গল্প

যুদ্ধবণিক

আলমগীর রেজা চৌধুরী
 | প্রকাশিত : ২৮ আগস্ট ২০১৮, ১১:২৯

বটুর পিস্তল আমার বুকে ঠেকে আছে। মাঠের ওপারে গাছ-গাছালির আড়ালে ম্লান চাঁদ। বটুর মুখ আমি আবছা দেখতে পাচ্ছি। ওনার চোখ দুটো চাঁদের মøান আলোয় কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। যেকোনো মুহূর্তে একঝলক আগুনের হলকা আমার বক্ষ বিদীর্ণ করে চলে যেতে পারে। আর তখন বটু ভীষণ বিজয় গর্বে আমার যন্ত্রণাকাতর মৃত্যুলীন মুখের ওপর একদলা থুতু ছিটিয়ে নিসর্গের কোনো অদৃশ্য দরজায় ঢুকে যাবে। কেউ জানবে না। বসুন্ধরার কিছু আসে যাবে না তাতে। কত ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে আছে বসুন্ধরা। তেমনি একটি মানুষকে পিস্তলের গুলিতে হত্যা করা হলে কি এমন হবে? বীর ভোগ্যা, বসুন্ধরা।

বটুর হাতের নিশানা ভালো। দৌড় দিলেও পিস্তলের নিশানার বাইরে যেতে পারবো না। বটুর এই দৃষ্টিটি আমার ভীষণ পরিচিত। যুদ্ধের দিনগুলোতে বটু ছেলেমানুষী করে মানুষ খুন করে ফেলেছে। আমাদের কোম্পানির সবচেয়ে শ্রদ্ধাশীল যোদ্ধা ছিল বটু। কমান্ডার মজদি ভাই বলতো, ‘বটুর যুদ্ধপ্লানও নিখুঁত। ও ছিল আমার ৯ মাস যুদ্ধকালীন বন্ধু। চমৎকার সহযোদ্ধা। আমাদের উভয়ের রাইফেল কী আন্তরিকতায় শত্রুর দিকে তাক করে জীবনমরণ খেলায় মেতো থাকতো।

সেই বটুর পিস্তল এখন আমার বুকে ঠেকে গেছে। বুকের দুরু দুরু বেড়ে গেছে টের পাচ্ছি। আমার দৃষ্টি বটুর দৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ। নিশ্চয়ই বটুর দৃষ্টির মধ্যে হিংস্রতা আছে। আমার দৃষ্টি কী করুণ। মৃত্যুর মতো ফ্যাকাসে। কোনো কাজে বটু খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মারাত্মক কিছুও বটুর নিকট স্বাভাবিক। অথচ এখনো ওর পিস্তল গর্জে ওঠেনি। এক মিনিট চলে গেছে এর মধ্যে। আমার ভীষণ শীত পেয়ে বসলো। মৃতবৎ দুটি মানব মূর্তি মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে মৃত্যু মৃত্যু খেলা খেলছি।

‘আমি তোকে মেরে ফেলতে পারি পিনু।’ বটু খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল।

‘মেরে ফেল!’ খুব উদাস শোনালো আমার কণ্ঠ।

এই সময় এক ঝাঁপসা হাওয়া এলো। মাঠের ওপাশেই কড়ই গাছটার পাতা সরসর করে শব্দ হয়। বটুর ঝাঁকড়া চুল মুখের ওপর এলোমেলো ঝাপটা মারলো। মুখের ওপর থেকে চুল সরাতে গিয়ে বটুর পিস্তল ধরা হাত একটু দূরে সরে যায়। এখন আমি কী বটুর ওপর লাফিয়ে পড়ব? বটুর সাথে শক্তিতে আমি কোনোক্রমেই পেরে উঠবো না। ওর পেশিবহুল শরীর আমার মধ্যে এক সময় হিংসে জন্মাতো। সেই বটুর উপর লাফিয়ে পড়ে আমি ওকে কোনো আঘাত করাতো দূরের কথা, বেঘোরে ওর শক্ত মুষ্ঠির কেরাতে চিৎপাত মাঠের ওপর লুটিয়ে পড়বো। তার চয়ে বরং বটু আমাকে মেরে ফেলুক। বটুর হাত কাঁপছে। ওর চোখের তারা কাঁপছে। চাঁদ এখন আড়াআড়িভাবে পড়ে বটুর মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ও যেকোনো সময় আমাকে গুলি করতে পারে।

‘এই অন্ধকারেই তুই আমাকে মেরে ফেলবি বটু? আমি তো তোর এক সময় খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম।’

‘নিশিন তোকে ভালোবাসে? আর এই জন্যে তোকে আমি মেরে ফেলবো!’ রূঢ় শোনালো বটুর কণ্ঠ।

‘নিশিনকে তুই কথাটা বলতে পারবি যে, তুই আমার হত্যাকারী?’ ‘না। তাহলে এইভাবে মৃত্যুতে আমার দুঃখ আছে বটু। মানুষের কিছু অহংকার, আবেগ থাকে। আমারও আছে। নিশিনের কাছে তুই নিরপরাধ থাক এটা আমি চাই না।’ ধীর কণ্ঠ আমার। মাঠের ওপর বিস্তীর্ণ আলোর রেখা। বটুর সেই নির্মমরূপ এখন আর নেই। এখন কোমল মনে হচ্ছে ওকে। এবার মাথা ঝাঁকালো বটু।

‘তুই জানিস আমি নিশিনকে খুব বেশি ভালোবাসি।’ কাঁপা কণ্ঠ বটুর। ‘নিশিন আমাকে তাই বলে। তুই তো ওর কাছ থেকে বেশি মমতা পেয়েছিস!’

‘নিশিন তোকে বিয়ে করবে?’

‘করতে পারে আবারও নাও পারে। আমি ওকে ভালোবাসবো।’ খুব সরলভাবে কথা কয়টি আমার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে যায়।

‘আমি তোকে হিংসে করি পিনু। মেরে ফেলতে পারি। নিশিন জানবে না। তবু তোকে মারতে পারলাম না। আমিও নিশিনকে ভালোবাসি। নিশিন কষ্ট পাবে।’ বটুকে হঠাৎ করে খুব ভারী মনে হলো। শতধা বিখন্ডিত হৃদয়ের ক্রন্দন যেন বটুর বুকে আটকে আছে। বটুর পিস্তলটা সন্তর্পণে ওর প্যান্টের পকেটে ঢুকে যায়।

‘তুই এখন বাড়ি যা পিনু। আবার বাস পাবি না?’ সামনের দিকে পা বাড়ায় বটু।

‘কতক্ষণ আগে তুই আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলি বটু?’ আমার নিরুত্তাপ কণ্ঠ।

‘তোর সঙ্গে আমার পরে দেখা হবে তুই যা, বাস পাবি না। বিরক্ত কণ্ঠে বটু বলে। যে বটু একসময় আমার চমৎকার বন্ধু ছিল। কতক্ষণ আগে ওর পিস্তল আমার বুকে ঠেকেছিল। যেকোনো সময় আমার জীবন প্রদীপ নিভে যেতে পারতো। সেই বটু, আমি বাস পাব না জেনে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে।

চার-পাঁচ গজ এগিয়ে গেছে বটু। মøান চাঁদের আলোয় ওর গমন আমার চোখের সামনে অলৌকিক ছায়া ফেলছে। আবার হাওয়া এলো। শীতে আমার ঠোঁট কাঁপছে। প্রতিটি লোমকূপ খাড়া হয়ে ওঠে। মাঠের শেষ মাথায় বটুর ছায়া একটু দেখা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। এই মাঠে আমি একা। অযাচিতভাবে আমার ভয় করতে থাকে। চাঁদের আলোয় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে দশটা বেজে গেছে। রাস্তায় গাড়ি চলার শব্দ এখনো আসছে। মিরপুর শেষে রাস্তায় বিস্তীর্ণ ধানি জমি কুয়াশায় খুব নিঃস্ব মনে হচ্ছে। দূরে কোথাও থেকে খোল-করতালের দ্রিমি দ্রিমি শব্দ আসছে।

পা বাড়াতে আমার পা দুটোর আড়ষ্টতা টের পেলাম। যেন কত বছর ধরে এই খোলা মাঠের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। মাথার রগগুলোর দাপাদাপি বেড়ে গেছে। আমি যেন হঠাৎ করে স্মৃতিভ্রম হয়ে গেলাম। কতক্ষণ আগে নির্মম ঘাতকের নিশানায় আমাকে দাঁড়াতে হয়েছিল। মনের মধ্যে কোনো সংশয় না এনে আমার খারাপ লাগতে থাকে। মাঠ পেরিয়ে যেতেই নল খাগড়ার ঝোঁপ থেকে শিশির ছিটে এসে পায়ে লাগলো। আমার আবার তীব্র শীত লাগছে।

বুনো ফুলের মিষ্টি গন্ধ পেলাম। খুব পরিচিত। বাস স্টেশন পর্যন্ত আসতে আমার অনেক কথা মনে পড়লো।

একাত্তরের মার্চে কত তারিখ হবে? সম্ভবত এগারো। গণআন্দোলনের উত্তাল ঢেউয়ে ঢাকার জনজীবন প্লাবিত। মালিবাগে আমরা পাশাপাশি বাসায় ভাড়া থাকতাম। বটুর ছিল দুই ভাই, তিন বোন। ভাইদের মধ্যে বটু ছিল ছোট। পড়াশোনায় বটু খুব ভালো ছিল না। মহল্লার অন্যান্য ছেলের সাথে আমার যেমন সহৃদয় সম্পর্ক ছিল বটুর সাথে ছিল না। বটু ছিল একটু বেশি বেপরোয়া মানসিকতার অধিকারী। হঠাৎ করে রেগে সারা মহল্লায় একটু তুলকালাম কা- বাধিয়ে ফেলতো। বটুর বড় ভাই ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত মানসিকতার মানুষ। শান্ত, মার্জিত রুচি, কথা বলার সময় চোখের পাপড়িগুলো অজান্তে একটু বেশি লাফাতো। আমি তাকে কিছুদিন অনুসরণ করেছিলাম। বটুর কী কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল? থাকতে পারে, আমার জানা নেই, বটুকে আমি মনে করতাম হিপোক্র্যাট। জন্মাবধি ওর মধ্যে বোধহয় এক ধরনের অস্থিরতা, আর তার জন্য অনেক মূল্য ওকে দিতে হয়েছে। একাত্তরের মার্চ মাসের এগারো তারিখ মালিবাগ মোড়ে মিছিলে গুলি হয়। বটু সম্ভবত সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিল। মিছিল থেকে আমি দেখলাম বটু কংক্রিটে লুটিয়ে পড়লো। ওর হাত বেয়ে তরতর করে রক্ত ছুটছে। আমি দৌড়ে এলাম। আমাকে দেখে বটু স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চল পিনু। ব্যান্ডেজ করলে রক্ত বন্ধ হয়ে যাবে!’

প্রথমে প্রচ- ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি। বটুর শক্ত মানসিকতা দেখে আমার হাত-পায়ের কাঁপুনি থেমে যায়। মাইনর ইনজুরি। মাংস দিয়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। হাড়ে লাগেনি। ব্যান্ডেজ বেঁধে রিকশা করে বাসায় ফিরতেই ওর বাসার কান্নার শব্দ পেলাম।

আমি ওকে ধরে গেট পেরিয়ে যেতেই বটু বলল, ‘তুই এখন যা পিনু। কষ্ট করলি অনেক।’ এর মধ্যে দৌড়ে এলো ওর মা-বাবা, বোনরা। ওর বড় ভাই সম্ভবত বাসায় ছিল না। আমি তাদেরকে সান্ত¦না দিতে থাকলাম। মহল্লার অনেক মানুষের ভিড় ওদের বাসার সামনে। একসময় সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলে আমি বাইরে বেরোনোর জন্য পা বাড়ালাম। মাঝে একদিন বটুকে দেখতে গিয়েছিলাম। ও দিব্যি বাসায় লনে ক্যারামবোর্ড খেলছে বোনদের সাথে। যেন কিছুই ঘটেনি ওর জীবনে। বাম হাতটার ব্যান্ডেজ খোলা। আমাকে দেখে মিট মিট করে হাসলো। চেয়ার এগিয়ে দিলো ওর এক বোন। তখন অবধি ওর বোনদের নাম আমার জানা নেই।

‘তোর কী মনে হয় শেখ মুজিব স্বায়ত্তশাসন আদায় করতে পারবে?’ বটুর আকস্মিক প্রশ্নের উত্তর দেয়ার খেই হারিয়ে ফেললাম।

‘কাগজপত্রে লিখেছে আলোচনা সন্তোষজনক।’ মৃদু কণ্ঠ আমার।

‘আরে রাখ, যুদ্ধ ছাড়া অধিকার আদায় হবে না মনে রাখিস।’ একটু চড়ে গেলো বটুর গলা। হঠাৎ করে বটু এই সময় রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠলো কেন? আমার মনে প্রশ্ন।

বটুদের বাসায় একটা দীর্ঘ পাইন গাছ ছিল। চমৎকার মসৃণ গাছটার অবয়ব। আমি অতো সুন্দর পাইন গাছ এখনো দেখিনি। আমি গাছটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘হাতটা কেমন এখন? ঘা শুকিয়েছে কি?’

‘ব্যথা নেই এখন। ঘাড়, মুখ কালো হয়ে গেছে।’

বটুর যে বোনটি ওর ক্যারাম খেলার পার্টনার ছিল সে একটু পর চা নিয়ে এলো। সম্ভবত ক্লাস নাইন-টেনে পড়ে তখন। খুব মিষ্টি ছিল ওর চেহারা। মৃদু হেসে বোনটি বলে, ‘চা খান।’

ঐদিন বটুর সাথে আমার শেষ দেখা। তারপর বটুর সাথে আগরতলা ক্যাম্পে দেখা হয়। আমাকে পেয়ে বটু খুশি হয়েছিল। ট্রেনিং শেষ করে মজিদ ভাইর কোম্পানিতে আমরা দুজন ছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বটুর কথা-বার্তার ধরণ ছিল আলাদা।

‘বুঝলি পিনু, রাজনীতির জটিল তত্ত্ব আমার মাথায় ঢোকে না। তবু কেন এ যুদ্ধ করছি, নিজের অস্তিত্বের প্রশ্নে। আমার বিশ্বাস দেশ একদিন স্বাধীন হবেই।’ বটুর বিশ্বাস ছিল। সেই বিশ্বাসের ফসল আজকের এই স্বাধীনতা। যে বটু একদিন নিজের জীবনবাজি রেখে স্বাধীনতা এনেছে সেই বটু কী স্বাধীনতার নষ্ট ফসল!

যুদ্ধের দিনগুলোতে যে বটু শত্রু নিধনের হিংস্রতায় এক বাংকার থেকে আরেক বাংকারে লাফিয়ে পড়তো, স্বাধীনতার দশ বছর পর সেই বটু মারাত্মক মারণাস্ত্র হাতে থাকা সত্ত্বেও খুন করতে হাত কাঁপলো। তবে কী বটু তার সব উদ্দাম, চেতনাবোধ হারিয়ে ভালোবাসার জন্য কাতর হয়ে প্রার্থনা করছে। এই মুহূর্তে বটুর জন্য আমার মমতা বাড়তে থাকে। আমি জানি বটু কতক্ষণ আগে আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। পারেনি। আর পারেনি বলেই বটুর জন্য আমার মমত্ববোধ।

বটু, তুই আমাকে ভুল বুঝিস না, তোর জন্য আমার একটু কোমল হৃদয় আছে। নিশিনেরও আছে। আমরা তোর যন্ত্রণা উপশমের জন্য কোনো প্রক্রিয়া তৈরি করতে পারবো না। স্বাধীনতার এত বছর আয়ুষ্কালে তেমন পরিক্রমণ বেয়ে আমরা এগিয়ে যাইনি। শুধু একটা রক্তাক্ত পথ ছিল আমাদের সম্মুখে। দিন দিন পৃথিবীর সভ্যতা বদলে গেলেও আমাদের দেশ মাটির চেতনায় নাড়া পড়েনি। টোটাল রেজাল্ট এসে দাঁড়িয়েছে অবক্ষয়ী চেহারা নিয়ে, পতপত করে উড়ছে আমাদের গর্বিত পতাকা। স্বদেশ সভ্যতা এভাবে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো এতটা বছর। একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। মিহিন কুয়াশা পড়ছে। শীতে কাঁপছে শরীর। দূরে চা স্টলের সামনে দু-একজন চা-খোরের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। শেষ বাস কি চলে গেছে? বটু বারবার শঙ্কিত হচ্ছিলÑ শেষ বাস চলে যাবে! আরো দশ মিনিট কুয়াশায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর শেষ বাস এলো। মালিবাগ যাবো। বাসে ভিড় নেই। অনেক সিট খালি। পথঘাট বেশ নির্জন হয়ে এসেছে। বেশ দ্রুত চলছে যানটি। সুস্থ কোনো কিছু মাথার মধ্যে কাজ করছে না। মনে পড়ছে লাঞ্চের পর বটু অফিসে গিয়েছিল। কী সব জরুরি কথা আছে। মিরপুর তিন নম্বরে ওরা থাকে এখন। তারপর বটু আমাকে খুন করতে চেয়েছিল।

‘অসময়ে তুমি টেলিফোন করলে কেন? আমি তো ভার্সিটিতে থাকতাম এখন। শরীর খারাপ তাই যাইনি।’

‘আমার মন বলল, তুমি আজ কোথাও যাওনি।’

‘অফিসে গিয়েছো কখন?’

‘এগারোটার দিকে। বার্তা বিভাগের বুলবুল ভাই রাগ করলো একটু। তারপর ঠিক হয়ে গেছে।’

‘কী করছো এখন।’

‘বাথরুম থেকে ফিরলাম।’

‘তুমি?’

‘এক গাধা নিউজ ডেস্কের ওপর, অনুবাদ করতে বসবো।’ একটু ক্লান্ত কণ্ঠ আমার।

‘কি যে চাকরি করো তুমি। একেবারে গাধা।’ ঈষৎ হাসির শব্দ শোনা যায়। দশ সেকেন্ডের জন্য টেলিফোন মরে যায়। একবার ভাবছি রাতের ঘটনাগুলো নিশিনকে বলা যায় কি না। ‘এই কি হলো?’

‘ভাবছি তোমার সঙ্গে আজ দেখা হবে কি না?’

‘আজ কোথাও বের হবো না, শুধু ঘুমোবো।’

‘তোমাকে একটা কথা বলবো নিশিন।’

‘বলো।’

আমি তোমায় বিয়ে করবো এবং খুব শিগগির। অজান্তে গম্ভীর শোনায় আমার গলা। ও পাশের টেলিফোন হঠাৎ যেন মরে গেছে। নিশিনের ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাসের শব্দ আসছে।

‘আমার সামনে পরীক্ষা, মনে আছে তোমার?’ নিশিনের ঈষৎ হাসির শব্দ আসে। আবার নিঃশব্দÑ ‘হঠাৎ এতো তাড়াতাড়ি ডিসিশন নিচ্ছো।’

‘আমি তোমাকে ঠকাতে চাই না। বটু জানুক, আমি তোমাকে সত্যিকার ভালোবাসি।’ শব্দ করে টেলিফোন রেখে দিই। রিং হচ্ছে নিশিন বারবার আমাকে চাইছে। আমি টেলিফোনের ওপর হাত রেখে আছি। আমি জানি নিশিন কী বলবে।

আজ থেকে দুদিন পর নিশিনের সাথে আমার দেখা হবে। এই দুদিন আমার খুব কষ্ট হবে, নিশিনেরও। ওকে উৎকণ্ঠায় রাখা কি আমার সমীচীন হলো। অথচ বিশদ বলার মানসিকতা নেই। নিশিনকে আমি মুখোমুখি বলবো। বটু সম্পর্কে নিশিন খুব মমতাময়ী। যুদ্ধপরবর্তী বটুর জীবনযাপন ছিল অদ্ভুত। রাজনীতি অসচেতন বটু এটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছিল, যাদের জন্য এই মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন ছিল, তাদের মুক্তি আসেনি। বরং আরো প্রকটভাবে শরীর থেকে রক্ত শুষে নেয়া হচ্ছে। তার শিকার কি একা বটু ছিল? উচ্ছৃঙ্খল বটু সাংসারিক মমত্ব চেয়েছিল। পায়নি। বোধহয় নিশিন বাদে কেউ ওকে সুন্দর নজরে দেখেনি। তার ফলে বটু পুরোপুরি বখে যায়। ওদের সংসারে একমাত্র নিশিন বটুর জন্য ফিল করতো! বটু জানতো নিশিন ওর জন্য রাত জেগে থাকে। নিশিন একদিন বলেছিল, বটু নাকি বলে সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য বামপন্থি আন্দোলনের দরকার। তারপর থেকে দুই বছর বটু লাপাত্তা। কেউ কেউ বলতো, বটু পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। আবার ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব একদিন। অস্থির বটু কোনোকালে স্থির ছিল না কর্মে। তাই সাফল্যের স্বাদ পায়নি।

বটু বলে, এদেশের কিছুই হবে না। সব নেতাকে আমার চেনা আছে। নিজকে চেনে শুধু। রাজনীতির নামে শুধু শুধু মৃত্যু। স্বাধীনতার এতটা বছর পর এখনো বটু বাইরে বাইরে থাকে। রাত জেগে চোখের কোনায় কালি পড়ে গেছে। ভালোবাসা ভালোবাসা বলে চিৎকার করছে শুঁড়িখানার গমগমে আসরে। স্বাধীনতা ও পর ঠিকানা চেনে না। মিটমিট করে হাসছিল নিশিন। হালকা নীল শাড়ি পরেছে ও। সামনের বিন্যস্ত চুলগাছি বাতাসে উড়ছে।

‘এত দেরি করলে যে, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি একা।’

‘রাতে ঘুমোতো পারিনি তোমার জন্য।’

‘বা। চলো, ওইখানটায় বসি।’

‘আজ লাইব্রেরিতে যাবে না?’ আমি বলি।

‘পড়াতে মন বসাতে পাচ্ছি না। কি যে হয়েছে আমার।’ মাটির দিকে চোখ রেখে নিশিন বলে।

টিসএসসির বুকস্টল পেরিয়ে লনটায় আমরা সামনাসামনি বসি। ‘কি বলবে কিছু?’

‘বটুর ধারণা আমি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করবো।’ আমি করতলের দিকে তাকিয়ে বলি।

‘বটু ভাই’র সঙ্গে তোমার দেখা হয়।’

‘অফিসে এসেছিল। তারপর তিন নম্বর মনিপুরে এক মাঠের ওপর দাঁড় করিয়ে আমার বুকে পিস্তল চেপে ধরেছিল! মেরে ফেলতে পারতো!’ নিশিন চোখ বড় করে বলে, ‘কারণ? তোমরা বন্ধু ছিলে একসময়। একাত্তরে একসাথে যুদ্ধ করেছো?’

‘করেছি। আর এই জন্য খুব শিগগির আমাদের বিয়ে হওয়া উচিত। বটু জানুক আমি একাত্তরের পিনুই রয়েছি।’

নিশিনের চোখ ছলছল করে ওঠে। ‘আমাদের ফ্যামিলিতে একমাত্র আমার জন্য ওর দুর্বলতা। মাঝে মাঝে এই এলাকায় দেখা হয়। বাড়ি যায় না আজকাল। কোথায়-কোথায় থাকে? অনেকে বিয়ে করলে ঘর নেয়!

বটু ভাই সেই রকম নয়। কী সব পার্টি করতো একসময়, এখন কী যে করে।’ ভাবগম্ভীর নিশিনের কণ্ঠ। ‘তোমার জন্য ও ভাবে।’

‘আমাকে খুশি দেখলে ও খুশি হতো বড় ভাইয়া বটু ভাইর মতো নয়। বটু ভাই একটু বেশি আন্তরিক। বড় ভাই আগে আন্তরিক ছিল। সরকারি আমলা হওয়ার পর বদলে গেছে। কেউ বটু ভাইর জন্য ফিল করে না।’ নিশিনের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে থাকে। অনেকক্ষণ দু জনেই নিশ্চুপ থাকি।

‘বটু ভাইর সঙ্গে দেখা হলে বলো, তাকে আমার প্রয়োজন? আজ আমার মন ভালো নেই। তোমার সাথে পরে কথা বলবো!’ নিশিনকে ভয়ানক বেদনার্ত মনে হয়। ধীর পায়ে টিএসসির মোড় পর্যন্ত হেঁটে এলাম। সপ্তাহখানেক পর হঠাৎ অফিসে টেলিফোন করলো বটু।

‘পিনু আমি সমাজটাকে পাল্টে দিতে চাই?’ দশ সেকেন্ড নিস্তব্ধ। বটুর কথার ধরন ওই রকম। আমি বললাম, ‘আন্দোলন ছাড়া সম্ভব কি?’

‘প্রথমে সুবিধাবাদী খতম করে দিতে হবে। কারণ সবচেয়ে মারাত্মক এলিমেন্ট এইগুলো। তোর কি ধারণা?’

আমি গম্ভীর গলায় বলি, ‘আমাদের নেতারাই সবচেয়ে ক্ষতিকর এলিমেন্ট। সঠিক পথ তাদের জানা নেই, শুধু হাউকাউ।’

সহসা ওপাশের টেলিফোন মরে যায়। আমি জানি বটুর কাছে এর উত্তর নেই। ও পথ খুঁজে পায়নি বলেই স্বাধীনতার দশ বছর পর আজও ঘরের বাইরে রাত কাটায়।

‘নিশিন তোর সাথে দেখা করতে চেয়েছে।’

খুব ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বটু উত্তর করে, ‘নিশিনকে তুই বিয়ে কর পিনু! ও খুব ভালো মেয়ে।’

বটুর এই রকম কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। ধারণায় এলো ও একদিন এই জন্য আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।

‘নিশিনের ধারণা তুই তার অনেক কথাই মেনে নিবি।’ মৃদু উত্তর আমার।

‘জানিস পিনু, একমাত্র নিশিন আমার জন্য ভাবে।’ খুব বেদনার্ত মনে হলো ওকে।

‘ওর জন্য তুই ভাবিস।’

টেলিফোন রেখে দিলাম। শব্দ করে বটু টেলিফোন রেখে দেয়। আনন্দ-দুঃখ মিলিয়ে আমার খুব কান্না পেতে থাকলো।

আগামী বাইশ তারিখে আমার-নিশিনের বিয়ে। আজ পনের তারিখ। নিশিন প্রতিদিন অফিসে টেলিফোন করে। টেলিফোনে ওর কথাগুলো রহস্যময়। আমার বুক দুরু দুরু করে। নিশিনকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে। বাইশ তারিখ যে কতদূর?

বিয়ের আগের দিন বটুর সাথে টেলিফোনে কথা হলো। বটু খুব খুশি। বিয়েতে বটু থাকবে না। ওর খুব দুঃখ। নিশিন কাঁদবে। নিশিন বটুর খুব আদুরে।

বিয়ের দিন নিশিনকে মনে হলো, মৌন মূক। ওদের সংসারের সবাই জানে বটু এই বাড়িতে কোনোদিন ফিরবে না।

আমাদের বিয়ের অনেক দিন পরও বটুর দেখা নেই। নিশিন কথায় কথায় আঁচলে চোখ মোছে। বটুটা যে কি?

তারও অনেকদিন পর বটুর মৃতদেহ আবিষ্কার হলো নীলক্ষেতের এক ড্রেন থেকে। পুলিশ রিপোর্টে বলা হলো, ‘দুষ্কৃতকারীরা হত্যা করে এখানে ফেলে গেছে। খুনিদের হদিস পাওয়া যায়নি। জোর তদন্ত চলছে।’

আমি জানি যুদ্ধের দিনগুলোতে যেসব মানুষের মুক্তির জন্য বটুরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, আজ স্বাধীনতার এত বছর পর অনেক স্বপ্নের মৃত্যু ঘটিয়ে একদিন চিৎপাত মরে যাচ্ছে। নিশিনের মতো মমতাময়ীর জন্য বন্ধুর বুকে পিস্তল ঠেলে ধরছে। আবার মুক্তির জন্য এক বাংকার থেকে আরেক বাংকারে লাফিয়ে পড়ছে। স্বাধীনতা এদের ঠিকানা চেনে না।

(ঢাকাটাইমস/২৮আগস্ট/এজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :