১৫ আগস্ট: সেরনিয়াবাতের বাসার প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০১৮, ২১:১২

ঝালকাঠি প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস

১৯৭৫ সালের ভয়াল কালরাতে তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলার প্রত্যক্ষদর্শী তার পুত্রবধূ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপির স্ত্রী বেগম শাহানারা আবদুল্লাহ। ঘাতকদের হামলায় তার আশপাশের অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কোমরে গুলি লাগে তার। ভাগ্যগুণে বেঁচে যান তিনি। কিন্তু চার বছরের শিশুপুত্র সুকান্তকে হারান চোখের সামনে। ভয়াল ১৫ আগস্ট সামনে রেখে সাংবাদিকদের কাছে সেদিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শাহানারা আবদুল্লাহ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সবে মাত্র ফজর নামাজের সময় হয়েছে। চারদিক থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছিল। এমন সময় অতর্কিত হামলায় কেঁপে ওঠে  রাজধানী ঢাকার তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ২৭ নম্বর মিন্টো রোডের বাড়িটি। এটি বর্তমানে ঢাকা মহানগর পুলিশের সদর দপ্তর।
ঘাতকদের আগমনে ভয় পেয়ে মা শাহানারা আব্দুল্লাহর কোলে যেতে চেয়েছিল সেরনিয়াবাতের ছেলের ঘরে নাতি সুকান্ত বাবু। তার আগেই ঘাতকেরা মায়ের চোখের সামনে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতকে।
অশ্রুসজল নয়নে সেদিনের ভয়ানক ঘটনার বর্ণনায় বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বেগম শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন, ‘বাবু আমার কোলে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিন আমি বাবুকে কোলে নিতে পারিনি। চোখের সামনেই সন্তানের নির্মম মৃত্যু দেখলেও কিছুই করতে পারিনি।’ বলেই কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থাকেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল কালরাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলার পাশাপাশি তার বোনজামাই ও তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ২৭ নম্বর মিন্টো রোডের বাড়িতেও হামলা করে ঘাতকেরা। সেখানে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ ছয়জনকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে চার বছরের শিশু সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতও ছিল।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে লোমহর্ষক সেই ঘটনার বর্ণনায় মা শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন, ‘সেদিন (১৫ আগস্ট) ফজরের আজানের পর আমরা প্রচ- গুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। শব্দ আমাদের বাসার দিকেই আসছিল। গুলির শব্দে হঠাৎ করে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। আমার শাশুড়ি (বঙ্গবন্ধুর বোন আমেনা বেগম) বলেন, ‘বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, ডাকাত পড়েছে, আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দাও’। আমার শ্বশুর আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বঙ্গবন্ধুকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু কী কথা হয়েছে, বলতে পারব না। এরই মধ্যে আমি শেখ ফজলুল হক মনি ভাইকে ফোন করলাম। ফোনে তাকে বললাম, আমাদের বাড়ির দিকে কারা যেন গুলি করতে করতে আসছে, বুঝতে পারছি না। মনি ভাই বলেন, ‘কারা গুলি করছে দেখো’। বললাম, বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না। মনি ভাই বলেন, ‘তারপরেও দেখো, কারা আসছে।’
শাহানারা বলতে থাকেন, ‘এর মধ্যে ফোনটি আমার হাত থেকে টেনে নিয়ে আমার শাশুড়ি মনি ভাইকে বলেন, ‘বাবা বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, আমাদের বাঁচাও’। এই কথা বলেই ফোন রেখে দিয়ে আমার শাশুড়ি আমার শ্বশুরকে বললেন, ‘কী ব্যাপার তুমি আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দিলা না?’ আমার শ্বশুর বলেন, ‘তোমার ভাইও মনে হয় রেহাই পায়নি’।
‘এরপর ওনার সাথে কী কথা হয়েছে আমরা সেটা শুনিনি। আমাদের দরজা ভাঙার শব্দ পাচ্ছিলাম। এমন সময় একটা চিৎকার শুনলাম, ‘তোমরা সামনে এগুবে না, ভালো হবে না।’ এ সময় ওরা (ঘাতকেরা) থমকে দাঁড়ায়। ওই চিৎকারটি দিয়েছিলেন আমার স্বামী (আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ)।
‘এরপর উনি দোতলায় চলে যান। কাজের বুয়া দরজাটা বন্ধ করে দেয়। দরজা বন্ধ করে দেয়ার পর উনি আমাদের ঘরে না ঢুকে ডান পাশের রুমে ঢুকে যান। পরে আমরা জানতে পারি, একটা ফোন আসে। ফোনটি রিসিভ করে হাসানাত। খবর এল- মনি ভাই মারা গেছেন।’
অশ্রুসজল নয়নে শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন- ‘এর মধ্যে ঘাতকেরা বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা রুমে ঢুকে ‘হ্যান্ডস আপ হ্যান্ডস আপ’ বলে আমাদের সবাইকে কর্ডন করে নিচতলার ড্রইং রুমে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাখে। সিঁড়ির অর্ধেক নেমেই বাবু (সুকান্ত বাবু) বলে, ‘মা আমি তোমার কোলে উঠবো’। কিন্তু আমি ওকে কোলে নিতে পারলাম না।
‘পাশে আমার ভাসুর (শহিদ সেরনিয়াবাত) ওকে কোলে নিল। নিচে নামার পর ভারি অস্ত্র ঠেকিয়ে ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করে ওপরে আর কে কে আছে? এমন সময় আমার শ্বশুর আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে, তার চোখের ইশারায় আমি বললাম, ওপরে আর কেউ নেই। তাই ওপরের রুমগুলো তল্লাশি না হওয়ায় আমার স্বামী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহকে ওরা খুঁজে পায়নি।’
শাহানারা বলেন, ‘তখনও আমরা বুঝতে পারছিলাম না ওরা আমাদের মারতে এসেছে, না গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে। আমার শ্বশুর ওদের বলল, ‘তোমরা কী চাও। তোমাদের কমান্ডিং অফিসার কে?’ ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে, ‘আমরা কিছুই চাই না, আমাদের কোনো কমান্ডিং অফিসার নেই।’ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘাতকেরা ব্রাশফায়ার করে। আমরা মাটিতে পড়ে যাই।’
চোখের জল মুছে শাহানারা আব্দুল্লাহ আবার বলতে শুরু করলেন, ‘শহিদ ভাইকে ঠেকিয়ে ওরা গুলি করে। উনি সঙ্গে সঙ্গে উপুড় হয়ে পড়ে যান। আমার শ্বশুরের শরীর দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। আমার শরীরের পেছনের অংশে হাত দিয়ে দেখি রক্ত বের হচ্ছে। ওরা চলে যেতে লাগল। তখনো আমার জ্ঞান ছিল। এর মধ্যেই কে যেন কান্না করে ওঠে। এরপর ঘাতকরা আবার দৌড়ে এসে ব্রাশফায়ার করে। এবার ওরা নিচ দিয়ে ব্রাশফায়ার করে। আমার শ্বশুর সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। আমি আমার শ্বশুরের পেছনে ছিলাম, আমার কোমরে গুলি লাগে। ব্রাশফায়ারে ৬ জন মারা যান। আমরা গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ৯ জন কাতরাচ্ছিলাম।
‘এর মধ্যে আবার একদল লোক গাড়ি নিয়ে আসে। তখন ভাবলাম এই বুঝি শেষ। কিন্তু পরে দেখি রমনা থানার পুলিশ এসেছে। তারা আমার শ্বশুরের পালস দেখে বলে, বাড়ির কেউ আহত আর কেউ মারা গেছে।’
দীর্ষ নিঃশ্বাস ফেলে শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন, ‘পুলিশ আসার পর বাবুকে শহিদ ভাইয়ের বুকের নিচ থেকে ওঠানো হল। দেখলাম ওর নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কিছু সময় আগে যে সন্তান আমার কোলে উঠতে চেয়েছিল, তাকে কোলে নিতে পারি নাই, সেই সস্তানের নিথর দেহ আমার চোখের সামনে।’ ছেলের ছবির অ্যালবামে হাত বুলিয়ে পুরনো স্মৃতি হাতড়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন মা শাহানারা।
ছেলের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন- ‘আমার বাবু ছিল অসম্ভব মা-ভক্ত। আমি যখন যা বলতাম তা মেনে নিত। ও মাঝে মধ্যে বলত, ‘মা তোমাকে ছেড়ে অনেক দূরে ঘাসের মধ্যে গিয়ে শুয়ে থাকব’। এই কথা বলেই দীর্ঘসময় তার (শাহানারা আব্দুল্লাহর) কথা বন্ধ হয়ে যায়।
নীরবতা ভেঙে শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন- ‘ওর জন্ম ১৯৭১ সালের ২২ জুন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ওকে বুকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে দৌড়িয়েছি। একদিকে আর্মি অন্যদিকে রাজাকার। আমার স্বামী বরিশাল অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন। রাজাকাররা পেলেই আমাদের মেরে ফেলবে এমন আতঙ্কে ছিলাম। যুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘদিন হাসানাতের সঙ্গে দেখা হয়নি। পরে একটি চিরকুট পেলাম। তিনি পয়সারহাট এসেছেন। সেখানে গিয়ে দেখা করি। সেই সময়ে বাবুকে বুকে নিয়ে আজকে এই বাড়ি কালকে ওই বাড়িতে দিন পার করেছি।
‘ওই সময় গ্রামে দুধ তো দূরের কথা ভাতও ঠিকমতো পাওয়া যায়নি। ভাত টিপে টিপে নরম করে বাবুকে খাইয়েছি। বাবু রাজত্ব নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। আবার ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ও চলে গেল।’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতের হতভাগ্য মা শাহানারা।
সেই ভয়াল কালরাতে তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ঢাকার মিন্টো রোডের বাসায় বরিশালের ৬ জন নারী-পুরুষ খুন হন। তারা হলেন- আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ভাইয়ের ছেলে সাংবাদিক শহিদ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত এবং বরিশালের ক্রিডেন্স শিল্পগোষ্ঠীর সদস্য আব্দুর নঈম খান রিন্টু।
আহত হয়েছিলেন নয়জন- আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের স্ত্রী আমেনা বেগম, পুত্রবধূ বেগম শাহানারা আব্দুল্লাহ, বিউটি সেরনিয়াবাত, হেনা সেরনিয়াবাত, আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ, রফিকুল ইসলাম, খ ম জিল্লুর রহমান, ললিত দাস ও সৈয়দ মাহমুদ।'
(ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/মোআ)