ভোটের হিসাব-২

উঠানামা করে বিএনপির ভোট

প্রকাশ | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৮:০৪

তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস

বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনে ভোটের তথ্য বলছে, দেশের দুই প্রধান দলের মধ্যে বিএনপি ভোট উঠানামা করে। দুটি জাতীয় নির্বাচনে তাদের ভোট আগেরবারের চেয়ে বাড়লেও দুটি নির্বাচনে কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।

এমনও দেখা গেছে, আগের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েও বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে হেরেছে আবার আগের চেয়ে কম ভোট পেয়েও জিতেছে।

অন্যদিকে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের ভোট ১৯৭৯ সালের পর থেকে ক্রমাগত বাড়ছে। কেবল অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ধরলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রথম নির্বাচনে তারা যত শতাংশ ভোট পেয়েছে তার তুলনায় শেষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে তাদের ভোট বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।

১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগ ২৪.৫ শতাংশ ভোট পেলেও ২০০৮ সালে সবশেষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ৪৯.৯ শতাংশ ভোট পড়ে।
অন্যদিকে প্রতিষ্ঠার পর বিএনপি যত শতাংশ ভোট পেয়েছে, পরের চারটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে অংশ নিয়ে একবারই কেবল তারা সেই হারে ভোট পেয়েছে। বাকি তিনটি নির্বাচনেই ভোটের হার ছিল তার চেয়ে অনেক কম।

বিএনপি ১৯৭৯ সাল প্রথমবার অংশ নিয়েই ৪১.২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আর ২০০৮ সালে সবশেষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে তার চেয়ে দলটি ভোট কম পেয়েছে আট শতাংশ, অর্থাৎ ৩৩.২ শতাংশ ভোটারের পছন্দ ছিল ধানের শীষ।

বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী এমাজউদ্দিন আহমেদ অবশ্য দুটি নির্বাচনে বিএনপির ভোট কমার বিষয়টি স্বীকার করতে চান না। তার দাবি, ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ফলে ওই নির্বাচনে কী হলো না হলো, সেটি ধরলে হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘২০০৮ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল সেটা কোন নির্বাচনই ছিল? ওটা তো ভোটের বাক্সে ব্যালট পেপার ঢুকানোর ব্যাপার ছিল। শেখ হাসিনা যখন বলল আপনারা যা কিছু করবেন (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) আমরা তার সবকিছুই সমর্থন করি এবং সংসদে সব পাস করে নেব, তারপরে সামরিক কর্মকর্তারা তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে চলে গেল। তাই ওইটাকে নির্বাচন হিসাবে গণ্যই করা হয় না। ওই নির্বাচনকে বাদ দিলে দেখা যাবে বিএনপির ভোট ওঠানামা করে নাই, এটা বাড়তির দিকেই রয়েছে।’

১৯৭৯ সালের তুলনায় ১৯৯১ সালে বিএনপির ১১ শতাংশ ভোট কমার বিষয়টি নিয়ে অবশ্য কোনো ব্যাখ্যা দেননি এই বুদ্ধিজীবী। আর বিএনপির জেতা ওই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে তার মনে কোনো প্রশ্নও নেই।

বিএনপিপন্থী আরেক বুদ্ধিজীবী জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বিএনপির ভোট উঠানামার তথ্য জানিয়ে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অতীতে কী হয়েছে না হয়েছে সেটা ধরলে হবে না। তবে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমান সমান।’

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেছেন, বিএনপি তার রাজনৈতিক আদর্শের বিষয়টি কখনও স্পষ্ট করতে পারেনি। জন্ম থেকেই তারা মূলত আওয়ামী লীগবিরোধী একটি মোর্চা। এর একটি বড় অংশ স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগ থেকে এসেছে, একটি অংশ এসেছে ন্যাপ ভাসানী থেকে এবং একটি অংশ চীনপন্থী বামরা। এ কারণে তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই, লক্ষ্য উদ্দেশ্য নেই।

‘এই দলটি তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলেও তারা উদাহরণ তৈরির মতো কাজ করতে পেরেছে কমই। সুশাসনের দিক থেকেও তাদের সুনাম ছিল না। ফলে তারা সুবিধাভোগী কোনো জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পারেনি’-এমন মত দিয়ে ওই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘এখনও বিএনপি আওয়ামী লীগবিরোধী মোর্চার বাইরে নিজের অবস্থান করতে পারেনি।’

কোন নির্বাচনে কত ভোট

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসেই প্রতিষ্ঠা করেন তার দল বিএনপি। আর ১৯৭৯ সালের প্রথম নির্বাচনেও বাজিমাত করেন তিনি।

দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪১.২ শতাংশ ভোট এবং ২০৭ আসন পেয়ে প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করে বিএনপি।

তবে ওই সরকার তার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেনি। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে হটিয়ে ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখল করেন আরেক সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

সেনাশাসক এরশাদ ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে নির্বাচন দিলে তাতে অংশ নেয়নি বিএনপি। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পরের বছরের নির্বাচনেও রায় আসে বিএনপির পক্ষেই। তবে আগের নির্বাচনের তুলনায় ওই নির্বাচনে দলটির ভোট কমে প্রায় ১১ শতাংশ।

পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রতীক ধানের শীষের পক্ষে রায় দেয় ভোটারদের ৩০.৮১ শতাংশ। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের নৌকা যত ভোট পেয়েছে, তত ভোটও না পেয়েও ক্ষমতায় আসে বিএনপিই।

ওই নির্বাচনে নৌকার পক্ষে ভোট পড়ে মোট ৩১.৩ শতাংশ ভোট। তবে ০.৫ শতাংশ ভোট কম পেয়েও বিএনপি যেখানে ১৪০টি আসন পায়, সেখানে নৌকা প্রতীকে জেতেন আওয়ামী লীগের ৮৮ এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির পাঁচ জন সংসদ সদস্য।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ বিরোধী দলগুলো বর্জন করে। আর বিএনপি এককভাবে নির্বাচন করে। কিন্তু তখন সব কটি আসনে ভোট করা যায়নি। আর ২১ শতাংশ ভোট পড়েছে বলা হলেও বিএনপি বা অন্য কোন দল কত ভোট পেয়েছে, সেই পরিসংখ্যান নেই নির্বাচন কমিশনে।

তবে ওই সরকার দুই মাসও টিকতে পারেনি। আর আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার পদত্যাগ করে ওই বছরেরই জুনে আরেকটি নির্বাচন দেয়, যেখানে দলটি হেরে যায়।

তবে ১৯৯১ সালের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তুলনায় ৯৬ এর জুনের নির্বাচনে বিএনপি ভোট বাড়ে। তখন ভোটারদের ৩৩.৬ শতাংশের পছন্দ ছিল ধানের শীষ।

১৯৯১ সালের তুলনায় ২.৮ শতাংশ ভোট বেশি পেলেও এই নির্বাচনে বিএনপির আসন কমে ২৪টি। ১১৬টি আসন পেয়ে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বিরোধী দল হয় বিএনপি। অবশ্য এই নির্বাচনে আগেরবারের তুলনায় ৬.১৪ শতাংশ ভোট বাড়ে আওয়ামী লীগের।

২০০১ সালে পরের নির্বাচনেও বিএনপির ভোট বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকে। এই নির্বাচনে ৪১.৪ শতাংশ ভোট পায় বিএনপি। আসন পায় ১৯৩টি।

দলটির চেয়ে ১.৩৮ শতাংশ ভোট কম পেয়ে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ আসন কম পায় ১৩১টি। তারা জেতে ৬২টি আসনে।

অর্থাৎ প্রতিষ্ঠার পর বিএনপি ২০০১ সালে সর্বোচ্চ হারে ভোট পেয়েছে। তবে সেটি তাদের প্রথম নির্বাচনের তুলনায় খুব বেশি নয়।

এরপরের নির্বাচনেও আবার ছন্দপতন ঘটে বিএনপির। প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয়বারের নির্বাচনে যেমন তাদের প্রায় ১১ শতাংশ ভোট কমে, তেমনি বিএনপির অংশ নেয়া চতুর্থবারের তুলনায় পঞ্চমবারেও তাদের ভোট কমে যায় আট শতাংশ।

২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির পছন্দ ছিল ভোটারদের ৩৩.২ শতাংশ। আর ভোট কমার পাশাপাশি তাদের আসনও কমে ১৬৩টি। মাত্র ৩০টি আসন নিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে ফল করে দলটি। পরের জাতীয় নির্বাচনে তারা আসেনি।

চতুর্থ এবং পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের মতোই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনও বর্জন করে বিএনপি। 

ঢাকাটাইমস/১৯সেপ্টেম্বর/টিএ/ডব্লিউবি