চামড়ার দরপতন কেন?

প্রকাশ | ৩১ আগস্ট ২০১৮, ১০:৪২

কাওসার রহমান
ফাইল ছবি

কোরবানির ঈদ হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী চামড়াশিল্পের কাঁচামালের সবচেয়ে বড় উৎস। দেশে উৎপাদিত চামড়ার ৬০ শতাংশই সংগৃহীত হয় কোরবানির ঈদের সময়। আর এই চামড়াকে কেন্দ্র করে এই সময়ে আবর্তিত হয় চামড়া অর্থনীতির। যে অর্থনীতির মাধ্যমে শহর থেকে গ্রামে অর্থ প্রবাহিত হয়। এতে চাঙ্গা হয়ে উঠে গ্রামীণ অর্থনীতি।

যুগ যুগ ধরে এই ধারা চলে আসলেও গত তিন দশক ধরে এই সুস্থ ধারাকে কলুষিত করে ফেলছেন চামড়াশিল্পের উদ্যোক্তারা। যেহেতু চামড়ার শেষ গন্তব্যস্থল চামড়াশিল্প, সেই সুযোগটাই তারা কাজে লাগাচ্ছেন খুব ধীরে-সুস্থে পরিকল্পনামাফিক। চামড়া নিয়ে তাদের নোংরা খেলার সর্বশেষ নজির সৃষ্টি করলেন এবার কোরবানির ঈদে। তাদের কারসাজির কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবার সর্বনি¤œ দামে চামড়া কেনাবেচা হয়েছে। ন্যায্য দাম প্রদান তো দূরের কথা, এ বছর চামড়া কেনার আগে এমন অবস্থা তৈরি করা হয়েছে যে, কোরবানিদাতারা এক প্রকার চামড়া ফেলে দিয়েছেন।

চামড়াশিল্পের উদ্যোক্তাদের এই ন্যক্কারজনক ঘটনার সহযোগী হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত ছয় বছরের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবার সরকারিভাবে চামড়ার সর্বনি¤œ দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। ছয় বছর আগে বিক্রি হওয়া ৮৫ থেকে ৯০ টাকা বর্গফুট দরের লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম এবার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। আর লবণবিহীন চামড়ার দাম আরও কম হবে স্বাভাবিকভাবেই।

বছর ঘুরলেই সব জিনিসের দাম বাড়লেও কেবল কমছে চামড়ার দাম। অথচ দেশে কি বিদেশে চামড়াজাত পণ্যের দাম বাড়ছে। তাহলে চামড়ার দাম কমবে কেন? চামড়াশিল্পের উদ্যোক্তাদের উত্তর হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা কম। এজন্য দামও কম। এ বক্তব্য দেশের চামড়াশিল্পের উদ্যোক্তারা গত ৩০ বছর ধরেই দিয়ে আসছেন। এবার বরং তার সঙ্গে যুক্ত করেছেন চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ। গত ৩০ বছরে কোনো বছরই উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে শোনা যায়নি আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা বেশি। দামও বেশ চড়া। এভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে চামড়া ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে আসছেন দেশের ট্যানারিশিল্পের মালিকরা।

এবারও ঈদুল আজহার আগে ট্যানারির মালিকরা বাণিজ্যমন্ত্রীকে রাজি করিয়ে ঢাকায় কোরবানির গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, আর রাজধানীর বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণ করেছে। একইভাবে সারা দেশে খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং বকরির প্রতি বর্গফুট চামড়া ১৩ থেকে ১৫ টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট কোরবানির গরুর চামড়ার দর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, আর ঢাকার বাইরে দর ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়ার দর সারা দেশে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল ২০ থেকে ২২ টাকা ও বকরির চামড়ার দর ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল ১৫ থেকে ১৭ টাকা। যদিও আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন কোরবানির পশুর চামড়ার দর রাজধানীতে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৫৫-৬০ টাকা, রাজধানীর বাইরে ৪৫-৫০ টাকা, সারা দেশে খাসির চামড়া ২৫-২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণে সুপারিশ করেছিল। মন্ত্রণালয় সেই সুপারিশ গ্রহণ না করে জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ধরনের একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। ফলে প্রশ্ন উঠেছে মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে এভাবে চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেওয়ার এখতিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আছে কি না?

সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া দামের প্রতিফলনই পড়েছে এবার চামড়ার বাজারে। ঢাকায় এবার ফড়িয়া বা মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা গড়ে পাঁচশ টাকায় চামড়া কিনেছেন। আর রাজধানীর বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানে চামড়া কেনাবেচা হয়েছে গড়ে চারশ টাকায়। এর আগে কখনো এত কম দামে চামড়া কিনতে পারেননি ফড়িয়ারা। আর আড়তদার এমনকি ট্যানারি মালিকরাও বলছেন, গত তিন দশকে চামড়ার দাম এত কমেনি। চামড়ার এই দাম কমে যাওয়ায় প্রচ- ক্ষুব্ধ হয়েছেন কোরবানিদাতারা। অনেক স্থানে এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও দেখা গেছে। কাঁচা চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ার কারণে অনেকেই ফড়িয়াদের কাছে চামড়া বিক্রি না করে মাটিতে পুঁতে রেখেছেন। এ নিয়ে ফেসবুকে পোস্টও দিয়েছেন কেউ কেউ। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি জেনারেল মোজাম্মেল হক চৌধুরী তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘৮২ হাজার টাকা দামের মহিষের চামড়া ৬০ টাকায় বিক্রি না করে মাটিতে পুঁতে রাখলাম। ভালো করলাম না মন্দ করলাম।’ পাবনার ভাঙ্গুড়ার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী রইচ উদ্দিন বলেছেন, ‘৩০ বছর আগে ১৯৮৯ সালে কোরবানির ঈদে পশুর মালিকরা সাতশ টাকায় চামড়া বেচেছেন। এবার সেই মানের চামড়া কেনা সম্ভব হয়েছে পাঁচশ টাকারও কম দামে।’

শহরের চেয়ে গ্রামের কোরবানিদাতারা এবার বেশি ঠকেছেন। গ্রামের বড় আকারের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে আড়াইশ থেকে তিনশ টাকার মধ্যে। রাজশাহী মহানগরীর তেরোখাদিয়া এলাকার বাসিন্দা করিম বলেন, ৭৮ হাজার টাকা মূল্যের গরুর চামড়া তিনি বিক্রি করেছেন মাত্র ৪শ টাকায়। ছাগলের চামড়া এবার মাত্র ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৮০ টাকায় কিনেছেন ব্যবসায়ীরা। ভেড়ার চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ২০ থেকে ৫০ টাকায়। কোরবানির চামড়া সাধারণত মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করা হয়। অনেক কোরবানিদাতা আবার চামড়া বিক্রি করে সে টাকা দুস্থদের মাঝে বিতরণ করে দেন। মসজিদ-মাদ্রাসা কমিটির কাছে দান করা চামড়ার দামও ওঠেনি এবার। বেশি সময় ধরে রাখলে চামড়া নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই পচে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় প্রায় সবাই এবার কম দামেই চামড়া বিক্রি করেছেন।

ট্যানারি মালিকরা এবার অবস্থা এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন যে, সরকার নির্ধারিত দামেও তারা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কিনছেন না। তারা আরও কম দামে অর্থাৎ একপ্রকার বিনামূল্যে চামড়া চায়। ফলে কোরবানির পশুর চামড়া কিনে বিপাকে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও। সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনেও ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে না পারায় ঢাকাসহ সারা দেশের মৌসুমি ব্যবসায়ীদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। আবার অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী কাক্সিক্ষত দামে চামড়া বিক্রি করতে না পারায় পরে বেশি দামে বিক্রির আশায় নিজেরাই লবণ মেখে চামড়া সংরক্ষণ করছেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কাঁচা চামড়ার আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লোকসানে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এদের যৌথ সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নামমাত্র মূল্যে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে।

বিকাশমান শিল্পের মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশে চামড়াশিল্প অন্যতম। তৈরি পোশাকশিল্পের পরই সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে। ২০২১ সালের মধ্যে এই খাত থেকে আয় পাঁচশ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত চামড়ার পাশাপাশি চামড়া থেকে তৈরি জুতা, ব্যাগ, জ্যাকেট, হাতমোজা, ওয়ালেট, বেল্ট, মানিব্যাগসহ চামড়ার তৈরি হস্তশিল্প পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

বৈশ্বিক হিসাবে চামড়ার বড় বাজারগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ইতালি, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ব্রাজিল, রাশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, স্পেন, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া ও তাইওয়ান। তবে বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা জাপান। শুরু থেকেই এই দেশটি বাংলাদেশে তৈরি চামড়ার জুতায় ‘ডিউটি ও কোটা ফ্রি’ সুবিধা চালু রেখেছে। চামড়াজাত পণ্যের মোট রপ্তানি পণ্যের ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশই যায় জাপানে। এখন বাইরের দেশগুলোতেও দেশে উৎপাদিত জুতার বাজার প্রসারিত হচ্ছে।

উল্লেখ্য, এবারের কোরবানির ঈদে ১ কোটি ১৫ লাখ পশুর কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এসব পশু থেকে চলতি বছরে ৩৩ কোটি বর্গফুট চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কোরবানি ঈদে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ কোটি বর্গফুট। বাকি ১৩ কোটি বর্গফুট চামড়া বছরজুড়ে সংগ্রহ করা হবে। এর আগে ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছিল যথাক্রমে ২৮ কোটি ৫০ লাখ বর্গফুট, ৩০ কোটি বর্গফুট এবং ৩১ কোটি ৫০ লাখ বর্গফুট।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবমতো, দেশে উৎপাদিত চামড়ার ৬০ শতাংশই কোরবানির ঈদে সংগ্রহ করা হয়। যার মধ্যে গরুর চামড়া ৬৫ শতাংশ, মহিষের চামড়া ২ শতাংশ, খাসির চামড়া ৩২ শতাংশ এবং ভেড়ার চামড়া ১ শতাংশ।

বর্তমান পরিস্থিতিতে চামড়াশিল্পের মূল দেশীয় কাঁচামাল চামড়া নিয়ে যদি এভাবে চক্রান্ত ও কারসাজি চলতে থাকে তাহলে খুব শিগগিরই এই বড় উৎসটি নষ্ট হয়ে যাবে। এভাবে চামড়ার কম দাম অব্যাহত থাকলে চামড়ার প্রতি কেউ মনোযোগী হবে না। এমনিতেই সঠিকভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ না করায় প্রতি বছর সংগৃহীত চামড়ার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। ভবিষ্যতে এ নষ্ট হওয়ার পরিমাণ আরও বাড়বে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কেউ আর সঠিকভাবে চামড়া সংগ্রহ করবে না। ফলে কাটাছেড়ার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে অনেক চামড়া নষ্ট হবে। আবার অনেকে চামড়া বিক্রি না করে মাটিতে পুঁতে রেখে দেবে। কিংবা বিক্রি না করে ডাস্টবিনে ফেলে দেবে। ফলে সস্তায় চামড়া কিনতে গিয়ে ট্যানারি মালিকরা আর মানসম্পন্ন চামড়া পাবে না। এতে ট্যানারি মালিকরা লাভবান হলেও দেশ বঞ্চিত হবে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে।

আবার চামড়া ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেট মুক্ত করতে না পারলে মূল্যবান এই চামড়া বিদেশে পাচার হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যাবে। এরই মধ্যে সারা দেশের বড় বড় আড়তগুলোতে চামড়া সংগ্রহের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম সংগ্রহ হয়েছে। আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা চামড়ার দাম কম বলায় অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া বিক্রি না করে নিজেরাই লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করছেন। এইসব চামড়া পরবর্তীতে প্রতিবেশী দেশে পাচার হওয়ার আশঙ্কা থাকছে।

ট্যানারি মালিকরা গত ৩০ বছর ধরেই বলে আসছেন আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম ভালো না। চাহিদা কম। কিন্তু তার বিপরীতে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা যেমন দিন দিন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মূল্যও। গত অর্থবছরে চামড়া রপ্তানির চেয়ে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে আয় বেশি হয়েছে। যদিও তাই হয়, তাহলে দেশ থেকে চামড়া রপ্তানি নিষিদ্ধ করা উচিত। তার বদলে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে আরও বেশি উৎসাহ দেওয়া উচিত। অর্থাৎ চামড়ার পরিবর্তে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকে উৎসাহিত করা উচিত। এতে বরং দেশ লাভবান হবে। কারণ চীনসহ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শ্রমের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় তাদের জন্য চামড়া আমদানি করে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন লাভজনক নয়। বরং তাদের জন্য চামড়াজাত পণ্য আমদানি লাভজনক। সেই দিকটি বিবেচনা করলেও দেশ থেকে চামড়া রপ্তানি নিষিদ্ধ করা উচিত।

কাওসার রহমান: নগর সম্পাদক, দৈনিক জনকণ্ঠ