বি. চৌধুরী আর তার পুত্র মাহীর অভিনব জামায়াতবিরোধিতা

প্রকাশ | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৮:০৩ | আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:৫১

বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস
সাঈদীপুত্র শামীম সাঈদীর সঙ্গে মাহী বি চৌধুরী (ফেসবুক থেকে নেয়া)

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি যে ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে তাতে বাধা হিসেবে এসেছে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী। গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন এবং যুক্তফ্রন্টের নেতা এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী জানাচ্ছেন, জামায়াত জোটে থাকলে তারা ঐক্যে যাবেন না।

বাবা বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মতোই ছেলে মাহী বি চৌধুরীও নানা টিভি টক শো আর নানা অনুষ্ঠানে জামায়াত নিয়ে আপত্তির কথা জানাচ্ছেন। বলছেন, এই দলটি জোটে থাকলে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য সম্ভব নয়।

তবে বি চৌধুরী এবং মাহী বি চৌধুরীর এই জামায়াত বিরোধিতা অভিনবই বলতে হবে। কারণ, এই দলটির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে তারা দুই জনই রাজনীতি করেছেন এক সময়। আর তখন জামায়াত নিয়ে আপত্তির কথা তুলেননি বরং স্বাধীনতাবিরোধী দলটির সঙ্গে ঐক্যের পক্ষেই কথা বলেছেন।

আবার মাহী যখন জামায়াতের বিরুদ্ধে কথা বলে যাচ্ছেন, তখন ফেসবুকে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে।

একইভাবে মাহীর বাবা এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পুরনো একটি ছবি নতুন করে ভাইরাল হয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, এক অনুষ্ঠানে সাঈদীর হাত থেকে কোরআন শরিফ নিচ্ছেন তিনি। তখন তিনি রাষ্ট্রপতি। মাহীর মতোই তিনিও বলছেন, জামায়াত থাকলে জাতীয় ঐক্যে যাবেন না তিনি।

মাহী এবং তার বাবা বি. চৌধুরী-দুই জনই বিএনপির সংসদ সদস্য ছিলেন এবং তারা যখন ভোটে লড়েছেন, তখন তারা জামায়াতের সহযোগিতাও নিয়েছেন। ২০০১ সালে ভোটে জিতে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর বি চৌধুরীরে রাষ্ট্রপতি করা হয় এবং তার ছেড়ে দেয়া আসনে মাহী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং সে নির্বাচনেও জামায়াত তার পক্ষে অবস্থান নেয়।

নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০ দল ছাড়াও তৃতীয় শক্তি হওয়ার ঘোষণা দেয়া ‘যুক্তফ্রন্ট’ ও গণফোরামের সঙ্গে ঐক্য গড়তে মরিয়া বিএনপি যাকে তারা ‘জাতীয় ঐক্য’ বলছে। আর সুযোগ বুঝে যুক্তফ্রন্ট তিনশ আসনের মধ্যে ১৫০টি আসনে ছাড় দাবি করে বসে আছে।

আবার ড. কামাল হোসেন জামায়াত থাকলে ঐক্য নয়-এমন অবস্থান জানিয়েছেন। তার অতীতের রাজনৈতিক ভূমিকায় এই অবস্থান অভিনব বলা যায় না। বরাবর জামায়াতের বিষয়ে তার আপত্তি ছিল। কিন্তু এর মধ্যে বি চৌধুরী ও তার ছেলে মাহীর জামায়াত নিয়ে বক্তব্য ও অবস্থান একেবারেই নতুন।

বি চৌধুরী ও মাহী এমনও বলছেন, জামায়াতকে সঙ্গে নেয়ায় বিএনপির জনসমর্থন দিনদিন কমছে। তাই এ ব্যাপারে দলটির সতর্ক থাকা উচিত।

অথচ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই জামায়াতের সঙ্গে এক ধরনের যোগাযোগ ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা ও গণহত্যা-নির্যাতনের দায়ে যুদ্ধের পর নিষিদ্ধ ছিল জামায়াত। পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে তাদেরকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। আর একই সময়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন বি চৌধুরী, হয়ে যান বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব।

সেই আমলেই পাকিস্তানি পাসপোর্টে দেশে আসার সুযোগ পান গোলাম আযম, ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও তিনি দেশ ছাড়েননি। পরে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি নাগরিকত্বও পান। তখনও বি. চৌধুরী মন্ত্রী ছিলেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির পাঁচ বছর সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে যে আন্দোলন করেছে, সেখানে জামায়াতও পাশে ছিল। আর ১৯৯৯ সালে জোটবদ্ধ হয় দুই দল। ২০০১ সালে এই জোট ক্ষমতায় আসার পর আলবদর বাহিনীর দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ হন মন্ত্রী।

ফেসবুক থেকে নেয়াতখন দুই দল মিলেই বি. চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করে যদিও পরে বিএনপি অপমানজনকভাবে তাকে রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়তে বাধ্য করে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে এবং পরে জামায়াতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছেন বি চৌধুরী।

কিন্তু হঠাৎ করে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া যখন এগিয়ে চলছে তখন জামায়াত নিয়ে এমন শর্ত দেয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা আলাপ আলোচনা চলছে। আর বিএনপির মধ্যেও এ নিয়ে নানা কথা রয়েছে।

জোটের একটি শরিক দলের চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না শর্তের ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমার মত জোটের কেউ কেউ মনে করে যুক্তফ্রন্ট বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলাতে চায়। শেষ পর্যন্ত ঐক্য হবে কি না তা নিয়েও অনেকের মধ্যে সন্দেহ আছে। আর জোটের সবশেষ বৈঠক দেখে মনে হয়েছে বিএনপি আমাদের সঙ্গেও প্রতারণা করবে,ওদের সঙ্গে প্রতারণা করবে। আর এমনটা হলে বিএনপির আমও  যাবে, ছালাও যাবে।’

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জামায়াত থাকলে কারা থাকবে আর কারা থাকবে না, আবার জামায়াত নিয়ে আপত্তির বিষয়ে উত্তরও জামায়াত দেবে এটাই স্বাভাবিক। তবে জামায়াতের গলায় হাত দিয়ে রাজনীতি করে রাষ্ট্রপতি হলেন আর এখন তারা কেন খারাপ হয়ে গেল সেটাও দেখার বিষয়।’

জামায়াতের সঙ্গে অতীতে একসঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করার বিষয়ে বি. চৌধুরী এবং মাহী বি চৌধুরীর জবাব পাওয়া যায়নি। তাদের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল করলেও তারা তা ধরেননি। এই দুই নেতার ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতাও এ নিয়ে কথা বলতে চাননি।

জামায়াত নিয়ে পিতা পুত্র যা বলছেন

সম্প্রতি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, ‘জামায়াত হলো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। সেই দলের সঙ্গে ঐক্য করলে তা হবে বিশ্বাসঘাতকতা। জামায়াত থাকলে যে যত বড় দল হোক আমরা তাদের সঙ্গে ঐক্য করব না।’

অতীতে জামায়াতের সঙ্গে জোট করে জাতির সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ কেন করেছিলেন, সেই জবাবও অবশ্য দেননি বি. চৌধুরী।

আবার মাহী বি চৌধুরী সম্প্রতি একটি টেলিভশন টকশোতে অংশ নিয়ে বলেন, ‘জামায়াতকে সঙ্গে নেয়ায় সে দিনই বিএনপির রাজনৈতিক ক্ষত তৈরি হয়েছে। সে সময় নির্বাচনের পরপরই সরকার গঠনের ছয় মাসের মাথায় বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগের মাধ্যমে জামায়াত বিএনপিকে গ্রাস করেছে। আর বিএনপির আদর্শিক মৃত্যু তখন থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল।’

বি.চৌধুরী ও মাহীর জামায়াত বিরোধিতার বিষয়ে ২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যুক্তফ্রন্ট হয়তো চাচ্ছে জামায়াতকে সরিয়ে তারা নিজেদের শক্তি দেখাতে। তবে আমার ধারণ প্রকারান্তরে তারা আওয়ামী লীগের স্বার্থ হাসিল করতে মাঠে নেমেছে।’

মাহীর বক্তব্যেও জোট নেতার বক্তব্যের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। জামায়াত জোটে না থাকলে বেশি লাভ হবে দাবি করে তিনি বলেন, ‘জামায়াতের ভোট আছে ৫ শতাংশ। ২০-২৫ শতাংশ ফ্লোটিং ভোট আছে। তারা এক এক সময় এক এক দলকে সাপোর্ট দেয়। এই কারণে নির্বাচনে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়। কিন্তু তারা জামায়াতকে চায় না।’

(ঢাকাটাইমস/১৪সেপ্টেম্বর/বিইউ/ডব্লিউবি)