ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত পয়ঃশোধনাগার

সেবা পাবে ৫০ লাখ নাগরিক

প্রকাশ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:০১ | আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:০৫

কাজী রফিকুল ইসলাম

ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা) নগরবাসীকে দরকারমতো পানি সরবরাহে অনেকটাই সফল। কিন্তু পয়ঃনিষ্কাশনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা কী? খোদ ওয়াসার তথ্য হচ্ছে, ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ এলাকা এখনো পরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার বাইরে আছে। এই যখন অবস্থা তখন যুগোপযোগী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। তাদের ভাষায় যা ‘টেকসই পয়ঃব্যবস্থাপনার একটি পদক্ষেপ।’ এই পদক্ষেপই হচ্ছে খিলগাঁওয়ের ‘দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প।’

১৯ আগস্ট রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই আয়োজনে সভাপতি ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব জাফর আহমেদ খান, চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুয়ো এবং ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বক্তব্য দেন। সেদিন প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট একটি ভিডিও উপস্থাপনায় জানানো হয়, তিন হাজার ৩১৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প ২০২০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। মূল ব্যয়ের এক হাজার ১৩৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয় করছে বাংলাদেশ সরকার। বাকি দুই হাজার ১৮৪ কোটি টাকা প্রকল্প সহায়তা দেবে চীনের এক্সিম ব্যাংক। ২৪ হেক্টর জমির ওপর বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনের মাধ্যমে ৫০ লাখ নগরবাসীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। একই সঙ্গে পানি ও বায়ু অনেকটাই দূষণমুক্ত থাকবে।

নগরবিদরা বলছেন, দাশেরকান্দির প্রকল্প নিঃসন্দেহে দারুণ এক উদ্যোগ। কিন্তু এখন পর্যন্ত নাকালই হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবীব এই সময়কে বলেন, ‘আমাদের পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা অপ্রতুল। ওয়াসা যে সেপটিক ট্যাংক সিস্টেমে কাজ করছে, এই জনবহুল নগরে তা কোনো সমাধান হতে পারে না।’

বর্তমান সংকট উত্তরণেই দাশেরকান্দি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসা সূত্র জানায়, জাতিসংঘ ঘোষিত ‘এসডিজি-২০৩০’ সামনে রেখে কাজ করছে সরকার। তার জন্য রাজধানীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর অংশ হিসেবে নির্মিত হতে যাচ্ছে পয়ঃশোধনাগার। ৫০০ এলএমডি ক্ষমতাসম্পন্ন পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ, আফতাবনগরের প্রধান রাস্তা বরাবর ৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ পয়ঃসঞ্চালন লাইন নির্মাণ, ১টি পয়ঃলিফটিং স্টেশন নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়।

জানা যায়, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের মাধ্যমে স্যুয়ারেজ লাইনের বর্জ্য চলে যাবে শোধনাগারে। সেখান থেকে নিষ্কাশিত হবে পরিশোধিত পানি। পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন করে পরিষ্কার পানি হিসেবে খালে ফেলা হবে। পরিশোধিত বর্জ্য থেকে হবে সিমেন্ট তৈরির অন্যতম উপকরণ ফ্লাই অ্যাশ। এ বিষয়ে সিমেন্ট কোম্পানির সঙ্গেও চুক্তিতে যাবে ঢাকা ওয়াসা।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশন করতে ঢাকা ওয়াসার মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় নির্মিত হচ্ছে এ শোধনাগার। এর মাধ্যমে প্রায় ১৮টিরও বেশি এলাকার বর্জ্য শোধন করে নিষ্কাশিত হবে বালু নদীতে। গুলশান, বনানী, বসুন্ধরা, বারিধারা, বারিধারা ডিওএইচএস, বাড্ডা, ভাটারা, বনশ্রী, কুড়িল, সংসদ ভবন এলাকা, শুক্রাবাদ, ফার্মগেট, আফতাবনগর, নিকেতন, সাঁতারকুলসহ প্রায় ৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকা থেকে সৃষ্ট ৫০০ মিলিয়ন লিটার পয়ঃবর্জ্য প্রতিদিন পরিশোধন করা সম্ভব হবে এই প্রকল্পে। এছাড়া এই প্রকল্পের আওতাধীন পয়ঃসঞ্চালন লাইন নির্মাণ হলে প্রকল্পটি হাতিরঝিল এলাকার পানির গুণগত মানোন্নয়নেও বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে দাবি করছে ঢাকা ওয়াসা।

এদিকে দাশেরকান্দি প্রকল্পের মূল পরিকল্পনার কাজটি বাস্তবায়ন করছে কোরিয়ার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হানকুক ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্সি। যার প্রায় ৬৬ শতাংশ অর্থায়ন করছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। প্রকল্পটি চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাইড্রো চায়না করপোরেশনের মাধ্যমে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হবে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এই কাজ শতভাগ শেষ হবে বলে আশা করছে ঢাকা ওয়াসা। এ প্রসঙ্গে প্রকৌশলী গাজী হাবীবুল হায়দার এই সময়কে বলেন, ‘এটি একটি বড় প্রকল্প। রাজধানীর বিশুদ্ধ পানির যে সমস্যা, তা আমরা প্রায় সমাধান করতে সক্ষম হয়েছি। পরিবেশ যেন দূষিত না হয়, এখন সেদিক নিয়ে ওয়াসা কাজ করছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা আরো বড় ছিল। জমির সংকট আছে, সেই সঙ্গে আমাদের লোকবল কম। সংকট না থাকলে আমরা পরিশোধিত বর্জ্য থেকে সার তৈরির পরিকল্পনা করছিলাম। আশা করছি, আমাদের পরবর্তী প্রকল্পগুলোতে পরিশোধিত বর্জ্য থেকে সার, গ্যাস তৈরির প্ল্যান করার চেষ্টা থাকবে।

দাশেরকান্দি প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. মোহসেন আলী মিয়া জানিয়েছেন, পয়ঃশোধনাগারটি হবে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তর পয়ঃশোধনাগারগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষে সংশ্লিষ্ট এলাকায় পরিবেশ দূষণ উল্লেখযোগ্য হারে কমবে বলে তিনি মনে করছেন।

আরো চার পয়ঃশোধনাগার

পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর অংশ হিসেবে রাজধানীতে আরও চারটি পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে সরকারের। এতে পাগলায় বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় দুটি এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগিতায় রায়েরবাজার ও উত্তরায় আরও দুটি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। তবে এগুলো বাস্তবায়নে দরপত্রের মাধ্যমে কাজ করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা ওয়াসার সংশ্লিষ্টরা।