তিন সিটি নির্বাচনের বার্তা

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ১১ আগস্ট ২০১৮, ১২:৩৩

মাত্রই হয়ে যাওয়া তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে খুব সরল রৈখিক কোনো ছকে ফেলে বিশ্লেষণ করা যাবে না। নির্বাচনের আগে নানাজনের মুখে এবং মিডিয়াতে যে সব আলোচনা চলেছিল, তাতে অনেকে আগেভাগেই ধারণা করেছিল কি হতে যাচ্ছে এই তিন নির্বাচনের ফলাফল। ভেবেছিল- খুলনা এবং গাজীপুরের মতোই কিছু একটা হবে হয়তো। কিন্তু সেই অতিসরলীকৃত বিশ্লেষণকে যেন পাল্টে দিলেন এক আরিফুল হক চৌধুরী। প্রমাণ করলেন, কেবল অভিযোগ আর অভিযোগ করে কখনো প্রতিক‚ল পরিস্থিতিকে জয় করা যায় না। তেমন কিছু ঘটলে অভিযোগ তো করতেই হবে, কিন্তু পাশাপাশি বিরূপ পরিবেশকে জয় করার প্রচেষ্টাও থাকতে হবে। যে বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে হয়ে যাওয়া অপর চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মধ্যে দেখা যায়নি। এমনকি দেখা যায়নি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যেও।

সংবাদকর্মী হিসাবে আমরা খেয়াল করেছি, প্রায় প্রতিদিন বিএনপি কার্যালয়ে বসে প্রেসব্রিফিং করেন তাদের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব। কোনো কোনো দিন একাধিকবারও ব্রিফিং করেন। পল্টনের এই কার্যালয়টি অনেকটা যেন তার আবাসস্থলেই পরিণত হয়েছে। এই যে দলের রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রায় সার্বক্ষণিক থাকা, নানা ছুতানাতায় সাংবাদিকদের ডেকে ডেকে ব্রিফিং করা, একেই আবার অনেকে বিশাল রাজনৈতিক সাফল্য হিসাবে বিবেচনা করে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি অনুভব করছেন। তার অনুগামী কারো কারো মুখে এমনও শোনা যায়, এই প্রতিক‚লতার মধ্যে এই একটি লোকই তো দলটিকে টিকিয়ে রেখেছে! এমন কথার মধ্যে সত্যতা হয়তো কিছুটা আছে, কারণ দেখা গেছে অন্য বড় বড় নেতা যখন গুটিয়ে গর্তে ঢুকে গেছেন, তখন এই এক ব্যক্তিই কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসে নিয়মিত প্রেসব্রিফিং করে গেছেন। সে সব ব্রিফিংয়ে দলীয় কর্মপদ্ধতি, জনগণের জন্য দিক-নির্দেশনা, এসব যতটা না থাকছে, তার চেয়ে বেশি থাকছে সরকার ও শাসকদলের প্রতি অভিযোগ আর অনুযোগ, থাকছে কিছু করতে না পারার হাহাকার।

কেন্দ্রীয় এই রাজনীতির প্রতিফলনই যেন এবার দেখা গেল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের মধ্যে। এর শুরুটা হয়েছিল খুলনায়। সেখানে নির্বাচনের আগে বিএনপি প্রার্থীর প্রতিটা দিনই যেন শুরু হতো সাংবাদিকদের সামনে অভিযোগের বস্তা খুলে। সরকার তাকে এটা করতে দিচ্ছে না, ওটা করতে দিচ্ছে না, ইত্যাদি। পরের নির্বাচন, গাজীপুরেও তার পুনরাবৃত্তি দেখা গেল। এই ভদ্রলোকের অবশ্য একটা ভালো অজুহাত ছিল, অসুস্থতার কারণে তিনি হাঁটাহাঁটি করতে পারতেন না। ফলে পায়ে হেঁটে যে নির্বাচনি প্রচারণা, সেটা তিনি একদিনও করেননি। তাহলে প্রচারটা হবে কি করে? অগত্যা হয়তো সে কারণেই বেছে নিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মতো ঘরে বসে অভিযোগের ঝাঁপি খোলার কৌশল। কৌশলগুলো বাস্তবে তেমন কোনো কাজে লাগলো না, ভরাডুবি হলো নির্বাচনে। রাজশাহী এবং বরিশালেও এর কোনো ভিন্নতা ছিল না। ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল সিলেটের আরিফুল হক চৌধুরী। তিনিও অভিযোগ করেছেন, তবে নির্বাচনে জয় পেতে কেবল এই অভিযোগের ওপর নির্ভর করে বসে থাকেননি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জয় নিশ্চিত করতে নিজস্ব কৌশল নির্ধারণ করেছেন, তারপর সেই অনুযায়ী কাজ করেছেন।

ইউরোপিয়ান ডেমোক্র্যাসির সঙ্গে আমাদের রাজনীতির অনেকটাই পার্থক্য রয়েছে। নামে উভয়েই গণতান্ত্রিক হলেও আচরণে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও প্রয়োগও এক নয়। উন্মুক্ত স্থানে সরকারি দল নানা উপলক্ষে ক’দিন পরপর জনসভা করতে পারবে, কিন্তু বিরোধী দলকে বছরেও একবার করতে দেয়া হবে না এমন গণতন্ত্র ওইসব দেশে নেই। আবার বিরোধীদলকে নেতৃত্বশূন্য করতে তাদের জনসভায় গ্রেনেডের পর গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটানোর কথাও তারা কল্পনা করতে পারে না। তাই ওই সব দেশের সঙ্গে তুলনা করে এই পেলাম না, ওই পেলাম না বলে হাহাকার করাও কোনো কাজের কথা নয়। বরং পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়েই তৈরি করতে হবে নিজেদের রণকৌশল। সেই কাজটিই সিলেট সিটি নির্বাচনে করে দেখিয়েছেন বিরোধী দলীয় প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। সরকারি দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে অভিযোগ করেছেন, আবার এরই মধ্যে ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন, ভোটগুলোকে কিভাবে নিজের ঘরে তোলা যায় তার কৌশল নির্ধারণ করেছেন।

সিলেটের নির্বাচনে এখনো অবশ্য চ‚ড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হয়নি। ১৩৪টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৩২টির ফল পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায় বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী পেয়েছেন ৯০,৪৯৬ ভোট আর আওয়ামী লীগ প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান পেয়েছেন ৮৫,৮৭০ ভোট। যে দুটি কেন্দ্র বাকি আছে, সে দুটির সকল ভোটের সঙ্গে দু’জনের প্রাপ্ত ভোটের পার্থক্যের চেয়ে সামান্য বেশি। তাই ওই কেন্দ্র দুটির নির্বাচন হতে হবে। তবে ভোটের যে ট্রেন্ড, তাতে মনে হয় না ওই কেন্দ্র দুটিতে সকল ভোটারই অংশ নেবে এবং তারা সবাই নৌকাতে ভোট দেবে। তাই সে কারণেই ধানের শীষের প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীকে সকলে বিজয়ী হিসাবেই ধরে নিচ্ছে।

রাজশাহী, বরিশাল এবং সিলেট এই তিন সিটি করপোরেশনেই গত ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন। সিলেটের মতো রাজশাহীতেও গতবারের বিজয়ী প্রার্থীই এবার প্রার্থী হয়েছিলেন। বরিশালে অবশ্য নতুন প্রার্থী দেয়া হয়েছিল। রাজশাহী ও বরিশাল দুই জায়গাতেই বিএনপি প্রার্থীর একেবারে ভরাডুবি হয়েছে, বিশাল ব্যবধানে হেরেছেন তারা। বরিশালের পরাজয়টা ছিল নজিরবিহীন, এখানে বিএনপি প্রার্থী পেয়েছে মাত্র ১৩ হাজার ভোট। বিপরীতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেয়েছে প্রায় এক লাখ দশ হাজার ভোট। বিএনপি প্রার্থীর এত কম ভোট পাওয়াটা খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ। এমনিতে বরিশাল শহরে বিএনপির ভোট বেশি বলেই এতদিন বিবেচনা করা হতো। সেরকম একটা জায়গায় মাত্র ১৩ হাজার ভোট, কিভাবে সম্ভব? এটা কি কেবল সরকারি দলের কারচুপির কারণেই হয়েছে? নাকি বিরোধী দলের মাঠ ছেড়ে দেয়ার কারণে হতে পেরেছে? বিএনপিকে নিয়মিত ভোট দেন এমন অনেকের সঙ্গেই আমার এ নিয়ে কথা হয়েছে। তারা তাদের চ‚ড়ান্ত বিরক্তি প্রকাশ করছেন বরিশালে সকাল ১০টার দিকেই বিএনপি প্রার্থীর ভোট বর্জনের ঘোষণায়। তাদের মতে, ভোট বর্জনের ফল যে কতটা মর্মান্তিক হয়, সেটা ২০১৪ সালের উদাহরণ থেকেও এ দলটি শিক্ষা নিতে পারেনি। ভোট বর্জন করতে হবে কেন? ভোট যাতে লুণ্ঠিত না হয়ে যায়, তার জন্য লড়াই করতে এই দলটির এত আলস্য কেন?

দলের নীরব সমর্থকদের এমন সব প্রশ্নের জবাব কেবল যে প্রার্থীদের কাছেই চাওয়া হয়েছে তা নয়, দলের শীর্ষ নেতৃত্বকেও এর জবাব এখন দিতে হবে। ভোটারদেরকে জানাতে হবে তাদের বিকল্প কর্মকৌশল। তবে সে কৌশল কি হতে পারে, কিভাবে তার বাস্তবায়ন করা যেতে পারে, সে বিষয়ে কিন্তু হাতে-কলমে একটা শিক্ষা সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরী এবার দিয়ে দিলেন। সামনে জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি কি এই শিক্ষাটি গ্রহণ করবে? নাকি থেকে যাবে তাদের সেই অভিযোগের রাজনীতির অনতিক্রান্ত বৃত্তেই?

মাসুদ কামাল: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :