গোপন ক্যামেরার ভয়ংকর ভিডিও’র ফাঁদে নারীরা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৫ আগস্ট ২০১৮, ১৭:৫৮

বন্ধুর সঙ্গে মোটরবাইকে করে সিউলে পৌঁছে হ্যান নদীর পাশে একটি পাবলিক টয়লেটে ঢুকেছিলেন বিবিসি সংবাদদাতা লরা বাইকার। এসময় তার বন্ধু বাইরে থেকে জোরে বলেছিলেন, ভেতরে কোনো লুকোনো ক্যামেরা আছে কি না তা পরীক্ষা করে নিও।

কথা শুনে প্রথমে হাসি পেলেও মিজ লরা পরে বুঝেছিলেন, বিষয়টি মোটেও রসিকতা নয়। কেননা পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার বহু নারীর কাছে তিনি শুনেছেন, তারা যখন কোনো পাবলিক টয়লেটে যান তখন শুরুতেই খুঁজে দেখেন সেখানে কোনো লুকিয়ে দেখার মতো ছিদ্র কিংবা কোনো গোপন ক্যামেরা লুকোনো রয়েছে কি না!

কেননা পুরো দেশটিতে গোপন ক্যামেরার এই সমস্যা ছড়িয়ে পড়েছে মহামারীর মতো। লুকোনো ক্যামেরার শিকার হয় সাধারণত নারীরাই, কখনো পুরুষরাও।

টয়লেট, পোশাকের দোকানে কাপড় বদলানোর ঘর, জিমনেশিয়াম, সুইমিং পুল- এসব স্থানেই 'স্পাই ক্যামেরা'য় ভিডিও ধারণ করা হয়। এরপর সেসব ভিডিও ছেড়ে দেয়া হয় কোনো না কোনো পর্নোগ্রাফির ওয়েবসাইটে।

এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীরা বলছেন, সিউলে বাড়তে থাকা এধরনের অপরাধ যদি অচিরেই নিয়ন্ত্রণে না আনা যায় তবে তা অন্যান্য দেশেও একইভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর তখন সেটি প্রতিকার করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে।

দেশটির পুলিশের কাছে বছরে প্রায় ছয় হাজার এ ধরনের অপরাধের অভিযোগ আসে, যার শিকার শতকরা ৮০ জনই নারী। আর তার চেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো বেশিরভাগ নারীই এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে আর মুখ খোলেন না।

তারা অনেকেই মনে করেন তাদের কাছের বন্ধুরাই গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করে তাদের দৃশ্য ধারণ করেছে। এমন একজন নারী জানান, একটি রেস্টুরেন্টে টেবিলের নিচ থেকে তার দিকে একটি ক্যামেরা তাক করা হয়েছিল।

একজন পুরুষ তার স্কার্টের নিচের দিকে ছোট্ট ক্যামেরাটি রাখে। কিম (ছদ্মনাম) তাকে ধরে ফেলে, তার ফোনটি কেড়ে নিয়ে তল্লাশি চালায় যে সেখানে তার আর কোনো ভিডিও আছে কি না। তিনি বলেন, 'যখন আমি ফোন পরীক্ষা করতে শুরু করলাম তখন আমি চমকে গেলাম, আমার মনের ভেতর সবকিছু যেন হারিয়ে গেল আর আমি কাঁদতে শুরু করলাম।'

কিম এরপর পুলিশের কাছে যায় আর সেখানে গিয়ে যেন তিনি আরও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। 'আমার মনে হলো, অন্য সবাই কী ভাবছে আমাকে দেখে? পুলিশ অফিসারটি কী মনে করছে যে আমার স্কার্টের ঝুল কম, আমাকে কি সস্তা ভাবছে?'

কিম বলছিলেন যে, পুলিশ স্টেশনেই সে যেন ভীষণ একাকীত্বে ভুগতে শুরু করে। তার মনে হচ্ছিল সবাই যেন তাকে এক যৌন বিষয় হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। কিম এরপর কারো কাছেই আর অভিযোগ করেনি। তার পরিবার, বন্ধু কিংবা কোনো মানুষের কাছেই নয়। সেই লোকটি কখনোই আর শাস্তি পায়নি।

এটি কেবল কোরিয়ার সমস্যা নয়। প্রযুক্তিগত ভাবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর একটি হল কোরিয়া, একইসাথে ডিজিটাল সংযুক্তিতেও এগিয়ে।

স্মার্ট ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখানে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৯০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্করই রয়েছে স্মার্ট ফোন এবং অন্তত ৯৩ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এই প্রযুক্তিগত অগ্রগতিই এ ধরনের অপরাধীকে শনাক্ত করতে বা ধরতে কঠিন করে তুলেছে।

২০১৫ সালে ডিজিটাল সেক্স ক্রাইম আউট নামে একটি গ্রুপ তৈরি করা হয় যার নাম হা ইনা, আর এটি তৈরি করেন পার্ক সো-ইয়ুন। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল কুখ্যাত 'সোরানেট' নামের একটি ওয়েবসাইটকে ধ্বংস করা।

এই সাইটে নারীদের কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই তাদের হাজার হাজার ভিডিও আপলোড এবং শেয়ার করা হতো, আর যার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল লাখ লাখ।

সেখানে গোপন ক্যামেরার ভিডিওগুলোর বেশিরভাগই ছিল পোশাক বদলানোর রুম বা টয়লেট থেকে ধারণ করা অথবা কোনো সাবেক প্রেমিকের তোলা ভিডিও যা প্রতিশোধ হিসেবে ওই ওয়েব সাইটে দিয়ে দেয়া হতো। সেসব ঘটনার শিকার অনেক নারীকে এমনকি আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নিতে হয়েছে।

পার্ক এর মতে এসব ভিডিও কোনো একটি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে দেবার পরেও অন্য কোনো পর্নোসাইটে আবার হয়তো আপলোড করা হতো কিংবা তা শেয়ার করার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তো।

এগুলো ছড়িয়ে দেয়ার কাজ যারা করে, তাদের শনাক্ত করা বা ধরা সত্যিই কঠিন। পার্ক সো ইয়ুনের তেমনই অভিজ্ঞতা। তার মতে এটিকে থামাতে আন্তর্জাতিক তৎপরতার প্রয়োজন।

পার্ক বলেন, 'ডিজিটাল সেক্স ক্রাইম কেবল কোরিয়ার একক সমস্যা নয়। একইধরনের সমস্যা রয়েছে সুইডেন এবং যুক্তরাষ্ট্রেও। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া এটি অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এর অতি উন্নত প্রযুক্তি এবং বিশ্বের দ্রুততম ইন্টারনেটের জন্যে। তার অর্থ নারীর বিরুদ্ধে এমন অনলাইন অপরাধ এখানে হয়তো প্রথম ঘটছে। কিন্তু এটি এরপর অন্যসব দেশের জন্যেও বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে। সুতরাং এই সমস্যা আন্তর্জাতিকভাবে মোকাবিলা করা দরকার।'

দক্ষিণ কোরিয়ার পুলিশের এ ক্ষেত্রে দুটি মৌলিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। একটি হলো অপরাধী ধরা এবং এরপর তাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করা। পুরো সিউল জুড়েই এমন গোপন ক্যামেরা খুঁজে বের করতে পুলিশের বিশেষ ইউনিট কাজ করেছে। কিন্তু তারা কখনও সেসব খুঁজে পায়নি।

ইন্সপেক্টর পার্ক গোয়াং-মি দুই বছর ধরে শহরের ইয়ংসান অঞ্চলে অন্তত দেড় হাজার পাবলিক টয়লেটে অভিযান চালিয়েছে গোপন ক্যামেরার খোঁজে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসিও তার সঙ্গে অভিযানে অংশ নিয়েছিল। দেয়ালের প্রায় প্রতিটি ফুটোই তিনি খুঁজে দেখে ব্যর্থ হয়েছেন।

মিজ গোয়াং-মি'র মতে এসব অপরাধীদের ধরা খুবই কঠিন। কেননা ক্যামেরা সেট করার ১৫ মিনিটের মধ্যেই অপরাধীরা সেটি সরিয়ে ফেলে।

গত বছর ছয় হাজার ৪৬৫টি মামলা হয় এ বিষয়ে আর তার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেপ্তার করা হয় পাঁচ হাজার ৪৩৭ জনকে। কিন্তু অপরাধ প্রমাণ করে জেলে নেয়া গেছে ১১৯ জনকে, যা হলো আটককৃতের মাত্র ২ শতাংশ।

অনেক দক্ষিণ কোরীয় নারীই মনে করছেন যে তারা সুবিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গত সপ্তাহান্তে সিউল এক বিশাল প্রতিবাদে অংশ নেন বহু নারী। 'আমার জীবন তোমার পর্ণ এর অংশ নয়' এমন প্ল্যাকার্ড হাতে তাদের অংশ নিতে দেখা যায়।

পুলিশি তৎপরতার পরও সময়ের সাথে সাথে অপরাধীরা বদলে ফেলছে তাদের কৌশল, উন্নত করছে তাদের প্রযুক্তি। এমনটাই বলছেন সিউল পুলিশের বিশেষ সেক্স ক্রাইম ইনভেস্টিগেটর ইউনিটের প্রধান পার্ক মি-হেই।

তার মতে অপরাধীরা যখন বিদেশি সার্ভার ব্যবহার করে এসব ভিডিও ওয়েবসাইটে ছড়িয়ে দেবার জন্যে, তখন তাদের শনাক্ত করা বা ধরা বা সেসব ভিডিও নষ্ট করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি কোনো কোনো ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেবার পর পুনরায় অপরাধীরা অন্য কোনো সার্ভার থেকে তা চালু করে।

পুলিশের এই কর্মকর্তার মতে, এই ধরনের অপরাধের শাস্তির মাত্রাও বাড়ানো উচিত। বর্তমানে দেশটিতে এই অপরাধের শাস্তি এক বছরের জেল কিংবা ১০ মিলিয়ন স্থানীয় মুদ্রা, যার পরিমাণ হলো আট হাজার ৯০০ মার্কিন ডলার। তবে শাস্তির মাত্রা বাড়ানোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, প্রয়োজন নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন। সূত্র: বিবিসি

(ঢাকাটাইমস/০৫আগস্ট/একে/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

নারীমেলা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা