ভাসমান হাটে না গেলে সৌন্দর্য বোঝানো যাবে না

জহির রায়হান, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৩ আগস্ট ২০১৮, ১০:৫৫ | প্রকাশিত : ২৩ আগস্ট ২০১৮, ০৮:৩৩

‘খালের ভেতর দিয়ে নৌকা ছুটে চলছে। দুই পাশে সবুজের সমারোহ। খালের পাড় যে এত সুন্দর হতে পারে সেটা ওখানে না গেলে কেউ বুঝতে পারবে না। পাড়জুড়ে পেয়ারাবাগান, লেবুবাগান, আমড়াবাগান, কলাবাগানসহ নার্সারি।

‘খালের পাড়ের এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এরপর ভিমরুলি বাজারে গিয়ে তো চক্ষু চড়কগাছ। পেয়ারা, মৌসুমি ফলসহ অন্যান্য সবজি বোঝাই শত শত নৌকা ভাসছে। ভাসমান এসব নৌকাতেই চলছে কেনাবেচা। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। অজান্তেই মনের ভেতর জীবনানন্দ গেয়ে ওঠেন- ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না...’

এভাবেই ভাসমান হাট ঘুরে দেখার আনন্দ-অভিজ্ঞতা ঢাকাটাইমকে বর্ণনা করলেন বেসরকারি চাকরিজীবী নাঈম হোসেন।

দক্ষিণাঞ্চলের ঝালকাঠী ও স্বরূপকাঠীর বিভিন্ন জায়গায় বসে ভাসমান হাট। মৌসুমি ফল আর সবজির পসরা বসে ভিমরুলি ও আটঘর হাটে, আর কুড়িয়ানায় বসে নৌকার বাজার। এসব ভাসমান হাট ‍ঘুরে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ দল বেঁধে ঘুরতে যান ওখানে।

ভাসমান বাজারে আপনাকে কেনাকাটা করতে হবে নৌকা নিয়ে। বিক্রেতারা নৌকায় করে পণ্য বিক্রি করে, আর ক্রেতারা এক নৌকা থেকে আরেক নৌকায় ঘুরে ঘুরে দেখছে। ভাসমান বাজারে পেয়ারা বেশি পাওয়া যায় বলে অনেকে একে ভাসমান পেয়ারার বাজার বলে থাকে। সারা বছরই এখানে ভাসমান হাটেবেচা কেনা চলে।

পেয়ারার রাজ্য

পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর, কুড়িয়ানা, আদমকাঠী, ধলহার, কঠুরাকাঠি, আন্দাকুল, জিন্দাকাঠি, ব্রাহ্মণকাঠি, আতা, জামুয়া, মাদ্রা, ঝালকাঠি, শশীদ, পূর্ব জলাবাড়ী, আদাবাড়ি ও জৌসার গ্রাম এবং ঝালকাঠি ও বরিশালের বানারীপাড়ার মোট ৩৬টি গ্রামের কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষ হয়। কয়েক হাজার পেয়ারা বাগান ছড়িয়ে আছে এসব এলাকায়। প্রতিদিন খুব সকালে চাষিরা বাগান থেকে পেয়ারা তুলে নৌকায় করে ভাসমান বাজারে আসেন। তাই আপনাকে ভাসমান হাটের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে সকাল সকাল আসতে হবে।

ঈদের ছুটিতে দলবেঁধে ঘুরে আসতে পারেন এ ভাসমান হাটগুলোতে। এক দিনেই ঘুরে আসতে পারবেন আপনি। এ হাটে এখন পেয়ারাবোঝাই নৌকা বেশি দেখা যাবে। শত শত নৌকা আসছে হাটে। ক্রেতাও আসছে নৌকা অথবা ট্রলার নিয়ে।

যেদিকে চোখ যাবে প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম সৌন্দর্য‌্য ভ্রমণপিয়াসীদের দেবে বাড়তি আনন্দ। সরু খালের পানির ওপর ডিঙ্গি নায়ে বোঝাই পেয়ারা।

শুক্রবার ভ্রমণপিপাসু মানুষের আনাগোনা বেশি হলেও প্রতিদিনই এখানে ভাসমান হাট বসে। হাটে বিক্রি হয় পেয়ারা, কাকরোল, কাচা কলা, পেঁপে, কচুর মুথি, সবরি কলা, মিষ্টিকুমড়াসহ মৌসুমি ফল আর বিভিন্ন সবজি।

ভিমরুলি হাট

এটি এখানের সবচেয়ে জমজমাট হাট। ঝালকাঠী জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ভিমরুলি গ্রামে বসে এ ভাসমান হাট। পেয়ারার মৌসুমে জমজমাট বেশি থাকে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। ক্রেতাদের বেশির ভাগই পাইকার। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায় এখানকার পেয়ারা, আমড়াসহ বিভিন্ন ফল ও সবজি।

আটঘরের হাট

ভাসমান এ বাজারে বিভিন্ন জায়গা থেকে ছোট ছোট নৌকায় পেয়ারা ও স্থানীয় ফল ও সবজি নিয়ে আসেন চাষিরা। কুড়িয়ানা থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে আটঘর পেয়ারার হাট।

কুড়িয়ানা নৌকাহাট

এ হাটটি স্বরূপকাঠীতে। ভিমরুলির হাট থেকে ইঞ্জিন নৌকায় এখানে আসতে সময় লাগবে ঘণ্টাখানেক। এ হাটে বিক্রি হয় নৌকা। বিশাল এলাকাজুড়ে শত শত নৌকা ভেসে আছে।সপ্তাহে প্রতি শুক্রবার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নের আটঘরের খালে ও রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসে এ নৌকার হাট।

আবদুস সালাম ভাড়ায় ট্রলার চালান এ এলাকায়। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, পেয়ারা আরও ১০ দিনের মতো থাকবে। পেয়ারার সময় এ হাট জমজমাট থাকে। বিশেষ করে শুক্রবার ভ্রমণপিপাসুদের ট্রলারের ভিড় লেগে যায়। আর তাতে যেন উৎসবের মুখরতা।

আবদুস সালাম বলেন, ‘আমার ট্রলার স্বরূপকাঠি বাজারে পাওয়া যাবে। ভাড়া দুই হাজার টাকা। সব কটি হাট ঘুরিয়ে দেখানো হবে। একসঙ্গে ২০ থেকে ২৫ জন নেয়া যাবে।

যেভাবে ঘুরলেন মনোয়ার হোসেন

ঢাকা থেকে ৫৫ জনের একটি দল ভাসমান হাট ঘুরতে এসেছে। কথা হয় দলের এক সদস্য মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ভাসমান হাট দেখার ইচ্ছে ছিল অনেক দিন ধরে। এখানে আসতে পেরে নদীমাতৃক বাংলাদেশের আসল রূপ দেখতে পেলাম। আমরা ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে বরিশাল নদীবন্দরে খুব ভোরে নেমেছি। সেখান থেকে অটোরিকশায় এলাম বরিশাল নতুন বাজার, তখন সকাল ৬টা। সকাল সাতটায় আমরা বাসে রওয়ানা দেই ভাসমান হাট দেখার জন্য। বাসে বানরিপাড়া বাসস্ট্যান্ডে সকাল আটটা। এরপর ফেরিঘাট থেকে ট্রলারে ভাসমান বাজারে। ঘুরে দেখলাম ভাসমান বাজার। এখানে কেউ না এলে শুধু শুনে বুঝতে পারবে না কত সুন্দর দৃশ্য এখানে।

মনোয়ার বলেন, ‘এদিন শুক্রবার ছিল বলে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসুর আগমন ঘটে। ঢাকা থেকে লঞ্চে সাইকেল নিয়ে এসেছিল ৪০ জনের একটি দল। তারা সাইকেল চালিয়েই ঘুরেছে এ বাজার এলাকা। আমরা বরিশাল থেকে যে অংশটি বাসে এসেছি তারা এসেছে তা সাইকেল চালিয়ে।

বিকাল তিনটায় ফিরতি পথ ধরে আমরা সন্ধার দিকে পৌঁছাই বরিশাল নদীবন্দরে। এত ঘোরাঘুরির পরও কোনো ক্লান্তি নেই আমাদের। যেন এক স্বপ্নময় ভ্রমণ।

মনোয়ার আরও বলেন, ভাসমান হাটের সৌন্দর্য তো আছেই, সেটা যদি নাও থাকত, তবু শুধু ভিমরুলি, আটঘর ও কুড়িয়ানা এলাকার খালের প্রাকৃতিক সৌন্দর‌্য দেখার জন্য হলেও এখানে আসা উচিত। ছবি তোলার জন্য অসাধারণ জায়গা এটা।

যে কাজ করবেন না

যারা ঘুরতে যাবেন, তাদের খেয়াল রাখতে হবে তাদের কথা ও কাজে যেন কেউ কষ্ট না পান। কেউ কেউ আছেন যারা যেতে যেতে মালিকের অনুমতি ছাড়া পেয়ারা ছিড়েন। দেখা যায় নৌকা বা ট্রলারে যেতে যেতে পেয়ারা ধরে টান দিলে গাছের ডালও ভেঙে যায়। আবার কেউ কেউ উৎসাহিত হয়ে গাছে উঠে পেয়ারা পাড়ে। আমড়া পাড়ে। অন্যকেও দেয়। এগুলো করবেন না।

সতর্কতা

বৃষ্টির কথা মাথায় রেখে রেইনকোট, মোবাইল ফোন ও টাকা-পয়সা রাখার জন্য ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ বা পলিথিন সঙ্গে নিয়ে যাবেন। জরুরি কিছু ওষুধ নেওয়া যেতে পারে। পুলিশের সহায়তা প্রয়োজন হলে কুড়িয়ানায় পুলিশ ক্যাম্প রয়েছে।

কোথায় খাবেন

কুড়িয়ানা বাজারে ঘরোয়া হোটেল ও সকাল সন্ধা হোটেল আছে। দল বেঁধে গেলে আগে থেকে অর্ডার দিয়ে রাখা ভালো। তাহলে একসঙ্গে সবাই খেতে পারবেন।

যেখানে থাকবেন

থাকতে হলে বরিশাল অথবা ঝালকাঠী ফিরে যেতে হবে। কারণ ভাসমান হাট এলাকায় থাকার জন্য কোনো হোটেল নেই।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে নদী ও সড়কপথে বরিশাল ও ঝালকাঠী যাওয়া যায়। ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন রাতে এ দুই জেলার উদ্দেশে ছেড়ে যায় অনেক লঞ্চ। এ ছাড়া দিনে বেলায় ঢাকার সদরঘাট থেকে বরিশালের উদ্দেশে প্রতিদিন এমভি গ্রীন লাইন লঞ্চ ছাড়ে। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এ লঞ্চ প্রতিদিন বরিশাল থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। আপনি ঢাকা থেকে আকাশপথেও বরিশাল বিমান বন্দর যেতে পারেন। তবে দলবেঁধে গেলে ভালো হয় নদীপথে যাওয়া। এরপর বরিশাল অথবা ঝালকাঠী থেকে ভাসমান হাটের উদ্দেশে।

বরিশাল নথুল্লাবাদ বাসস্টান্ড থেকে বানরিপাড়ার উদ্দেশে ২৫-৩০ মিনিট পর পর বাস ছাড়ে। ভাড়া ৩৫-৪০ টাকা। বানরিপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে ফেরিঘাট রিকশায় নেবে ১৫-২০ টাকা। এরপর ফেরিঘাট থেকে ট্রলার ভাড়া করে ভাসমান পেয়ারা বাজার। এ পথে যাওয়ার সময় বাবুগঞ্জ উপজেলার গুটিয়া মসজিদ ও দুর্গাসাগর দিঘী দেখা যাবে।

আর ঝালকাঠী শহর থেকে গেলে ঝালকাঠী লঞ্চঘাট অথবা কাঠপট্টি থেকে ভাড়ায় চালিত ইঞ্জিন নৌকায় সরাসরি ভাসমান হাট। সারা দিন ঘুরাবে আপনাকে ১৫০০ থেকে দুই হাজার টাকায়। ২০-২৫ জন উঠা যাবে নৌকায়। সড়কপথেও এখানে যাওয়া যায়, তবে ট্রলার অথবা নৌকায় যাওয়াই সহজ।

স্থলপথ: ঢাকার গাবতলী, সায়েদাবাদসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বরিশাল ও ঝালকাঠির উদ্দেশে ছেড়ে যায় বিভিন্ন পরিবহনের বাস।

এ ছাড়া ভাসমান বাজারে যাওয়ার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ‘গ্রিন হলিডেজ’-এ। ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন প্যাকেজ রয়েছে ভাসমান বাজার যাওয়ার জন্য। তাদের ফোন নম্বর ও বিস্তারিত তথ্য www.greenholidaysbd.com ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে।

(ঢাকাটাইমস/২৩আগস্ট/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :