অটলবিহারী বাজপেয়ীর রাজনৈতিক জীবন

প্রকাশ | ১৬ আগস্ট ২০১৮, ১৮:৫০ | আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০১৮, ১৯:০৪

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী ৯৩ বছর বয়সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নয়াদিল্লির একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউ অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস(এইমস) হাসপাতালে মারা যান তিনি। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হাসপাতালে গিয়েছিলেন তাকে দেখতে।

অনেক দিন ধরেই বাজপেয়ীর একটি কিডনি অচল ছিল। গত কয়েক বছর ধরে ঠিক মতো সচল ছিল না তার স্মৃতিশক্তি। অসামান্য বাগ্মীতার জন্য খ্যাতি ছিল যার, সেই অটলবিহারী বাজপেয়ী গত কয়েক বছর ধরে কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়েছিলেন অনেকটাই। কিডনি, মূত্রনালী ও বুকে সংক্রমণ নিয়ে গত ১১ জুন থেকে টানা হাসপাতালেই ছিলেন তিনি। আজ বৃহস্পতিবার হাসপাতালেই চিরতরে থেমে গেল তার হৃৎস্পন্দন।

অটলবিহারী বাজপেয়ীর রাজনৈতিক জীবন

ভারতের মধ্যপ্রদেশে ১৯২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর গ্বালিয়রে জন্ম অটলবিহারী বাজপেয়ীর৷ মা কৃষ্ণা দেবী, বাবা কৃষ্ণবিহারী বাজপেয়ী৷ বাবা ছিলেন কবি, পেশায় স্কুলশিক্ষক৷ কবিতায় হাতেখড়ি বাবার কাছেই৷ গ্বালিয়রের ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে স্নাতক হন। পরে কানপুরের ডিএভি কলেজ থেকে স্নাতকোত্তরে উত্তীর্ণ হন প্রথম শ্রেণিতে। ইংরেজি, হিন্দি, সংস্কৃত— বেশ তরুণ বয়সেই তিনটি ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন বাজপেয়ী।

রাজনীতি বোধ হয় ছিল তার মজ্জায়। ছাত্রাবস্থাতেই ‘আর্যসমাজ’-এর সঙ্গে যুক্ত হন। বাবা সাহেব আপ্তে-র অনুপ্রেরণায় ১৯৩৯ সালে যোগ দেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ(আরএসএস)-এ। কয়েক বছরের মধ্যেই হয়ে ওঠেন সংঘের প্রচারক।

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও যোগ দিয়েছিলেন অটলবিহারী৷ ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অংশ নিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন৷ জেল খেটেছিলেন ২৩ দিন।

১৯৫১ সালে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় অটল যোগ দেন ভারতীয় জনসঙ্ঘে৷ দলের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অন্যতম প্রিয়পাত্রও হয়ে ওঠেন শীঘ্রই৷ ১৯৫৭ সালে উত্তর প্রদেশের বলরামপুর থেকে বাজপেয়ী প্রথম বার লোকসভায় নির্বাচিত হন৷ ১৯৬৮ সালে ভারতীয় জনসংঘের সর্বভারতীয় সভাপতি হন। ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার অবসান। ইন্দিরা-বিরোধী ঐক্য জোরদার করতে চরণ সিংহের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় লোক দল এবং মোরারজি দেশাইদের কংগ্রেস (ও) এবং বাজপেয়ী-আদভানিদের জনসঙ্গ মিশে যায়, তৈরি হয় জনতা পার্টি। নির্বাচনে ভরাডুবি হয় কংগ্রেসের। মোরারজি দেশাইয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বে দেশে প্রথম অকংগ্রেসি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। অটলবিহারী বাজপেয়ী সে মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন।

নানান মতাদর্শের ‘জগাখিচুড়ি’ জনতা পার্টি অবশ্য বেশি দিন ঐক্যবদ্ধ থাকেনি। ১৯৮০ সালে সাবেক জনসংঘীরা বেরিয়ে যান জনতা পার্টি থেকে। তৈরি হয় ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), যার প্রথম সভাপতি হন বাজপেয়ী।

১৯৯৬ সালে লোকসভা নির্বাচনে একক বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিজেপি। দেশের দশম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন অটলবিহারী৷ কিন্তু নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না দলের। ম্যাজিক ফিগার জোগাড়ও করতে পারেননি বাজপেয়ী। ১৩ দিনে পতন ঘটে বাজপেয়ী সরকারের। কিন্তু ইস্তফা দেয়ার আগে যে ভাষণ অটল দিয়েছিলেন লোকসভায়, তা সংসদে প্রধানমন্ত্রীদের দেয়া স্মরণীয় ভাষণগুলোর অন্যতম হয়ে রয়ে গিয়েছে।

বাজপেয়ী সরকার টেকেনি ঠিকই। কিন্তু কংগ্রেস সমর্থন নিয়ে তৈরি হওয়া সংযুক্ত মোর্চা সরকারও বছর দু’য়েকের বেশি টিকতে পারেনি। ফলে ১৯৯৮ সালে আবার নির্বাচনের মুখোমুখি হয় দেশ। আরও বেশি আসন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে বিজেপি। ফের সরকার গঠন করে এনডিএ। কিন্তু সে বারও পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে পারেননি বাজপেয়ী। তেরো মাসে সরকার পড়ে যায়। ১৯৯৯ সালের নির্বাচনের রায়ও ছিল বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের পক্ষেই। তৃতীয় বার সুযোগ পেয়ে প্রথম অকংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড গড়েন বাজপেয়ী।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয় কার্যকালে অটলবিহারী বাজপেয়ী অনেকগুলি ক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। দেশের আর্থিক বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়েছিল। রাজকোষ দ্রুত ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। দেশ জুড়ে পরিকাঠামো উন্নয়ন গতি পেয়েছিল। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি, সাম্প্রদায়িক হিংসাসহ নানা বিষয় ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে আর এনডিএ-কে ক্ষমতায় ফিরতে দেয়নি৷ পরাজয়ের সমস্ত দায় নিজের কাঁধে নিয়ে বিরোধী নেতার পদ নেয়া থেকেও সরে দাঁড়িয়েছিলেন অটল। ২০০৯ সালে আর নির্বাচনেও লড়েননি।

অকৃতদার বাজপেয়ী ছিলেন পূর্ণ সময়ের রাজনৈতিক কর্মী। পরিজন বলতে দত্তক কন্যা। ভালোবাসতেন ঘুরে বেড়াতে, সিনেমা দেখতে৷ তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও সময় পেলেই চলে যেতেন সিনেমা দেখতে। লালকৃষ্ণ আদভানি হতেন সঙ্গী। আর কাব্যচর্চা তো ছিল রক্তেই, তাই সে সব চলত রাজনৈতিক ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকেই।

সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য অটলবিহারী বাজপেয়ী সম্ভবত ছিলেন এক আদর্শ রাজনীতিক। ঘোর রাজনৈতিক বৈরিতা ছিল যে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে, ’৭১-এর যুদ্ধে ভারতের অভূতপূর্ব বিজয়ের পরে সেই ইন্দিরাকেই সংসদে দাঁড়িয়ে ‘মা দুর্গা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। কোনও অমোঘ নিয়মেই হয়তো নিজেও ফিরে পেয়েছিলেন সেই সম্মান। মতাদর্শগত দিক থেকে বাজপেয়ীর চেয়ে অনেকটা দূরত্বে অবস্থান করা মনমোহন সিং বলেছিলেন, ‘অটলবিহারী বাজপেয়ী হলেন ভারতীয় রাজনীতির ভীষ্ম।’

শরশয্যার মতো যন্ত্রণা কখনও অনুভব করেছিলেন কি না, বলা কঠিন। কিন্তু দীর্ঘ রোগশয্যা ভোগ করতে হয়েছে শেষটায়। প্রয়াণটা বোধহয় ভীষ্মের মতোই হলো। জাতীয় রাজনীতির কুরুক্ষেত্রে যুযুধান শিবিরে থাকা দু’পক্ষের মধ্যে যখন তিক্ততা চরমে, তখন বাজপেয়ীকে ঘিরে সব তিক্ততাই যেন অতীত। সব পক্ষ তার শয্যাপার্শ্বে। সূর্যও উত্তরায়নেই।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

(ঢাকাটাইমস/১৬আগস্ট/এসআই)