রাজশাহী-৫: চ্যালেঞ্জে আ.লীগের দারা বিএনপির নাদিম

ব্যুরো প্রধান, রাজশাহী
 | প্রকাশিত : ১৫ আগস্ট ২০১৮, ০৮:১৮

রাজশাহী-৫ আসন এলাকাটি এখন আগাম নির্বাচনী প্রচারণায় সরগরম। একই সঙ্গে প্রকাশ পাচ্ছে প্রধান দুই দলের মনোনয়ন-প্রত্যাশীদের মধ্যকারও বিভেদও। আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপির বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছেন দলের একটি অংশ। আর বিএনপির সাবেক এমপিকে মনোনয়ন না দিতে ডজন খানেক নেতা কেন্দ্রে গিয়ে বলে এসেছেন।

কৃষি ও মৎস্য চাষে সমৃদ্ধ পুঠিয়া ও দুর্গাপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনটি গত ২০ বছরে দুবার করে দখল করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জয় পায় বিএনপি, এমপি ছিলেন নাদিম মোস্তফা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসনটি উদ্ধার করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী আবদুল ওয়াদুদ দারা। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২০১৪ সালেও আসনটি ধরে রাখেন তিনি।

দলীয় কোন্দলসহ নানা কারণে দুজনই এবার চ্যালেঞ্জের মুখে। আগামী নির্বাচনে এই আসনে মনোনয়ন চাইতে প্রস্তুত দুই প্রধান দলের অন্তত ডজন খানেক নেতা। এ ছাড়া নির্বাচনে অংশ নিতে জাতীয় পার্টির এক নেতা মাঠে নেমেছেন।

তিন দলের এক ডজনের বেশি নেতার নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় সরগরম ৩৯০ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটারের সংসদীয় আসন রাজশাহী-৫।

২০০৮ সাল থেকে এই আসনের এমপি শিল্পপতি কাজী আবদুল ওয়াদুদ দারা। পুঠিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দারা আবার মনোনয়ন চাইবেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আরও পাঁচ নেতা। সম্ভাব্য এসব প্রার্থী সুযোগ পেলেই ছুটে যাচ্ছেন এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে। করছেন গণসংযোগ, মতবিনিময়।

আওয়ামী লীগের মনোনয়নের দাবিদার হিসেবে রয়েছেন সাবেক এমপি তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক, দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল মজিদ সরদার, সাংগঠনিক সম্পাদক আহসান-উল-হক মাসুদ, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. মনসুর রহমান ও জেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি ওবায়দুর রহমান।

নৌকার দাবিদার হিসেবে তারা পুঠিয়া-দুর্গাপুরের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে সাঁটিয়েছেন নিজেদের ব্যানার-ফেস্টুন। তাদের মধ্যে জনপ্রিয়তার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছেন আবদুল মজিদ সরদার। তার ডাকে দুই উপজেলার হাজার হাজার নেতাকর্মী হাজির হন যেকোনো দলীয় সভায়।

স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, আবদুল ওয়াদুদ দারা দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দলের মধ্যে বিভেদ প্রকাশ্যে রূপ নিতে শুরু করে। ফলে বিগত পৌরসভাসহ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী অংশ নেন। পুঠিয়া-দুর্গাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগে এমপিবিরোধী একটি শক্ত বলয় তৈরি হয়েছে। তাদের অবস্থান প্রবীণ নেতা আবদুল মজিদ সরদারের পক্ষে।

আবদুল মজিদ সরদার বলেন, ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে গিয়ে আমাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ঘুরে আসতে হয়েছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেছি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ছাড়িনি। ফলে বিপুল ভোটে দুবার ইউনিয়ন পরিষদ ও একবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। এবার আরও বৃহদাকারে সেবা করার মানসিকতা নিয়ে মাঠে নেমেছি। অন্য যারা মনোয়ন-প্রার্থী, দলে তাদের কী অবদান, তা নিশ্চয় দল খোঁজ রাখছে। আমি আশাবাদী দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।’

বর্তমান এমপি কাজী আবদুল ওয়াদুদ দারা তার বিরুদ্ধে তোলা সব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘যাদের দলে অবস্থান নাই, তারাই বিভেদ সৃষ্টি করছে, আমার বিরুদ্ধে বা দলের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে। যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে তা রাজনৈতিক ও ভিত্তিহীন। আমি দুই মেয়াদে এমপি থেকে দুই উপজেলার ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। এসব বিবেচনায় আমি আশা করি, দল আমাকে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেবে এবং মানুষ আমাকে আবার নির্বাচিত করবে।’

এই আসনে টানা ১০ বছর এমপি ছিলেন বিএনপির প্রভাবশালী নেতা নাদিম মোস্তফা। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি আত্মগোপন করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পান পুঠিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মন্ডল। তবে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে হেরে যান। আসছে নির্বাচনে বিএনপির এই দুই নেতা আবার মনোনয়ন চাইবেন।

বিএনপির মনোনয়ন-প্রত্যাশীদের মধ্যে আরও রয়েছেন কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর জিয়া পরিষদের সহ-সভাপতি সিরাজুল করিম সনু, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু বকর সিদ্দিক, দুর্গাপুরের দেলুয়াবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম সাকলায়েন, পুঠিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন জুম্মা, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মতিয়া হক ও দুর্গাপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র সাইদুর রহমান মন্টু।

স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, একসময় পুঠিয়া-দুর্গাপুরে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন নাদিম মোস্তফা। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে তিনি এলাকাছাড়া। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি এলাকায় তেমন আসেন না। যোগাযোগ নেই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে।

আর নির্বাচনে পরাজয়ের পর নজরুল ইসলামকেও তেমন দেখা যায় না এলাকায়। গত বছর দুই উপজেলার অন্তত ১২ জন নেতা দলের চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়গুলো জানান। তারা এই দুই নেতাকে বাদ দিয়ে আগামী নির্বাচনে নতুন কোনো মুখকে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান।

নাদিম মোস্তফা ও নজরুল ইসলামের নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে এলাকায় সক্রিয় হয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে বেশ ভালো অবস্থান তৈরি করেছেন ব্যবসায়ী সিরাজুল করিম সনু। পুরো নির্বাচনী এলাকায় তার পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। এলাকায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকেন তিনি। এ জন্য চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সিরাজুল করিম ও রাজশাহী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মন্টুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রায় আড়াই মাস কারাভোগ করেন সিরাজুল। তারপরও বিপদে-আপদে তিনি কর্মীদের পাশে থাকেন। সহযোগিতা করেন।

সিরাজুলের সমর্থকরা জানান, তিন প্রজন্ম ধরে তাদের পরিবার স্থানীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তার দাদা প্রয়াত রহিম উদ্দিন মোল্লা ২২ বছর দুর্গাপুর উপজেলার মাড়িয়া ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার বাবা আবদুল ওয়াহেদও মাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। পরে তিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এখন তিনি জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি। সিরাজুলের ছোট ভাই মোল্লা হাসান ফারুক ইমাম সুমন মাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের টানা চারবারের চেয়ারম্যান। এখন তিনি উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। ফলে বিএনপির স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে পরিবারটির নিবিড় যোগাযোগ।

সিরাজুল করিম সনু বলেন, ‘আশা করি, নির্বাচনের আগেই আমাদের নেত্রী মুক্তি পাবেন। আমরা চেয়ারপারসনের নেতৃত্বে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। আর সেই নির্বাচনে আমি রাজশাহী-৫ আসন থেকে দলের মনোনয়ন চাইব। মনোনয়ন পেলে আমি আমার জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। তৃণমূলের কর্মীদের সংগঠিত করছি। তাদের প্রস্তুত করছি নির্বাচনের জন্য।’

বিএনপির সাবেক এমপি নাদিম মোস্তফার দাবি, তিনি পুঠিয়া-দুর্গাপুরবাসীর জন্য যা করেছেন তা আর কোনো এমপি করতে পারেননি, পারবেন না। তিনি বলেন, ‘মানুষ এখনো আমার সঙ্গেই আছেন। এখনো কোথাও গেলে কর্মী-সমর্থকরা জড়ো হয়। নির্বাচনে অংশ নিতে যে যে প্রস্তুতি থাকা দরকার তা আমার আছে। দল আমাকেই মনোনয়ন দেবে বলে বিশ্বাস করি।’

এই আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির পরাজিত প্রার্থী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সবাই যখন পলাতক, তখন আমি নেতাকর্মীদের পাশে থেকে নির্বাচন করেছি। সামান্য ভোটে পরাজিত হয়েছিলাম। সেই থেকে জনগণের সঙ্গেই আছি। এবারও দল আমার প্রতি আস্থা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।’

বিএনপির আরেক মনোনয়ন-প্রত্যাশী গোলাম সাকলায়েনের প্রতিও মানুষের আস্থা রয়েছে বলে তার দাবি। সাকলায়েন বলেন, ‘তাই দল মনোনয়ন দিলে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে পারব। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হতে নেতাকর্মীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।’

এদিকে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য ও রাজশাহী জেলা সভাপতি অধ্যাপক আবুল হোসেন দুই উপজেলায় গণসংযোগ করছেন। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘসময় থেকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি রয়েছে আমার। কিন্তু জোটগত কারণে নির্বাচনে অংশ নিতে পারিনি। এবার জোটের বাইরে জাতীয় পার্টি নির্বাচন করলে এবং আমাকে মনোনয়ন দিলে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।’

(ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় নির্বাচন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা