেসব সবজি আসে তা কখনো সরাসরি আড়তে দেয়া হয়। আবার কখনো মধ্যস্বত্বভোগীরা পুরো ট্রাকের পণ্য কিনে পরে তা আড়তে বিক্রি করে কিংবা রাস্তার এক পাশে স্তূপ করে পাইকারি ক্রেতার জন্য। আড়ত থেকেও কেনে রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা। এই হাতবদল চলে রাতভর।

ট্রাক থেকে সবজি কিংবা ফল নামানো, আড়তে নেয়া, আবার আড়ত থেকে ভ্যানে-পিকআপে পণ্য তোলার ব্যস্ততা লেগে থাকে সকাল পর‌্যন্ত। কেউ মাথায় সবজিবোঝাই ঝুড়ি নিয়ে হন্তদন্ত ছুটে চলে, কেউ পিঠে বিশাল বস্তা বয়ে নিচ্ছে। ট্রাকের পেছনে রিকশাভ্যান লাগিয়ে তাতে স্তূপ করা হচ্ছে মালামাল।

এর মধ্যেই পড়ে যাওয়া শাক-সবজি কিংবা ফল টুকিয়ে নিচ্ছে একদল শিশু ও পুরুষ-মহিলা। এগুলোর জন্য তাদের দাম দিতে হয় না। রাতভর এভাবে কুড়ানো পণ্য একত্র করে তারা নির্ধারিত ক্রেতার কাছে কিংবা দিনের বেলায় বিক্রি করে সাধারণ মানুষের কাছে।

তাদের মতোই আরেকটি টোকাই দল আছে, যারা পণ্যবাহী ট্রাক কারওয়ান বাজারে ঢোকার পথে চোখের পলকে মাছ ও মুরগি চুরি করে চম্পট দেয়- এমন অভিযোগ ট্রাকচালকদের। সবজিও বাদ যায় না এদের হাত থেকে, বিশেষ করে লাউ, কপি, মানকচু, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি। এসব ‘চোরাই’ মাল পরে তারা বিক্রি করে দেয়।

বিচিত্র কর্মযজ্ঞের ভিড়ে বেশি চোখে পড়ে মূলত শ্রমিকদের দৌড়ঝাঁপ। তারা অনেকে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করেন। সবজি ভরা বিশাল বিশাল ঝাঁকা কিংবা বস্তা একের পর এক নামিয়ে দেখতে দেখতে খালি করে ফেলেন ট্রাক।

কথা হয় জব্বার নামের এক শ্রমিকের সঙ্গে। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘এখানে কাম করি অনেক দিন। রাইত দশটায় আহি। সকাল পর্যন্ত থাকি। কাম শেষ কইরা যাইয়া ঘুমাই। ডিইলি চাইর-পাচ শ টাকা থাকে।’

তবে তাদের আয় আরও বেশি হতো বলে জানান জব্বার। বলেন, ‘আগে লেবার কম ছিল, কাম বেশি ছিল, টাকাও ভালো পাইতাম। এহন অনেক লোক। আমার আবার বান্ধা পাইকার আছে। হের যত মাল আহে, আমরা কয়জন আছি, নিজেরা নামাই।’

রাত দুটোর পর থেকে দেখা মিলবে আরও এক ধরনের রিকশাভ্যানের। ফজরের আগ পর্যন্ত আসে এসব ভ্যানগাড়ি। এরা মূলত রাজধানীর বিভিন্ন মহল্লায় ফেরি করে সবজি বিক্রি করে। রাতে কারওয়ান বাজার থেকে পাইকারি দরে সবজি কিনে নিয়ে যান তারা।

এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন খুচরা বাজারে দৈনন্দিনের সবজি নেয়া হয় এখান থেকে। পাইকারি দামে শাক-সবজি কিংবা ফল চাইলে এ সময় কেনা যাবে পাইকারি দামে। তবে, এখান থেকে কেনাকাটার বিষয়ে বাড়তি সতর্কতার কথা জানান এখানকার নিয়মিত পাইকারি ক্রেতা বাবুল।

ঢাকাটাইমসকে বাবুল বলেন, ‘খুচরা দোকান থেকে এক কেজি, আধা কেজি কেনা যায়। এখানে সেই সুযোগ নাই। পাল্লা দরে বিক্রি হয়। পাঁচ কেজির পাল্লা। অনেক সময় পাল্লায় আধা কেজি ঘাটতি থাকে। আবার একেক পাইকারের কাছে একেক দাম। দু-এক জায়গায় যাচাই না করে কিনলে নির্ঘাত ঠকতে হবে।

জানা গেছে, রাতের কয়েক ঘণ্টার ব্যবসায় তিন থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন একেকজন আড়তদার।

জমজমাট পাইকারি সবজি বেচাকেনার ভিড়ে ফুটপাতে ও সড়কের কিনারে বসে পরাটা-ডাল-ডিমভাজির অস্থায়ী দোকান। তবে রাতের কারওয়ান বাজারের অন্যতম আকর্ষণ গরুর বটভুনা। এর এমনই চাহিদা রাত দুটোর পর খুঁজতে গেলে ভাগ্যে নাও জুটতে পারে।

(ঢাকাটাইমস/২২জুলাই/মোআ)