উন্নয়নের ঢাকা

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৪:৩২

পুরানা পল্টন আজ স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে; তাই তার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা ক’রে শুধু তার সৌন্দর্য উজ্জ্বল হয়ে আমার মনে ফুটে উঠছে; বর্তমানে যাকে নিয়ে সম্পূর্ণ সুখী হতে পারিনি, আজ অতীতের প্রেক্ষিতে তাকে একান্তরূপে ভালোবাসছি। বাস্তবে যার মধ্যে অনেক অভাব ছিলো, স্মৃতিপটে তার যে ছবি উঠলো, দেখলুম তাতে কোনো খুঁত নেই। আজ যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর কোন জায়গা, আমি অনায়াসে উত্তর দিই: পুরানা পল্টন।

(‘পুরানা পল্টন’ হঠাৎ আলোর ঝলকানি: বুদ্ধদেব বসু)

অনেক আগের কথা। কম করে হলেও ৮০ বছর তো হবেই। ওই সময়টায় ঢাকা কেমন ছিলÑতার কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিচারণে। স্মৃতি আউড়ে কবি যে ঢাকাকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, তা এক সুরম্য নগর।

১৯১২ সালে প্রকাশিত ফ্রান্সিস ব্রাডলি-বার্টের বই ‘দ্য রোমানস অব অ্যান ইস্টার্ন ক্যাপিটাল’-এ বর্ণিত ঢাকা ছিল এক আনন্দনগর। সবুজ ফসলের মাঠ ছিল এখানে। ছিল নদী, সরোবর। প্রকৃতির হাতে গড়া স্বাপ্নিক এক জনপদ। তিলোত্তমাই বটে।

১৯৮০ সালে তিলোত্তমা ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৩০ লাখ। ধীরে ধীরে রাজধানীর কদর বেড়েছে। মানুষ শহরমুখী হয়েছে। শস্য-শ্যামল, মাটির মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছেন ভাগ্যের সন্ধানে; জীবিকার সন্ধানে; নতুন জীবনের আশায়। মানুষ বেড়েছে। সেই সাথে বেড়েছে বসতি। এখন ঢাকায় বাস করছে ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ২ লাখ লোক বসবাস করে এখানে। এ তথ্য দিচ্ছে বিশ^ব্যাংক।

নগরিয়ায় নাগরিকের পাশাপাশি নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিও থেমে নেই। ফ্রান্সিস ব্রাডলি-বার্ট কিংবা বুদ্ধদেব বসুর সেই তিলোত্তমার শ্যামলী মায়া হয়তো অনেকটাই ম্লান হয়েছে, নদী, সরোবর অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে; কিন্তু নাগরিক জীবনের তাগিদে উন্নয়নের পথেও এগিয়েছে বেশ। বিশেষ করে গত সাড়ে ৯ বছরে ঢাকায় যে উন্নয়ন হয়েছে তা বিগত কয়েক দশকের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

শুধু নাগরিক জীবনই নয়, দেশের অর্থনীতির মূল শক্তিকেন্দ্র এই ঢাকা। জিডিপিতে ঢাকার অবদান ২০ শতাংশের বেশি। অতিরিক্ত জনসংখ্যা, ঘনবসতি, বস্তি সমস্যাÑ এত কিছুর পরও ঢাকা এখন উন্নয়নের নগরী। নাগরিক জীবনকে নির্বিঘœ করতে ঢাকার আবাসিক ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত এবং সড়ক ব্যবস্থাপনায় এসেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। বাস্তবায়নের পথে থাকা প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে তিলোত্তমা ঢাকা আধুনিক এক নগরীর মর্যাদার মুকুট পরবে।

ঢাকার ভৌগোলিক অবস্থা এখনো নান্দনিক। চারপাশে নদী ঘেরা এই শহর। মানুষের অসচেতনতার কারণে নদীগুলো আপন পরিচয় হারাতে বসেছিল এক সময়। তুরাগ-বালু-বুড়িগঙ্গা হারানো জৌলুস আবারও ফিরে পেতে শুরু করেছে। হারানো পথ খুঁজে পেয়েছে তুরাগ। স্রোত ফিরে পেয়েছে বালু। বুড়িগঙ্গার দূষণ পুরোপুরি না থাকলেও নতুন করে দূষিত হওয়া বন্ধ হয়েছে। দখলে দখলে আঁটোসাঁটো এই নদী হাত-পা মেলার জায়গা পেয়েছে।

ভাওয়াল রাজার রাজত্বের অংশ ছিল হাতিরঝিল। হাতির পাল এখানকার স্বচ্ছ সরোবরে ¯œান করতো। পানি পান করতো। সেই থেকেই এটি হাতিরঝিল। রাজা তাঁর রাজত্ব হারিয়েছেন বহু আগে। সেই সাথে তাঁর সম্পত্তি অনাদর-অবহেলায় বেহাত হয়।

এক পর্যায়ে দূষণ, দখল, অযতেœ শ্রীহীন হয়ে পড়ে হাতিরঝিল। ঝিল লাগোয়া বেগুনবাড়ি খালটির অবস্থাও ছিল বেহাল। যারা পারলো ঝিল ভরাট করল। যারা সাধ্যে কুলিয়ে উঠতে পারেননি, তারা বাঁশ আর টিনের ছাপড়া তুলে আড়াল করেছিল ঝিলের পানি। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে নাগরিক সৃষ্ট বর্জ্যে বর্জ্যে একাকার হয়ে গিয়েছিল হাতিরঝিল। আর কিছুদিন গেলে হয়তো হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ি খাল অস্বস্তি হারাতো পুরান ঢাকার ধোলাইখালের মতো। কল্যাণপুরের খালের মতো থেকে যেতো কাগজে-কলমে।

সেই হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি খাল এখন ঢাকার হৃৎপি-। রাজউক, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং ঢাকা ওয়াসার যৌথ উদ্যোগে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রাণ ফিরে পায় ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এই জলাশয়।

২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন। ওইদিন ঝিলের স্বচ্ছ জলে নৌকা বাইচ দেখতে ভিড় করেছিল হাজারো মানুষ। ঢাকার বুকে চোখ ধাঁধানো এই প্রকল্পটি শহরের মানুষের জন্য নাগরিক বিনোদনের কেন্দ্র হয়েছে। সূর্য পশ্চিমের জলে হারিয়ে যাওয়ার পর অন্যরকম এক জগৎ তৈরি করে সাইনো সাইডাল আর ট্রাংগুলার ব্রিজের আলোকসজ্জা, যা দেখে ঘরে ফেরা পাখির চোখের বিস্ময় আর কাটে না।

খুব বেশি আগের কথা নয়। কুড়িল ফ্লাইওভার চালু হওয়ার আগেও ঢাকা-ময়মনসিংহ ডাইভারশন সড়কে ভয়াবহ যানজট ছিল। কুড়িল বিশ^রোডের যানজটের কথা মনে হলে নাগরিক স্বস্তি সফেদ পায়রার মতো উড়ে যেতো। গাজীপুর থেকে টঙ্গী, উত্তরা, বিমানবন্দর হয়ে মগবাজার বা ফার্মগেট হয়ে শাহবাগ যাওয়ার কথা যারা ভাবতেন, তাদের অতিরিক্ত তিন ঘণ্টা হাতে নিয়ে বের হতে হতো। তা না হলে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো দুরূহ কাজ ছিল। একই অবস্থা ছিল কুড়িল থেকে মৌচাকের দিকে চলে যাওয়া প্রগতি সরণির। কুড়িল ফ্লাইওভার খুলে দেওয়ার পর রাজধানীর উত্তরাঞ্চলের জনজীবনে স্বস্তি ফিরেছে।

পুবের আকাশে সূর্য ওঠার মতো রামপুরার রাস্তায় যানজট ছিল অবধারিত। এই পথ যেন শেষ হতেই চাইতো না। এখন এসবই অতীত। রামপুরার রাস্তার দুই প্রান্তে এবং মধ্যবাড্ডার সড়কের দুই প্রান্তে বাহু বিছিয়েছে ইউলুপ। যান চলাচল সহজ হয়েছে। এখন আর কাউকে যানজটে আটকে থাকতে হয় না। প্রগতি সরণির এই রাস্তার শ্রী বেড়েছে। বদলে গেছে চিত্র।

মগবাজার আর মৌচাক সড়কের অব্যবস্থাপনা দেখেনি এমন লোক ঢাকায় খুঁজে পাওয়া কষ্টই হবে। মগবাজার মোড়ের যানজট আর মৌচাকের যাচ্ছেতাই সড়ক ব্যবস্থাপনা নগরবাসীর জন্য ছিল অসহনীয় ভোগান্তির। পাটের আটির জট খোলা সহজ হলেও মগবাজার আর মালিবাগের যানজট সহজে খুলতো না। এখন নেই।

সাতরাস্তা পার হয়ে উঠে যাওয়া সেতুটির চারদিকে প্রশস্ত করেছে বাহু। একটি নেমেছে কারওয়ান বাজারে। একটি কাকরাইল যাওয়ার পথে। একটি নিউ ইস্কাটন হয়ে বাংলামোটরের দিকে। আর একটি চলে গেছে মৌচাকের দিকে। রামপুরা পার হয়ে আকাশ ছুঁতে চাওয়া উড়াল সেতুটির একটি অংশ রাজারবাগে অন্যটি নেমেছে শান্তিনগরের রাস্তায়। নাগরিক জীবনের চলার পথে এই সুবিধা ব্যস্তময় জীবনে স্বস্তি ফিরিয়েছে।

বদলে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে ঢাকার মিরপুরের চিত্রও। মেট্রোরেল পথ ধীরে ধীরে বেয়ে আসছে শহরের প্রাণকেন্দ্রে। উত্তরা থেকেও এই পথ গিয়ে মিলবে মতিঝিলে। মাত্র ৩৭ মিনিটে পাড়ি দেওয়া যাবে দীর্ঘ এই পথ। হলিউড মুভিতে দেখতে দেখতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এখন আর অপরিচিত নেই কারো কাছে। প্রকল্পের কাজ চলছে। উড়াল পথের স্তম্ভ অনেকটাই দাঁড়িয়ে গেছে। কাজ শেষ হলে ঢাকার সড়ক ব্যবস্থাপনায় বাড়তি মাত্রা আনবে এই জটলামুক্ত পথ।

ঢাকায় এতদিন কোনো পয়ঃশোধনাগার ছিল না। শুনে বিস্ময়ের সীমা ছাড়ালেও বিষয়টি সত্যি। তবে এই বিস্ময় ফুরিয়ে আসার দিন এসেছে। খিলগাঁওয়ের দাশেরকান্দিতে হচ্ছে পয়ঃশোধনাগার। টেকসই পয়ঃব্যবস্থাপনার একটি পদক্ষেপ হিসেবে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা)। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকার পয়ঃব্যবস্থাপনা দৃষ্টান্ত হবে। উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে ঢাকা। চিরচেনা এই নগর হয়তো নগরবাসীর কাছেই অচেনা মনে হবে একসময়। তখন এই ঢাকা আর সেই ঢাকার গল্প নিয়ে আড্ডা হবে। বসবাসের অযোগ্য নয়, তিলোত্তমা আবারও ফিরে পাবে তার হারানো গৌরব। সেইদিন আর বেশি দূরে নয়।

ঢাকাটাইমস/৭সেপ্টেম্বর/এইচএফ

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

উইমেন্স ওয়ার্ল্ড: স্পর্শকাতর ভিডিও পর্নোগ্রাফিতে গেছে কি না খুঁজছে পুলিশ

জাবির হলে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে জঙ্গলে ধর্ষণ, কোথায় আটকে আছে তদন্ত?

নাথান বমের স্ত্রী কোথায়

চালের বস্তায় জাত-দাম লিখতে গড়িমসি

গুলিস্তান আন্ডারপাসে অপরিকল্পিত পাতাল মার্কেট অতি অগ্নিঝুঁকিতে 

সিদ্ধেশ্বরীতে ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু: তিন মাস পেরিয়ে গেলেও অন্ধকারে পুলিশ

রং মাখানো তুলি কাগজ ছুঁলেই হয়ে উঠছে একেকটা তিমিরবিনাশি গল্প

ঈদের আনন্দ ছোঁয়নি তাদের, নেই বাড়ি ফেরার তাড়া

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :