‘কোমলমতি’দের আন্দোলন কি কোনো পরিবর্তন আনতে পেরেছে?

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ১০ আগস্ট ২০১৮, ১১:৩০

‘কোমলমতি’ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং আন্দোলন-কেন্দ্রিক নৈরাজ্য ও সহিংসতা থেকে আমরা কি কোনো শিক্ষা নিয়েছি? ঢাকার রাস্তায় কি এখন আগের তুলনায় অধিক শৃঙ্খলা নজরে পড়ে? এত বড় আন্দোলন এবং একে উপজীব্য করে সৃষ্ট নৈরাজ্যের পরে কিছু পরিবর্তন আমরা আশা করতেই পারি। মানুষ হিসেবে নিশ্চয় বিশ্বে সবচেয়ে নিম্নমানের নই।

পরিবর্তন আমার কিছু কিছু চোখে পড়ছে। বিশাল জনসংখ্যার শহর ঢাকায় দেখা যাচ্ছে, ইদানিং ফুট ওভার ব্রিজের উপর জনজট তৈরি হচ্ছে। মানুষ আগের তুলনায় অধিক হারে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করছে। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে রাস্তা দিয়ে পাড় হতে গেলে, পুলিশ বাধা দিচ্ছে। তবে এ দৃশ্য শুধু সায়েন্স ল্যাবরেটরি, ফার্মগেট, উত্তরা এমন কয়েকটি জায়গার গুটিকয়েক সিগন্যালেই সীমাবদ্ধ। অধিকাংশ মানুষের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বিশেষ করে মোটর বাইক চালকদের একটা অংশ আগের মতই ফুটপাতের উপর বাইক উঠিয়ে দিচ্ছেন। সকালবেলা সন্তানকে বাইকে করে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সময়ও একদল বাবা নিয়মিত ফুটপাতে বাইক তুলে দিচ্ছেন। নিজে তো নিয়ম ভাঙাকেই নিয়ম করে নিয়েছেন, নিজ সন্তানকেও নিয়ম ভাঙা শেখাচ্ছেন এখন থেকেই। একসময় এই ‘কোমলমতি’ সন্তান বড় হবে, বড় বড় অন্যায় করতে শিখবে, নিজে নিয়ম না মেনে অন্যদের নিয়ম শেখাতে রাস্তায় নেমে নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে।

পুলিশকে নিয়ে অত্যন্ত আপত্তিজনক অপপ্রচার চলেছে আন্দোলন চলাকালীন সময়। ‘চ’ বর্গীয় অশালীন নানা শব্দ ব্যবহার করে প্ল্যাকার্ড লেখা হয়েছে, স্লোগান তোলা হয়েছে, পুলিশের ব্যবহৃত বাইক আগুন দিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার বানিয়ে চার রাস্তার মোড়ে প্রদর্শনীর জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে । কিছু ‘শিক্ষিত’ মানুষ আবার সেসব অশালীন শব্দের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। পুলিশ ধোঁয়া তুলসি পাতা নয়, যেমনটা আমরা কেউই নই। সরকারি চাকরি করেন, অথচ কখনো অনিয়ম করেননি বা অনিয়মের সাথে আপোষ করেননি, এমন বাংলাদেশি নাগরিক খুব কম পাওয়া যাবে। পুলিশ এই সমাজ বা ক্ষমতা কাঠামোর বাইরের কেউ নয়। পুলিশের যারা রাস্তাঘাটে ঘুষ খান বা অন্যান্য অনিয়ম করেন, তারা অন্যায় করেন কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একবার কি ভেবে দেখেছেন, কী জন্য অনিয়ম করে বাড়তি কামাই করার চেষ্টা করেন পুলিশ সদস্যটি। চাকরি নেয়ার সময় কোন পর্যায়ে কি সে কাউকে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছিল? সে কি কোনো রাজনীতিবিদ, আমলা বা তার বিভাগের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাকে দেয়া ঘুষের টাকা ম্যানেজ করার জন্য নিজের এক চিলতে জমি বন্ধক রেখেছিল, কিংবা মা বা স্ত্রীর সামান্য অলংকার বেঁচে দিয়েছিল?

