প্রবাস জীবন দেয়ালবিহীন কারাগার!
প্রয়াত বরেণ্য সাংবাদিক মিনার মাহমুদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বসবাস করার লক্ষ্যে চলে যাবার সময়, আমার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-প্রবাস জীবন দেয়ালবিহীন কারাগার। তাঁর সাক্ষাৎকার (আমার সম্পাদিত) আজকাল পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেদিন কথাটির মর্মার্থ গভীরভাবে উপলব্ধি করিনি। যদিও আমি বাংলাদেশে বসবাস করার স্বপ্ন দেখি, তারপরও এই সমাজ ব্যবস্থার প্রতি দুর্বলতা রয়েছে।
এর অন্যতম কারণ, উন্নত চিকিৎসা সেবা, সন্তানদের শিক্ষা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এবং নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা। আরও কিছু সুফল আছে। তবে একটা কথা আমরা ভাবি না। সেটি হলো-এ দেশে আমাদের সন্তানরা বড় হচ্ছে, একইসঙ্গে নিজের শেকড় থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য শিকড়ে সম্পৃক্ত হচ্ছে।
প্রবাসে আমরা যারা প্রথম প্রজন্ম, তারা শুধু কষ্ট করে সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে ব্যস্ত। সন্তানরা পরে কী করবে, কতটা প্রতিদান দেবে বা পিতা-মাতার ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেবে কি না-এ কথা কোনো অভিভাবক নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না।
এতো প্রাপ্তির বিপরীতে ‘হারানোর চোরাবালি’ আমাদের সামনে। অনেক আলোর মধ্যে গভীর হতাশার অন্ধকারও ঘাপটি মেরে আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখানে আমাদের সন্তানরা বড় হচ্ছে, আর যেন শিথিল হয়ে আসছে সংসারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। যেন পাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে উড়ে যাবার জন্য।
আমাদের সঙ্গে আমাদের সন্তানদের জীবন বোধ, সমাজকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি, দায়িত্ববোধ, মমত্ব, পিছুটান, ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালবাসার ক্ষেত্রে পার্থক্য লক্ষ্যণীয়। আমরা যেভাবে জীবনকে দেখি, তারা সেভাবে দেখে না। আমাদের ভালবাসায় গভীর মমত্ববোধ থাকে, ওদের আচরণে তেমন প্রতিফলিত হয় না। মুখে তারা ভালবাসার কথা প্রকাশ করে, তবে অন্তরে কতটুকু ধারণ করে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ওরা যে নাগরিক জীবনে অভ্যস্থ হচ্ছে, এতে ছুটে চলার মন্ত্রণা বেশি।
আমরা নিজের দেশে যেতে যতটা আগ্রহী, ওরা এখানে থাকতেই আগ্রহী। দেশ, স্বজন, নিকটাত্মীয়, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে আমরা প্রবাসী হয়ে যে আত্মত্যাগ করেছি-তা সফল হতে পারে-একটি মাত্র কারণে। তা হচ্ছে-নিজের সন্তান লেখাপড়া শেষ করে নিজের সংস্কৃতির বলয়ে সজ্জন ‘মানুষ’ হিসাবে পরিচিত লাভ করলে। এ ঘটনা ঘটছে না, তা নয়। আবার প্রবাসে পড়ে থাকা অনেক পরিবারে সন্তানদের নিয়ে পিতা-মাতার মনে অসন্তোষ জন্ম নিচ্ছে। আফসোস করেন তারা। তারা মনে করেন-প্রবাস জীবন মানে দেয়ালবিহীন কারাগার।
আমার মনেও এমন ভাবনা আসে। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবি-ওরা কি হারিয়ে যাবে এই সমাজ ব্যবস্থার চোরাবালিতে। যদি এমন হয়-তাহলে তো আত্মগ্লানিতে পুড়তে হবে। নিজে নিজে ফের মনকে বলি-জীবন যেখানে যেমন, বেঁচে থাকাটাই বিস্ময়কর ঘটনা!
লেখক: আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক