খৈকড়া বিলের অপার সৌন্দর্যে একদিন

প্রকাশ | ০৬ আগস্ট ২০১৮, ০৮:৩৫

সাদ্দাম হোসেন

খৈকড়া বিল। গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের বৃহৎ এলাকাজুড়ে বিলটি বিস্তৃত। বিলের কোলঘেঁষেই খৈকড়া গ্রাম। গ্রামটি অনেক বড়। টঙ্গী স্টেশন রোড থেকে বাস বা লেগুনাযোগে কালীগঞ্জ যাওয়ার পথে কাপাসিয়া মোড়ে নামতে হয়। সেখান থেকে পঞ্চাশ টাকার রিকশা ভাড়ায় চলে যাওয়া যায় খৈকড়া গ্রামে। পিচের সরু একটি রাস্তা খৈকড়া বিল ও গ্রামের মধ্যে সীমারেখা টেনে দিয়েছে। গ্রামের বাড়িগুলো এতটাই রাস্তা ঘেঁষে তৈরি, বাড়ির ভেতর থেকে প্রধান ফটক পেরিয়ে কেউ জল্‌দি পায়ে রাস্তায় আসার চেষ্টা করলেই তিনি পথচারী কিংবা রিকশা-ভ্যানের ওপর মুখ থুবড়ে পড়বেন।

রাস্তা ধরে হাঁটছি। মুরব্বিগোছের কারো সামনে পড়লেই আমাদের থামাচ্ছেন: বাবা, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। এর আগে তো কখনো দেখিনি। ওহ্‌, বেড়াতে এসেছেন? ঢাকা থেকে? আচ্ছা, ঠিক আছে, বেড়ান। কথা বলতে আমার ভালোই লাগছে। বয়সের ভাড়ে সামনে নুইয়ে পড়েছেন এমন একজন বৃদ্ধের সামনে পড়তেই ডান হাত তুলে তিনি আমাদের থামার ইঙ্গিত দিলেন- আপনার বাবার নাম কী? জ্বি, আমার বাবার নাম অমুক, বাড়ি অমুক জায়গায়। ফাহাদ বললো- চাচা মিয়া, উনাকে চিনবেন না; উনি ঢাকা থেকে এসেছেন। এরপর চাচা বাজার থেকে কী কী কিনেছেন তার হিসেব দেওয়া শুরু করলেন। আমিও মনোযোগ সহকারে শুনলাম। বুঝতে পারলাম, বাড়িতে তার কথা শোনার মানুষ নেই।

ফাহাদ আমার পরিচিত। খৈকড়া গ্রামেই তার বাড়ি। ঢাকার উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে সে লেখাপড়া করে। আমি আর ফাহাদ খুব মুশকিলের মধ্যে আছি। বিলের ধারে নৌকা আছে তো নৌকার মালিক নেই। আবার নৌকা ও মালিক উভয়ই আছে, কিন্তু নৌকা খালি নেই। মালভর্তি বস্তা দিয়ে পুরো নৌকা সাজানো। কী যে করি! আমরাও নাছোড়বান্দা। এতো সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র আমরা নই। কিছু দূর এগুতেই, দেখি মোটা একটি গাছের গুঁড়ির সাথে, লোহার শিকলে তালা দিয়ে বেঁধে রাখা একটি নৌকা। উজ্জ্বল রঙের নৌকাটি সূর্যের আলোয় খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। নৌকার অদূরেই একজন মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে সালাম দিলাম। বললাম- ভাই, আমি ঢাকা থেকে এসেছি। নৌকায় চড়ার আমার খুব শখ। আমি কি ওই নৌকাটিতে কিছুক্ষণ চড়তে পারি? আমার চোখ ও মুখের অভিব্যক্তি এমন ছিল যে একটি কুমিরও আমার এই ভঙ্গিতে অনুরোধ শুনে কেঁদে ফেলতো। অনুরোধ ব্যর্থ হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। তিনি রাজি হলেন এবং জানালেন নৌকাটি তাদের। বললাম, তাহলে আমি কখন আসবো।

তিনি বললেন, এখনই চড়তে পারবেন। বলেই লোকটি বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। কিছুক্ষণ পর সঙ্গে একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি ও দুই কিশোরকে নিয়ে এলেন। এরা আমাদের সাথে নৌকায় উঠবে। শিকল খুলে নৌকার ওপর আমরা পাঁচজন উঠলাম। প্রথমে একটু কাঁপলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারলাম। শেওলা আর কচুরিপানা ভেদ করে আমদের নৌকা সামনে এগুচ্ছে। নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্যই নৌকাটি বানিয়েছেন অকিল উদ্দিন। ষাট হাজার টাকা খরচ করেছেন। বড় ছেলের শখ, এরকম একটি নৌকা বানাতে হবে। বিদেশ থেকে ছেলে টাকা পাঠিয়েছে। অকিল উদ্দিন গজারি গাছের কাঠ কিনে নিজের তত্ত্বাবধানে সে কাঠ চেরাই করে মিস্ত্রি দিয়ে নৌকাটি বানিয়েছেন। তিনিই আমাদের প্রধান বৈঠাচালনাকারী। অকিল উদ্দিনের ছোট ছেলে শিপন এবং ভাতিজা নাদিম-তারাও ভালো বৈঠা বাচ্ছে। দুজনেই স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। গল্প করছি, আর নৌকা এগুচ্ছে।

অকিল উদ্দিন জানালেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে বর্ষা মৌসুমে এখানে মানুষ বেড়াতে আসে। নৌকায় বনভোজন করে। যে কেউ এই বিলে মাছও ধরতে পারে। কোনো বাধা-নিষেধ নেই। দিনে এসে দিনেই তারা ফিরে যায়। আমাদের নৌকাটি বিলের ওপাড়ে গিয়ে আবার ফিরে আসতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। আমাদের হাতে এতো সময় নেই। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বিলের মাঝ খান থেকেই নৌকার গতিপথ পরিবর্তন করা হলো। খৈকড়া গ্রামের দিকে আমাদের নৌকা ফেরার পথে। বিলের ঠিক মাঝখান দিয়ে নলীখাল প্রবাহিত। খালের মাঝখান দিয়েই নৌকা দৌড়াচ্ছে। পানির গভীরতা প্রায় পাঁচ হাত। পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে শেওলা। বাতাসে দুলছে কচুরিপানা আর শাপলা ফুলের দল। আমাদের নৌকাও বৈঠার তালে তালে দুলছে। মনে পড়ছে আপেল মাহমুদের অসীম অনুপ্রেরণা জোগানো সেই বিখ্যাত গান- ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে’। মনে পড়ছে ন্যায্য দাবিতে কিশোর-তরুণদের আন্দোলনের কথা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে যে তরুণ-কিশোররা আজ রাস্তায় নেমেছে, চোখে আঙুল দিয়ে বড়দের ব্যর্থতা উন্মোচন করছে; ধর্ম আর চেতনা ব্যবসার ওপর যারা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে, তারা কি পারবে রাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের জঞ্জালের পাহাড় পরিষ্কার করতে। অনিয়ম-দুর্নীতি, ঘুষ, স্বজনপ্রীতি, কালোবাজারি, প্রশ্নফাঁস, খাদ্যে ভেজাল, পরিবেশ দূষণ, জমি দখল, সরকারি অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ, মাদকের থাবা, অন্যায়, অবিচার, অসাম্য- কত যে জঞ্জাল জমেছে বাংলাদেশের বুকে! দেশ-মাতৃকা তো আজ এই তরুণ-কিশোরদের মুখের দিকেই চেয়ে আছে। তারাই ভরসা। তরুণরা শুধু চলতে জানে। ন্যায্য দাবি আদায়ে রক্ত দেবে, জীবন দেবে; লাভ-ক্ষতির হিসেব তাদের জানা নেই। কিশোর-তরুণদের পবিত্র আন্দোলনে আমাদের বড়দের না যাওয়াই তাদের জন্য মঙ্গলজনক। আমরা বড়রা তো পচে গেছি। সবজায়গায় সুযোগসন্ধানীর ভূমিকা পালন করি। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় তরুণরা আজ তরীর বৈঠা হাতে নিয়েছে।

বিলের মধ্যে চারদিকে আরও অনেক নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে। নৌকায় বসে জাল দিয়ে অনেকের মাছ ধরার দৃশ্য চোখে পড়ছে। আচ্ছা, এরা সবাই কি জানে, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম আজ অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রাজপথে নেমেছে। সবাই কি বুঝতে পারছে, যুক্তির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এ প্রজন্মের কাছে ধর্ম আর চেতনা বিক্রি সহজ হবে না। সূর্য তেজ হারিয়ে দূরের গ্রামের পেছনে মুখ লুকাচ্ছে। আমাদের নৌকাও ভিড়েছে খৈকড়া গ্রামে। চমৎকার একটি ভ্রমণ শেষে সঙ্গীদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

অকিল উদ্দিন জানালেন, কোরবানির ঈদের দুইদিন পর তাদের নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। আমাকে আমন্ত্রণ করবেন বলে অগ্রিম জানিয়ে রাখলেন। বসত-বাড়ি, গাছ-গাছালি আর ধইঞ্চার ক্ষেতের পাশ দিয়ে আাঁকা-বাঁকা সরু পথ। লম্বা পায়ে হেঁটে যাচ্ছি বাড়ির দিকে। আকাশে অনেক মেঘ, যেকোনো মুহূর্তে খৈকড়া গ্রামে নেমে আসতে পারে অঝোর বৃষ্টি।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়