সিঙ্গেল বেড
“একটা সিঙ্গেল বেডের স্বপ্ন দেখেছি সারাজীবন। আহা।’’
বিছানায় শুয়ে থেকেই বলে উঠলেন মাহবুব সাহেব।
-সিঙ্গেল বেড নিয়ে আবার এত সারাজীবন স্বপ্ন দেখার কি আছে! কি এমন বাঘ-ভল্লুক!
“ আছে রে ভাই। আপনারা লেখক হলেই নিজেদেরকে সবজান্তা মনে করেন ক্যান? আগে শুনবেন তো আমার কাহিনীটা”
আমি থেমে যাই। আমার তৈরি চরিত্র মাহবুব হাসানের মুখ থেকে শুনতে থাকি তার দুর্লভ সিঙ্গেল বেডের কাহিনী...।
জন্মটা হয়েছিল আমার প্রাইভেট এক হাসপাতালে। জীবনের শুরুর মুহূর্তে তাই নবজাতকদের জন্য রাখা ছোট্ট ছোট্ট বেডগুলোর একটা তো আমার পাওয়ার কথা ছিল।
কপাল এতটা ভাল না আমার। জন্মটাও একা হয় নি আমার। সাথে ছিল জমজ ভাই মাহতাব। তিন মিনিট আগে-পরে। তাও যদি তিন মিনিট আগে জন্মাতাম…
জন্মালাম মাহতাবের তিন মিনিট পর। জন্মের শুরুর সময়টাতেই ভাগাভাগি করে নিতে হল বিছানা।
মাহতাব আর আমার ছেলেবেলা থেকেই দারুন ভাব ছিল। ঝগড়াও করতাম কম না। এত টানের মাঝেও মনে মনে ভাবতাম, ইস! আমার যদি নিজের একটা সিঙ্গেল বেড থাকতো!
আমি তো শুধু একটা সিঙ্গেল বেড চেয়েছিলাম। আমাদের বিছানাটা শূণ্য হয়ে যাক তা তো চাই নি কখনো! সত্যি চাই নি। বিশ্বাস করুন। তিনদিনের প্রচন্ড জ্বরে মাহতাব আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেল।
মাহতাবের মৃত্যুটাকে ৬ বছর বয়সী আমার মেনে নেয়াটা স্বপ্নেরও বাইরে ছিল। কেঁদেছি আর কেঁদেছি। ভাইটা আমার চলে যাওয়ার পর বাবা-মা আর এক মুহূর্তেও চোখের আড়াল রাখতে চাইতেন না আমাকে। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত বাবা-মায়ের ঘরেই আমার দিন-রাত সব কাটতে থাকে। লেখা-পড়া, ঘুম সব।
হঠাৎ একদিন রাতে ঘুম ভেঙ্গে চুপিচুপি বাবা-মায়ের আলাপ শুনে ফেলি। আলোচনার বিষয়: আমি একটু বড় হয়েছি, আলাদা থাকার যায়গা দরকার….
ছেলেবেলার স্বপ্নটা আাবার মাথা-চাড়া দিয়ে ওঠে। নিজের একটা সিঙ্গেল বেড হবে। বেডের মাথার কাছে থাকবে একগাদা সুপারম্যান আর ক্রিকেটারদের স্টিকার আর একটা ছোট্ট বেডলাইট। চিন্তা করতে করতেই ঘুমে হারাই।
পরদিন স্কুলে গিয়ে স্যারের লেকচারের মাঝেই খাতায় এঁকে ফেলি আমার বেডের ছবি। সিঙ্গেল বেডের ছবি।
বাসায় ফিরে দেখি রুম ধোঁয়া-মোছা চলছে। খুশি হওয়ার বদলে মনটা ভারী হয়ে উঠলো। রুমের এক কোণায় বসে মাহতাবের একটা জামায় মুখ গুজে কাঁদছে মা। মন বললো, আজ না। মায়ের আজকে বড় দরকার আমাকে।
রাতে মা-বাবার সাথে ঘুমাতে গেলাম ঠিকই, মন পড়ে রইলো পাশের ঘরটাতে। একটাই তো রাত…
পরদিন স্কুলে আর মন বসছিল না কোনমতেই। স্কুল থেকে বাসায় ফেরা পর্যন্ত কম করে শত রকমের পরিকল্পণা আঁকলাম মনে মনে। বাসায় ফিরতেই উধাও হলো ওসবের সবটুকু। ঘরে ঢুকেই দেখি বিছানায় একটা লুঙ্গি আর গামছা রাখা। আকাশ থেকে পড়লাম। সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম।
“মা। ও মা। আমার রুমে এগুলো কার জিনিষপত্র”
-ও। তুই তো জানিস না। তোর মতি কাকা এসেছে গ্রাম থেকে। মামলার কাজে। আজকের রাতটা থেকেই চলে যাবে।
আর কত অপেক্ষা করবো আমি! তারপরও ভাবলাম আজকের রাতটাই তো। কে জানতো রাতটা যে এত দীর্ঘ হবে! সারারাত ভর মতি কাকার … কি ভাবছেন নাক ডাকা? ওটাতো কমন। মতি কাকা ঘুমের মধ্যে কথা বলে। একবার নয় বারবার। ফুটবলের গোল থেকে মাছের ঝোল সব টপিকে চলছে কথা…
জীবনটাকে বিস্বাদ মনে হয় এক রাতেই। অপেক্ষা করতে থাকি কখন রাত ফুরোবে?
রাত আর ফুরোয় না। একদিন থেকে এক সপ্তাহ… এক মাস। এরপর হিসেব ছেড়ে দিয়েছি। মামলাও চলতে থাকে। মতি কাকাও রয়ে যায়। আমার সিঙ্গেল বেডের “সঙ্গী” হয়ে।
স্কুল পেরিয়ে কলেজে আমি। নিজেকে গরীব মনে হয়। বন্ধুদের মধ্যে যাদের একটা কোলবালিশ আছে তাদের আমি বলি মধ্যবিত্ত। আর যাদের সিঙ্গেল বেড আছে…তারা ধনী।
মতি কাকা আজ চলে যাচ্ছে গ্রামে। মামলায় হারা কমপ্লিট। কাকতালীয় বটে। আমিও বাসা ছাড়ছি আজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে যাচ্ছি। চোখে আবারও লাগলো সিঙ্গেল বেডের স্বপ্ন। এবার নিশ্চিত…
কে জানি বলেছিল, “Life is not a bed of roses”? যেই বলুক, তার সত্যতার প্রমান পেলাম হলে গিয়ে। গণরুমে এক তোষকে তিনজন। মতি কাকাকে বড় মিস করছি। তবুতো একজন কম ছিল বাসায়!
একটা উপকার ঠিকই হলো। গণরুমে পেলাম বন্ধুত্বের আসল স্বাদ। গণরুম ছাড়লাম সেকেন্ড ইয়ারে, তবে রুমেও ডাবলিং।
থার্ড ইয়ারে দুম করে বিয়ে করে বসলাম। লিসা। আমার জীবনের বড় যত্নের অর্জন। এই প্রথম সিঙ্গেল বেডের ভুত মাথা থেকে নামলো। চাইলাম, জীবনে যেন একরাতও একা ঘুমাতে না হয়।
আমার চাওয়া….২০ বছরের সংসারের পর হঠাৎ একরাতে লিসার নিথর দেহ পড়ে রইল আমার পাশে।কি অভিমানে স্বেচ্ছায় চলে গেলে জানতেও পারলাম না। সে রাতের আর কিছু মনে পড়ে না।
চোখ মেললাম হাসপাতালের বেডে। মা-বাবা-মাহতাব-লিসা…. কেউ নেই। কেউ না। জীবনে প্রথমবারের মতো সিঙ্গেল বেডে। হাসপাতালে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে নড়াচড়ার পাট চুকেছে সেই কবে। স্বপ্নের সিঙ্গেল বেড এখন আতঙ্ক।
“আমি সঙ্গী চাই। একাকীত্বে আমার বড় ভয়, ভাই।টাকা-টাকা। টাকার পাগল আমরা। টাকা দিয়ে সারাজীবন পরে এসে হাসপাতালের একটা সিঙ্গেল বেড কিনলাম।কই সুখ তো কেনা হলো না।স্বপ্ন কেনা হলো না”
আমার চোখটা ভিজে উঠেছে। কিছু বলতে পারি না। হাসপাতালের কেবিন থেকে বের হওয়ার আগে মাহবুব সাহেবের শেষ কথাটা ভুলতে পারি নি আজও….
“আমার এক্ষনি সিঙ্গেল বেড চাই। লিসার পাশে। মাটির বুকে।“
বিক্রয় ডট কমে মাহবুব সাহেবের ছেলে রননের একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম আজ সকালে….
:একটা সিঙ্গেল খাট বিক্রি হবে। এন্টিক। সেগুন কাঠের তৈরি। দাম: আলোচনা সাপেক্ষে। বি.দ্র. বিদেশ যাওয়ার আগে জরুরী বিক্রি করতে চাই।:
“ওপারে ভাল থাকবেন,মাহবুব সাহেব’’।