দুর্নীতির মূলে না প্রবেশ করে পুরো বাংলাদেশ পুলিশের চরিত্র হননের কোনো অধিকার কি আমাদের আছে? এই আমরাই তো একটু লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা নিতে রাজি নই। পকেটে ঘুষের টাকা রেখে দালাল ধরে যেকোনো কাজ আগে আগে করার চেষ্টা কিন্তু আমরাই করি। সবাই অনিয়ম করবে, আর একা পুলিশ ভালো হয়ে যাবে, এটা ভাবতে যাওয়া পাপ ছাড়া কিছু নয়।

বিবিধ ‘দোষে দুষ্ট’ পুলিশই কিন্তু বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিশ্রম করা সরকারি দপ্তরের লোক। আমাদের এত দুর্নীতি, এত অন্যায়, অব্যবস্থাপনা আর নৈরাজ্যের বিপরীতে বাংলাদেশ পুলিশ ঢাকাসহ সারা দেশ সচল রেখেছে। যখন পেট্রোল বোমা মেরে, বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করছিল বিএনপি-জামাত জোট, তখন বাংলাদেশ পুলিশের সাহসী, নির্ঘুম পরিশ্রম আর আত্মত্যাগের কথা ভুলে গেলে বুঝতে হবে আমরা বেঈমান। ঢাকার রাস্তায় পুলিশের পরিশ্রম দেখে একবার যদি আমাদের মাথায় উন্নত বিশ্বের রাস্তার দৃশ্য আসত, তাহলে আমরা বুঝতাম বাংলাদেশের পুলিশ কী এক দঙ্গল সামলে চলেছে। পাবলিক যদি নিজে থেকেই সিগন্যাল মেনে চলত, তাহলে রাস্তায় পুলিশই লাগত না। যেমন সভ্য দুনিয়ায় রাস্তায় পুলিশ লাগে না খুব একটা। সিগন্যাল ভঙ করলে, স্পিড বেশি হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্যামেরায় ধরা পড়ে, মামলা কিংবা জরিমানা পত্রের কপি বাসায় চলে যায়। আর আমাদের ঢাকায়? পুলিশ নিজের জীবন হাতে নিয়ে সিগন্যাল বজায় রাখার চেষ্টা করে। দু হাত প্রসারিত করে মাঝ রাস্তায় পুলিশ সদস্যরা ঢাকাসহ অন্য শহরগুলোতে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে। মাঝে মাঝে নির্মমভাবে প্রাণহানি ঘটে পুলিশের। আমরা মনে করি, পুলিশ মারা গেছে, তাতে কী!

দেশে এত কিছু ডিজিটাল হচ্ছে, শহরের সিগন্যাল সিস্টেম ডিজিটাল হচ্ছে না কেন? রাত ১১/১২টার দিকে শাহবাগ মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালেই আমাদের প্রকৃত চেহারা দেখা যাবে। পুলিশ যখন চলে যায়, বা বিশ্রাম নিতে যায়, তখন ভয়াবহ অরাজকতা দেখা দেয়। ট্রাকের ড্রাইভার আর জিপের ড্রাইভারের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না; কে কার আগে যাবে সেই প্রতিযোগিতায় নামে। জ্যাম লেগে যায়, শাহবাগ থেকে এলিফেন্ট রোড পর্যন্ত সে জ্যাম চলে আসে; এটা প্রায় প্রতিদিনের দৃশ্য। আমরা নিজেরা কোনো আইন মানব না, আর পুলিশ সব আইন বাস্তবায়ন করে ফেলবে, এটা ভাবা কি অন্যায় নয়?

পুলিশ কিন্তু সব ক্ষেত্রে নিজ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ নয়। জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশ অত্যন্ত সফল। ইজতেমা, পহেলা বৈশাখ এবং এ জাতীয় বড় ইভেন্ট এর সময় পুলিশ যথেষ্ট সফলভাবে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে। এত মানুষের দেশে পুলিশ যেটুকু করতে পারছে, সেটি বিস্ময়কর বটে। হ্যাঁ, ভুয়া মামলা দিয়ে হয়রানি করা, মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার করা, মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া, এমন অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে অমূলক নয়। পুলিশ বিভাগ থেকে অসাধু পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায়। বাংলাদেশের পুলিশের কোনো দোষ নেই অথবা বাংলাদেশ পুলিশের ভালো কোনো দিক নেই, এমন উভয় ভাবনাই আমাদের সাজে না। পুলিশকে আরও আধুনিক ও সেবামুখী করতে হলে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এর প্রতিক্রিয়ায় পুলিশের মাঝেও অধিক সক্রিয়তা লক্ষ্য করা গেছে। অবৈধ চালক ও যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা আগের থেকে বেড়েছে দিগুণ। বিআরটিএর অফিসগুলোতে মানুষের ভিড় বেড়েছে। লাইসেন্স নবায়ন চলছে। কিন্তু এই চালকদের ভেতরে সবাই কি ভালো চালক? সবগুলো পরীক্ষা না নিয়েই তো অনেককে চালকের লাইসেন্স দিয়ে দেয়ার চর্চা বাংলাদেশে করা হয়। পুরো ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হলে সবগুলো বিভাগ, সব মানুষকেই বদলাতে হবে। নতুন প্রজন্মকে সুশৃঙ্খল করে বড় করতে হবে। সেজন্য স্কুল থেকেই পরিবর্তনের সূচনা করতে হবে।

