জগজিৎ সিংয়ের গজলের ভুবন

সৈয়দ রশিদ আলম
| আপডেট : ০১ আগস্ট ২০১৮, ১৩:৪৫ | প্রকাশিত : ০১ আগস্ট ২০১৮, ১২:১৯

উপমহাদেশে যেসব গজল শিল্পী নিজস্ব ভঙ্গিমায় গজল পরিবেশন করে আলাদা শ্রেণির দর্শক তৈরি করতে পেরেছিলেন এদের অন্যতম হলেন পাঞ্জাবের জগজিৎ সিং। যদিও তার জন্ম রাজস্থানে। তারপর ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সত্তর দশকের দিকে তিনি বম্বে (বর্তমান মুম্বাই) চলে আসেন। এখানে এসে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গজল পরিবেশন করতেন। একপর্যায়ে আকাশ বাণী ও দূরদর্শনে তিনি গজল পরিবেশন করে ভারতীয় গজলপ্রেমীদের কাছে পরিচিতি লাভ করেন। এরপর বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দেন। তার ভরাট কণ্ঠ গজলকে নতুন মাত্রা দেয়।

জীবনের একপর্যায়ে এসে বাঙালি রমণী চিত্রা সিংকে বিয়ে করেন জগজিৎ। এরপর এক সাথেই এই দম্পতি গজল পরিবেশন করতে থাকেন। গজল গাওয়ার আগে তিনি বিখ্যাত শায়ের অর্থাৎ গজল লেখকদের লেখাগুলো থেকে সেরা লেখাগুলোর কণ্ঠ দান করেন। প্রথম দিকে তিনি কবি আমির মিনাইর লেখা সারাকতি জায়ে হায় রুখসে নাকাব গজল পরিবেশন করে সবার মনোযোগ কেড়ে নেন। এই গজলের বাংলা অর্থ হচ্ছে, হে প্রেয়সী মুখ থেকে কাপড়টা সরিয়ে নাও, আস্তে আস্তে। প্রেমসাগরে যারা অবগাহন করেছেন তাদের অন্তরে এই গজলটি চিরদিনের জন্য বসে গেছে।

এরপর তিনি রানা আকবরাবাদির লেখা ‘শুনতে হায় কে মিল জাতি হায় হারচিজ দোয়াছে’ গেয়েছিলেন। এই গজলটির পুরো বাংলা অর্থ হচ্ছে- ‘শুনেছি, দোয়ার মাধ্যমে সব কিছু পাওয়া যায়/ একদিন দোয়ার মাধ্যমে তোমাকেও চাইবো/ দুনিয়াও পেয়েছি, দুঃখের দুনিয়াও পেয়েছি/ তাকে পাইনি, যার জন্য প্রভুর কাছে দোয়া করেছিলাম/ তুমি সামনে বসে আছো আমার চোখে বর্ষাকাল/ এমন এক সময় ছিল যখন বর্ষা হতো বর্ষাকালে/ আয়নাতে তোমায় দেখতে পাই/ আমি মরে যাবো নাকি ধ্বংস হয়ে যাব, তোমারই দোয়াতে।’ এই গজলটি শোনার পর যাদের হৃদয়ে বিন্দু পরিমাণ ভালোলাগা বা ভালোবাসা আছে তারা চোখের জলে ভাসতে থাকেন।

প্রথম দিকে যখন জগজিৎ সিং এই গজল পরিবেশন করেন তখন তিনিও চোখের জলে ভেসে গিয়েছিলেন। তার আরেকটি বিখ্যাত গজল হচ্ছে, ‘মেরে জ্যাছে বানজাওগে যাব ইসক তুমে হোজায়গা।’ এই গজলের বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘আমার মতো তুমিও হয়ে যাবে/ যখন তোমার জীবনে ভালোবাসা চলে আসবে/ যখন হাঁটতে থাকবে হঠাৎ করে দরজার সাথে ধাক্কা খেয়ে যাবে/ একসময় হাতে তাবিজও পরবে, নিঃসঙ্গতায় যখন ভুগতে থাকবে/ তখন প্রিয়জনকে মনে পড়ে যাবে, যন্ত্রণা যখন বেড়ে যাবে/ তখন আমার মতো তুমিও গজল গাইতে থাকবে।’ তার আরেকটি বিখ্যাত গজল হচ্ছে ‘তুম নাহি গাম নাহি, সারাব নাহি।’ এই গজলের বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘তুমি নেই, দুঃখ নেই সরাবও নেই/ এমন দুঃখের কোনো তুলনাও নেই/ তুমি হাতের আঙুলে গুনে দুঃখ গুনতে থাকো/ দুঃখের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।’ এই গজলটি জগজিৎ সিংয়ের জীবনের অন্যতম সেরা গজল।

তার আরেকটি বিখ্যাত গজল হচ্ছে ‘আপকো দেখকার দেখতা রাহেগেয়া।’ এই গজলের বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘আপনাকে দেখতেই থাকলাম, দেখতেই থাকলাম/ কি বলবো বলার যে আর কিছুই নেই/ আপনি আমার সামনে দিয়ে চলে গেলেন কিছুই বলতে পারলাম না।’ এই যন্ত্রণাময় গজল যারা শুনেছেন তারা প্রত্যেকই চোখের কোণায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু জল মুছতে বাধ্য হয়েছেন। প্রিয়জনকে পাওয়া তার পর সেই প্রিয়জনকে হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা একমাত্র গজলেই বোঝানো সম্ভব হয়।

বিশ্বখ্যাত গজল লেখক ওমর খৈয়াম, মির্জা গালিব, আহমেদ ফারাজ, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজসহ একাধিক গজল লেখক এসব যন্ত্রণার কথা তাদের গজলে বর্ণনা করেছেন। আর এই কথাগুলোতে কণ্ঠ দিয়ে জগজিৎ সিং গজলকে চূড়ান্ত জনপ্রিয়তায় পৌঁছে দিয়েছেন। যারা গজল শুনতে চাইতেন না তারা সবকিছু ভুলে আবার গজলের ভুবনে ফিরে এসেছেন শুধু জগজিৎ সিংয়ের কারণে। তার গজল শুনে প্রত্যেকের মনে হতো এই গজলটি মনে হয় আমার জন্যই গাওয়া হচ্ছে। প্রত্যেকটা মানুষের বুকের মধ্যে যে না পাওয়ার যন্ত্রণা এবং হাহাকার থেকে যায় সেটাকেই জগজিৎ সিং গজলের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশে এই মহান শিল্পী যখন এসেছিলেন তখন সুযোগ পেয়েছিলাম তার গজল শোনার। অন্য দর্শক-শ্রোতাদের মতো এক পর্যায়ে লক্ষ্য করলাম আমার চোখের পাতাও ভিজে যাচ্ছে, কৃতিত্ব সেই জগজিৎ সিংয়ের। তিনি গজল গাইতে গিয়ে নিজে যেমন নিজের চোখ ভিজিয়ে ফেলতেন তেমনি অন্যের চোখকেও ভিজিয়ে দিতেন। কারণ গজল এমন এক সংগীত যা আপনাকে আপনার ভালো লাগা, ভালোবাসার মানুষকে সামনে নিয়ে আসবে। শারীরিকভাবে জগজিৎ সিং আমাদের মাঝে আর নেই কিন্তু অনন্তকাল গজলপ্রেমীদের হৃদয়ে তিনি থাকবেন। প্রেম-ভালোবাসার কথা যখনই বলা হবে, খেলা হবে ঠিক তখনই। জগজিৎ সিংয়ের গজলের কথাও সামনে চলে আসবে। এটাই একজন গজল শিল্পীর সার্থকতা। তিনি যথার্থই বলেছেনÑ কে বলেছে আমি জগজিৎ সিং থাকব না, অনন্তকাল আমি গজলপ্রেমীদের অন্তরে থাকবই।

সৈয়দ রশিদ আলম: গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিনোদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিনোদন এর সর্বশেষ

২৩ এপ্রিলকে চলচ্চিত্রের কালো দিবস ঘোষণা

সুচিত্রা সেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘মাইক’ পুরস্কৃত

এফডিসিতে সাংবাদিকদের মারধর: লজ্জিত রিয়াজ, জানিয়েছেন নিন্দা

সাংবাদিকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এফডিসির সামনে মানববন্ধন

ভারতে ‘পদ্মশ্রী’ পেলেন বাংলাদেশের রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী বন্যা

শিশুশিল্পী উধাও, পুরস্কারের জন্য খুঁজছেন পরিচালক নূরুজ্জামান

সাংবাদিকদের মারধর: শিল্পী সমিতিকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম

নির্বাচিত হয়েই হিন্দি সিনেমা আমদানির বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিলেন ডিপজল

‘আম্মাজান’ সুপারহিট হওয়ার পরও কেন সিনেমা ছাড়লেন শবনম?

এফডিসিতে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, দুঃখ প্রকাশ করে যা বললেন মিশা-ডিপজল

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :