ভ্রমণ

আমরা যখন আজমিরে

প্রকাশ | ২৩ জুলাই ২০১৮, ১৩:১০

গাজী মুনছুর আজিজ, ঢাকাটাইমস

মঈনুদ্দিন চিশতির মাজারে পা রাখতেই একটি কথা মনে পড়ল। সেটি হলো, এ মাজারে আসার জন্য আশপাশের অনেককে মানত করতে দেখেছি। তবে আমার কোনো মানত নেই। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি সাধক হিসেবে তার মাজার দর্শনই আমার উদ্দেশ্য। সাইক্লিস্ট আবুল হোসেন আসাদ আমার এ দর্শনের সঙ্গী। অবশ্য তার কোনো মানত আছে কি না তা জানি না। কিন্তু আমাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের এক নবদম্পতি এসেছেন মানত করেই। তাদের সঙ্গে পরিচয় কলকাতা থেকে ট্রেনে দিল্লির পথে।

দিল্লি থেকে রাতের বাসে রওনা হয়ে সকাল ১০টার দিকে আসি রাজস্থানের আজমির শরিফ বাসস্ট্যান্ডে। তারপর ট্যাক্সিতে মাজারের গেট। গেট থেকে হেঁটে রওনা হই মাজারের উদ্দেশে। গেট থেকে মাজারে যাওয়ার এ পথের দুই পাশে অসংখ্য দোকান, আবাসিক হোটেল ও রেস্টুরেন্ট। বিভিন্ন পণ্যের পাশাপাশি অধিকাংশ দোকানেই সাজানো গিলাফ, আগরবাতি, মোমবাতি, মিষ্টিজাতীয় শুকনা খাবার ইত্যাদি। আবার কিছু দোকানে অনটাইম প্লেটে সাজানো লাল গোলাপের পাপড়িসহ বিভিন্ন ফুল। গিলাফগুলো লাল, নীল, হলুদ, খয়েরিসহ বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙের। এসব গিলাফের গায়ে অ্যামব্রয়ডারি বা প্রিন্টের মাধ্যমে কোরানের আয়াত বা আরবি ক্যালিগ্রাফি আঁকা। মাজারে আসা পুণ্যার্থীরা এসব কিনেন দান বা মানতের অনুষঙ্গ হিসেবে।

আমরা প্রথমে আসি মাজারের খাদেম সৈয়দ সারওয়ার চিশতির কাছে। খাদেম সাহেব আমাদের সঙ্গে আসা নবদম্পতির পারিবারিক পরিচিত। তারা খাদেম সাহেবের হোটেলে উঠেন। আমি আর আসাদ ভাই আসি মাজার দর্শনে। নানা বয়সী পুণ্যার্থীর ভিড়ে মুখর মাজার প্রাঙ্গণ। মুসলমান ও সনাতনধর্মীদের পাশাপাশি আছে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অসংখ্য পর্যটক ও পুণ্যার্থী।

মাজারের এক পাশে বৈঠকখানার মতো আছে। এ বৈঠকখানায় মাজারের খাদেমরা খাতা-কলম নিয়ে বসে আছেন। পুণ্যার্থীরা এসে এখানে নাম লেখান। মাজার প্রাঙ্গণে বেশ বড় দুইটা পিতলের পাতিল আছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠি পাতিলের ভেতর দেখার জন্য। 

পাতিলের ভেতর পুণ্যার্থীরা দানের টাকা-পয়সা ফেলেন। মাজার প্রাঙ্গণে অজুর জন্য পাকা পুকুর আছে। এ পুকুরের চারপাশে বসে মানুষ অজু করেন। মাজার প্রাঙ্গণে মসজিদ আছে। নান্দনিক নকশা ও কারুকার্য দেখে বোঝা যায় মসজিদটি প্রাচীন।

অনেক পুণ্যার্থীকে দেখি মাজার আঙ্গিনায় প্রবেশ করছেন গিলাফ নিয়ে দলবেঁধে। চারপাশে চারজন গিলাফটি ধরেন সামিয়ানার মতো করে। আবার অনেকেই গিলাফ ভাঁজ করে আনছেন। গিলাফের সঙ্গে আরও আনছেন প্লেটভর্তি ফুল, মোমবাতি, আগরবাতি বা শুকনা মিষ্টিজাতীয় খাবার। পুণ্যার্থীরা এসব দান বা মানতের অনুষঙ্গ নিয়ে মঈনুদ্দিন চিশতির সমাধি ঘরের একপাশ দিয়ে প্রবেশ করেন এবং সমাধি পরিদর্শন শেষে অন্যপাশ দিয়ে বের হন।

মঈনুদ্দিন চিশতির সমাধির পাশে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে হারমনি-তবলা বাজিয়ে কাওয়ালি পরিবেশন করেন একদল পুণ্যার্থী। অন্য পুণ্যার্থীরা বসে তা শুনেন। আবার আরেকদল পুণ্যার্থী মাজার প্রাঙ্গণে হেঁটে হেঁটে কাওয়ালি পরিবেশন করেন।

মাজার প্রাঙ্গণের পাশেও আছে গিলাফ, আগরবাতি, মোমবাতি বা ফুলের অনেক দোকান। কিছুক্ষণ মাজার প্রাঙ্গণে ঘোরাঘুরি করে বসি কাওয়ালির আসরে।

মঈনুদ্দিন চিশতি খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি বা খাজা গরিবে নেওয়াজ নামেও পরিচিত। চিশতিয়া সুফি তরিকার অন্যতম প্রচারক বা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি সাধক হিসেবেই মূলত তিনি পরিচিত। এ তরিকার মূল বক্তব্য ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা ও উদারতা।

ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী তিনি পূর্ব পারস্যের সিসটান রাজ্যের চিশতিতে ৫৩৬ হিজরি বা ১১৪১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। পনের বছর বয়সে তার বাবা-মা মারা যান। তিনি তার বাবার কাছ থেকে একটি উইন্ডমিল ও একটি ফলের বাগান উত্তরাধিকার সূত্রে পান। লোকমুখে প্রচলিত, একদিন তিনি তার ফলবাগানে পানি দিচ্ছেন এমন সময় বাগানে আসেন বিখ্যাত সুফি শেখ ইবরাহিম কুন্দুজী। মঈনুদ্দিন কুন্দুজীকে ফল দিয়ে আপ্যায়ন করান। প্রতিদানস্বরূপ কুন্দুজী মঈনুদ্দিনকে এক টুকরা রুটি খেতে দেন। এরপর মঈনুদ্দিন তার সব সম্পদ গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে জ্ঞানার্জন ও উচ্চ শিক্ষার জন্য বুখারার উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেখান থেকে আসেন নিশাপুর। সেখানে চিশতিয়া তরিকার প্রসিদ্ধ সুফি সাধক খাজা উসমান হারুনীর কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তার সেবায় ২০ বছর একাগ্রভাবে নিয়োজিত ছিলেন। পরে উসমান হারুনী তাকে সুফি প্রতিনিধিত্ব প্রদান করেন। 

মঈনুদ্দিন চিশতি অনেক দেশ ভ্রমণ করেন। ইরাকের বাগদাদে বড় পীর আবদুল কাদির জিলানীর সাহচর্যে ৫৭ দিন ছিলেন বলেও প্রচলিত আছে। তিনি আরব, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোর এবং পরে দিল্লি হয়ে আজমিরে বসতি স্থাপন করে ধর্ম প্রচার করেন। তার অনুসারী বখতিয়ার কাকী, বাবা ফরিদ, নাজিমুদ্দিন আউলিয়াসহ অনেক সুফি সাধক আছেন। ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে বা ৬৩৩ হিজরির ৬ রজব সূর্যোদয়ের সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

(ঢাকাটাইমস/২৩জুলাই/এজেড)