ঢাকার রাস্তায় চালক আর শ্রমিকদের অমানবিক জীবন যাপনের দিকে কি আমাদের চোখ গেছে? কোনো বেতন নাই, ভাতা নাই, বিশ্রাম নাই, অনিশ্চিত জীবন তাদের। মালিকদের লোভ তাঁদের জীবনকে একটি নরক বানিয়ে রেখেছে। মালিকরা এখন বেতনের কথা বলেছেন, দেখা যাক কী হয়।

আন্দোলনের এক পর্যায়ে গুজব ছড়িয়ে সরকারপতনের আন্দোলনে নামে বিএনপি-জামাত-বাম জোট। আওয়ামী লীগ অফিস এবং বিডিআর সদর দপ্তরকে টার্গেট করে সহিংসতা ছড়ানোর চেষ্টা করে সহিংসতাকারীরা। কোমলমতিদের সাথে মিশে যায় সন্ত্রাসীরা। পুলিশ তখন একশন শুরু করে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংসতায় শেষ হয়। অবশেষে আবার সচল হয়েছে ঢাকা। এই আন্দোলন থেকে দেশের মানুষ, আওয়ামী লীগ কি ডিজিটাল কোনো শিক্ষা নিতে পেরেছে? সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র খুব সক্রিয়। এ তুলনায় আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের লোকজন বড় নেতাদের পোস্টে লাইক দেয়া ছাড়া খুব একটা সক্রিয়তা দেখান না। এই আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় মনে হচ্ছে, এই পরিস্থিতিরও বেশ পরিবর্তন হচ্ছে। বিশেষ করে গুজব প্রতিরোধে ভালো ভূমিকা রেখে চলেছেন অনেকে। পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটও দারুণ সক্রিয়। জঙ্গিবাদ রাস্তাঘাটে সন্ত্রাস করে, কিন্তু এর চাষ হয় অনলাইন জগতে।

তবে দেশের মানুষ এখনো শিক্ষার্থী আন্দোলনের সাথে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সংযোগ পরিষ্কার বুঝতে পারছেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দেশীয় এজেন্টদের তৎপরতা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলেই ষড়যন্ত্রের চেহারা প্রকাশ পাবে। মডেল নওশাবা কর্তৃক গুজব ছড়ানোর চেষ্টা, শিবির, ছাত্রদল এবং ‘সুশীল’ একদল ছেলে-মেয়ে কর্তৃক সিন্ডিকেটেড অপপ্রয়াস এবং পশ্চিমা গণমাধ্যমে আন্দোলনের কাভারেজ লক্ষ্য করলে ষড়যন্ত্রের গভীরে পৌঁছা যাবে। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে শুধু পুলিশি একশন আর ছাত্রলীগকে হাইলাইট করা হয়েছে। কিন্তু কোমলমতিদের ভিড়ে চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল বহনকারী কিংবা গুজব রটনাকারীদের কাভারেজ দেয়া হয়নি। সরকারকে স্বৈরতান্ত্রিক প্রমাণের চেষ্টা চলছে। সামনে নির্বাচন, বিএনপি-জামাত বেকায়দায় আছে দীর্ঘদীন থেকে। তাই সবগুলো সামাজিক ইস্যুকে পুঁজি করে নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছে এই গোষ্ঠী। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও এখন অনেক শক্তিশালী। তাই জনগণ সতর্ক থাকলে, কোনো ষড়যন্ত্র সফল হবে না।

লেখক: সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :