উন্নয়নশীল দেশ তুরস্ককে যেমন দেখছি-৯

তুরস্কের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা

রহমত উল্লাহ
| আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০১৮, ২৩:১৩ | প্রকাশিত : ২৭ আগস্ট ২০১৮, ২২:৫০
ইস্তাম্বুলে অবস্থিত লিভ হাসপাতাল

তুরস্কের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আলোচনার আগে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের ধাপে অগ্রসর হতে থাকা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের চিত্র সংক্ষেপে তুলে ধরতে চাই। এতে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার জন্য বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় মৌলিক পরিবর্তনগুলো বুঝতে সহজ হবে।

দৈনিক ইত্তেফাকের অনলাইনে ৩ এপ্রিল প্রকাশিত একটি খবর ছিল এমন: ‘টেনেটুনে এইচএসসি পাস করেই বনে গেছেন শিশু ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। সাইনবোর্ডে ‘এফসিপিএস’সহ কয়েকটা ডিগ্রি…টানা ছয় বছর ডিগ্রিধারী চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করছিলেন। ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসাসেবার ওপর প্রাথমিক ধারণা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেন।...একটি ফার্মেসিতে ডিগ্রিধারী চিকিৎসক হিসেবে রোগী দেখা শুরু করেন। প্রতিদিন শতাধিক রোগী দেখতেন। তিনি রাজধানীর দুটি হাসপাতালে প্রেসক্রিপশন লিখে টেস্টের জন্য পাঠাতেন। সেখান থেকে তিনি কমিশন পেতেন। তার প্রতি মাসে আয় হতো আড়াই-তিন লাখ টাকা। ঢাকার পাশাপাশি কুষ্টিয়ার একটি ক্লিনিকেও তিনি চিকিৎসক হিসেবে বসতেন।’

তুরস্কের নরডিক ট্রাস্ট হোম হাসপাতাল

গত ২২ মার্চ দৈনিক কালের কণ্ঠের অনলাইনের একটি খবর: ‘গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট দিয়ে রোগ নির্ণয় ও সেলাইয়ের সুতার মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ায় এ জরিমানা করা হয়।’

১৯ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার অনলাইনের একটি সংবাদ ছিল এমন- ‘রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ একটি আদালত বসুন্ধরায় অ্যাপোলো হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে এ জরিমানা করে। হাসপাতালের ল্যাবে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া রি-এজেন্ট ও ফার্মেসিতে কিছু বিদেশি ওষুধ পাওয়া গেছে, যেগুলোর কোনো অনুমোদন নেই। এ কারণে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।’

তুরস্কে পড়ছে বিভিন্ন দেশের মেডিকেল শিক্ষার্থী ও চিকিৎসক

দৈনিক কালের কণ্ঠের অনলাইনে ২০১৫ সালের ১৬ জুন প্রকাশিত ‘লাগামছাড়া ভিজিট চিকিৎসকদের’ শিরোনামের খবরে কয়েকজন ডাক্তারের ভিজিট ফি তুলে ধরা হয়। ‘প্রসূতি ও বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা করেন অধ্যাপক ডা. পারভীন ফাতেমা…নতুন রোগীর কাছ থেকে ফি (ভিজিট) নেন এক হাজার ২০০ টাকা। একই রোগী দ্বিতীয়বার দেখাতে গেলে নেন ৭০০ টাকা।…ভিজিটের দিক থেকে পারভীন ফাতেমাকেও ছাড়িয়ে গেছেন ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের অর্থপেডিকস বিশেষজ্ঞ ডা. এম আলী। প্রথমবার রোগীর কাছ থেকে তিনি ভিজিট নেন এক হাজার ৪০০ টাকা।’

তুরস্কের হাসপাতালের ভেতর যাতায়াতের জন্য রয়েছে ছোট গাড়ি

এ খবরগুলো বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে: ১. বাংলাদেশে কিছুসংখ্যক প্রতারক চিকিৎসক সেজে প্রতারণা করছেন; ২. বাংলাদেশে কেউ কেউ ডিগ্রি না নিয়েও নিজের নামে বিভিন্ন ডিগ্রি ব্যবহার করে চিকিৎসা খাতে প্রতারণা করছেন; ৩. ছয় বছর পর্যন্ত প্রতারণা ধরা পড়েনি; ৪. বাংলাদেশে ফার্মেসিগুলোও হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে; ৫. একটি ফার্মেসিতেই আসতে পারে শতাধিক রোগী; ৬. টেস্টের জন্য কোনো কোনো ডাক্তার কমিশনের সুযোগ নিতে পারেন; ৭. প্রতারকরা ডাক্তার সেজে ক্লিনিকগুলোতে রোগী দেখতে পারেন; ৮. বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হাসপাতালগুলোতেও মেয়াদোত্তীর্ণ ও অনুমোদনহীন চিকিৎসা উপকরণ থাকতে পারে; ৯. রোগী দেখার জন্য কোনো ফি নির্ধারণ নেই। ডাক্তাররা নিজের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী ফি ধরতে পারেন।

এ ছাড়া, ভূল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, কমিশন খেয়ে মানহীন ওষুধ লেখা, অপ্রোয়জনীয় পরীক্ষা দিয়ে কমিশন খাওয়া, ডাক্তারদের স্বেচ্ছাচারিতা, রোগীর সমস্যা না শুনেই প্রেসক্রিপশন লেখা, অফিস সময়ে ডাক্তারের অনুপস্থিতি, পৃথক চেম্বার খোলা ইত্যাদি খবরও বাংলাদেশি হিসেবে আমরা প্রতিদিনই শুনতে ও দেখতে পাই। মৌলিক অধিকার হলেও বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতে বলতে গেলে একরকম মাৎস্যন্যায় বিরাজ করছে বললেও ভুল হবে না।

উন্নয়নশীল বাংলাদেশের যে স্বপ্ন আমরা দেখি, সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চিকিৎসা খাতকে ঢেলে সাজানো ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বাস্থ্য খাতে সফল নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকারী তুরস্কের অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগতে পারে।

সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা: চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারের

তুরস্কে সব নাগরিকের জন্য সরকার নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যবীমা রয়েছে। এ বীমার আওতায় ২০১২ সাল থেকে নাগরিকরা সরকারি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালগুলো থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এ ছাড়া বীমার আওতায় চুক্তিবদ্ধ বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকেও পাওয়া যায় কম খরচে চিকিৎসার সুযোগ। তুরস্কের যেসব নাগরিকের চাকরি বীমা রয়েছে (চাকরি বীমা সম্পর্কে ১ম ও ২য় পর্বে আলোচনা করেছি) তার, স্ত্রী/স্বামীর এবং ১৮ বছর বয়স পূর্ণ না হওয়া সন্তানদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা রয়েছে।

চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে মেডিকেল টিম

যাদের নামে চাকরি বীমা নেই, সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারিত বার্ষিক স্বাস্থ্যবীমা ফি জমা দিয়ে তারাও বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ নেন। এ ক্ষেত্রে যেকোনো পরিবারপ্রধান সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন মজুরির (২০১৮ সালে তুরস্কের সর্বনিম্ন মজুরি ১৬০০ লিরা) ৩ শতাংশ হারে বছরে ৭০০ লিরা জমা দিয়ে পরিবারের সবার স্বাস্থ্যবীমা নিশ্চিত করতে পারেন।

সর্বজনীন এ স্বাস্থ্যবীমার আওতায় নাগরিকেরা কোনো ধরনের ভিজিট/ফি ছাড়াই হাসপাতালগুলো থেকে চিকিৎসা নেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দিতে হয় না একটি টাকাও। হাসপাতালে দিতে হয় না সিট ভাড়া কিংবা কেবিন ফি।

তুরস্কে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা সুবিধার কারণে চিকিৎসার অভাবে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায় না। অথবা ‘টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসা জোটে না’ এমন কথাও নেই কারও মুখে।

এ পদ্ধতির ফলে বন্ধ হয়ে গেছে ডাক্তারদের স্বেচ্ছাচারিতা, রুদ্ধ হয়েছে অতিরিক্ত ফি আদায়ের পথ, আর রোগীরা বেঁচে গেছেন অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরিক্ষা-অপারেশনের হাত থেকে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা চালু হওয়ার পর বন্ধ হয়েছে ওষুধ-বাণিজ্য, চেম্বার-বাণিজ্য, দালালদের দৌরাত্ম্য। বন্ধ হয়েছে ডিগ্রিধারী-ডিগ্রিহীন চিকিৎসকদের অর্থ-বাণিজ্য।

সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমার পাশাপাশি তুরস্ক সরকারের স্বাস্থ্য খাতে আনা সংস্কারগুলো নিয়ে আলোচনা থাকবে পরবর্তী পর্বে।

লেখক: সাংবাদিক ও পিএইচডি শিক্ষার্থী, কারাদেনিজ টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ট্রাবজোন, তুরস্ক।

(ঢাকাটাইমস/২৭আগস্ট/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

প্রবাসের খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :