পেঁয়াজ

মনদীপ ঘরাই
 | প্রকাশিত : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৫:৫৬

আজকের গল্পটা মাসুম সাহেবের। মাসুম অর্থ সরল কিংবা নিরপরাধ। নির্ঘাত দুটো শব্দের কোনটাই মাসুমের সাথে খাপ খায় না। কেন খায় না তা গল্পের শুরুতেই জানতে চাইলে বলবো কেনো!

আজ সকালের মেঘে ঢাকা সূর্যটা জানিয়ে গেল তিন কুড়ি অর্থাৎ ষাটে পা দিলেন মাসুম সাহেব। তার ছেলে-মেয়ে,নাতি-নাতনী কারও কি মনে আছে আজ তার জন্মদিন? ওসব নিয়ে ভাবে না কেউ।

নাজনীন বেঁচে থাকলে ঠিকই...। চোখ ধরে আসে। নাজরা বাঁচে না। মাসুমদের একা করে চলে যায়।

ইজিচেয়ারটায় শুয়ে তন্দ্রার মতো লেগেছিলো একটু। হঠাৎ পায়ে এসে কি জানি একটা লাগলো। চমকে উঠে তাকাতেই দেখতে পেল একটা পেঁয়াজ। তার ৩ বছর বয়সী নাতী রান্নাঘর থেকে চুপটি করে এনেছে হয়তো। পেঁয়াজটা হাতে নিতেই অদ্ভুত খেয়াল এলো মাসুম সাহেবের। মানব জীবনটাও পেঁয়াজের মতোই। একের পর এক খোলসে মোড়া। কটা খোলস জড়িয়েছে মাসুম সাহেব এ জীবনে? পেঁয়াজটা হাতে নিয়ে একটা করে খোলস ছাড়াতে থাকে আর চোখের সামনে ভেসে ওঠে জীবনের নানান অধ্যায়। এক একেকটা খোলস...

পেঁয়াজের সবচেয়ে ওপরের খোসাটা সবচেয়ে পাতলা। মাসুম সাহেবের বেলাতেও তাই। এই তো সেদিন। নামের সাথে বুড়ো খোলসটা জুড়েছে। এটাই কি পেঁয়াজের শুরুর খোসাটার মতো সবচেয়ে অগুরুত্বপূর্ণ না? ঝাঁজ নেই।রান্নায় দেয়া যায় না। ফেলে দিতে হয়। বুড়োদের বেলাতেও তো তাই...

পরের খোসাটা ছাড়াতেই চোখ জ্বলে খানিকটা। মাসুমের মাঝবয়েস। ঝাঁঝ বেশ ছিল বৈকি! ব্যবসা, টাকা আর সম্পদের নেশা। নাজনীনকে যে সে ভালোবাসে এটা সবাইকে দেখাতে তার নামে বিশাল এক প্রাসাদ গড়ে তুললো।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, " তাজমহল?"

মাসুম সাহেব বললো," কাছাকাছি। আমি নাম দিয়েছিলাম নাজমহল"

মনে মনে ভাবে,ভালোবাসা?এই নাজমহলে কত মানুষের হাহাকার যে মিশে আছে... ওসব কাউকে বুঝতে দেয় নি মাসুম সাহেব। টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ রেখেছে অনেকের।জমিটাও তো জোর করে দখল করেছিল সে। যাই হোক,বাড়িতে আদর্শ বাবা আর স্বামীর খেতাবটা তো ছিল!

আরেকটা খোসা হাত দিয়ে ছাড়ায়। ঝাঁঝটা বাড়ে। যুবক বয়সের মাসুম সাহেব। নাজনীন পুরোটা জুড়ে আছে। সেই সাথে আড্ডা,মস্তানি আর, আর... সেলিম। বন্ধু সেলিম। গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল নাজনীনের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েনে।

Everything is fair in love and war.অজান্তেই লাইনটা বলে ওঠে সে। এই যুক্তিতেই তো মিথ্যে বলে সেলিমের কাছ থেকে নাজনীনকে সরিয়েছিল মাসুম। ফলাফল এতটা ভয়াবহ হবে কে জানতো? যাই হোক, জগতের কেউ তো জানেনি। আর ওই যে, everything... এটা কি ছিল? ভালোবাসা,নাকি যুদ্ধ?

এবারের খোসাটা ছাড়াতে একটু কষ্ট হচ্ছে। তরুন বয়সের মাসুম। পাশের বাড়ির কাজলকে ভালোবেসেছিল মাসুম। ভালোবাসাটা কেমন জানি দেহকেন্দ্রিক ছিল। মন-টনের ব্যাপারটা বুঝতো না মাসুম। একদিন ভরদুপুরে ছাদে। মাসুমকে প্রত্যাখ্যান করায় জ্বলন্ত সিগারেট কাজলের হাতে ঠেসে ধরেছিল সে। কাজলের চিৎকারে ছাদের চালে ঘুমিয়ে থাকা বিড়ালটা পর্যন্ত চমকে উঠে দৌঁড়ে পালিয়েছিল। মাসুমের বুক কাঁপে নি। বুকে ছিল প্রত্যাখ্যানের আগুন। আজ বুকটা খুব পুড়ছে কাজলের জন্য। কোথায় আছে কাজল? হাতটা নিয়ে কত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে কে জানে? যাই হোক, কাজল কাউকে তো বলে নি!

আরেকটা খোলস। মাসুমের কৈশোর। খোলস কি শুধু নেতিবাচক কাজের হয়? সব গোপন কথা কি অপরাধের? না। মনে মনে ক্লাস টিচার রেহানা ম্যাডামকে ভালোবাসা কি অপরাধ ছিল? তা হয়তো ছিলো না। কিন্তু বলতে না পারার বেদনায় তার বাসার লাইট ভেঙ্গে আসা, টবের মাটি তুলে ফেলা..এগুলো হয়তো ঠিক হয় নি। সিগারেটটাও তো রেহানা ম্যাডামের বিরহেই ধরেছিল মাসুম। কেউ জানে নি এসব কথা।বন্ধুরাও না।

শেষে এসে খোলস ছাড়ায় আরেকটা।শৈশব। "প্রায়" নিষ্পাপ শৈশব। কাঁচের বয়াম ভেঙ্গেছিল সে।দোষ পড়েছিল কাজের ছেলে কালামের। মাসুম মিথ্যে বলে নি। ভয়ে শুধু চুপ থেকেছিল। এতে কি পাপ হয়েছিল? কালাম মার খেয়েছিল বেদম। আজ কেন জানি কালামের ব্যথাটা নিজের গায়ে অনুভব করছে মাসুম। কালাম এত মার খেয়েও কাউকে কিছু বলে নি। শুধু মাসুমকে হেসে বলেছিল, " ভাইজান আমি জানি কেডা ভাংসে"।

পেঁয়াজের একদম শেষে কি থাকে? এই প্রথম মনযোগ দিয়ে দেখলো মাসুম। ছোট কোয়ার মত একটা অংশ। এটা খোলস না। তবুও পেঁয়াজের অংশ তো! ঝাঁঝও আছে। এ ঝাঁঝ শুদ্ধতার। জন্মের পরের নিষ্পাপ মাসুম। তার নিষ্পাপ চাহুনি দেখেই বাবা রেখেছিল এ নাম। এ সময়টার কিছুই মনে নেই। হয়তো নিষ্পাপ বলেই ধুয়ে মুছে গেছে স্মৃতি থেকে...

অঝরে বৃষ্টি নেমেছে বুড়ো মাসুম সাহেবের চোখে। অশ্রুফোঁটার কোনগুলো পেঁয়াজের ঝাঁঝে গড়িয়ে পড়ছে আর কোনগুলো কষ্টে; তা আলাদা করা যায় কি? চোখের জলের ধারাটা এমনই;বড় অবাধ্য,বড়ই অজানা।

হোক না সেটা পাপী মাসুমের, কিংবা সমাজের চোখে নিষ্পাপ আমার কিংবা আপনার...।

গল্পকার: লেখক এবং সিনিয়র সহকারী সচিব, বাংলাদেশ সরকার

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :