ভোটের হিসাব-৩

আলোচনায় থাকলেও জনপ্রিয়তা নেই ‘তৃতীয় শক্তির’

প্রকাশ | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৮:২২ | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২০:০৩

তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস
তৃতীয় শক্তি হওয়ার ঘোষণা দেয়া যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে বৈঠকে কামাল হোসেন

দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে তৃতীয় শক্তির আলোচনা গণমাধ্যমে যত উঠে আসে, জনগণের মনে তা তত দাগ কাটে না। জাতীয় নির্বাচনগুলোর ফলাফল পর্যালোচনা করে এমন তথ্যই মিলেছে।

ভোটের ফলগুলো বলছে, নতুন কোনো রাজনৈতিক শক্তি উঠেই আসতে পারেনি। আবার আওয়ামী লীগ সব সময় দুই প্রধান শক্তির একটি থেকেছে। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষণে ক্ষণে পাল্টেছে। বর্তমানে বিএনপির সঙ্গে লড়াই হলেও এক সময় জাতীয় পার্টি ছিল সেই জায়গায়।

১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর লড়াইটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই স্থির থেকেছে। আর এদের বাইরে আলোচিত দুই দল জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনও কমার প্রমাণই মিলছে। আর বাম দলগুলো পুরোপুরি আবেদন হারিয়েছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এক সময়ের আলোচিত আরও বেশ কিছু দল।

২০০৮ সালে সবশেষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে ভোট পড়েছে মাত্র ০.১ শতাংশ। এই ভোটের মধ্যে আবার ‘না’ ভোটও আছে।

এই নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে যেসব প্রার্থী কিছু ভোট পেয়েছেন, তারাও মূলত দুই প্রধান দলের মনোনয়নবঞ্চিত নেতা।  

এবারও জাতীয় নির্বাচনের আগে দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে তৃতীয় শক্তি হওয়ার ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছে যুক্তফ্রন্ট নামে তিন সংগঠনের জোট। তবে তারা বিএনপির সঙ্গে ঐক্যের আলোচনা করছে। এই আলোচনায় আবার ১৫০ আসন, দুই বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রিত্বের মতো শর্ত দিচ্ছে।

এর আগে বিশেষ করে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে তৃতীয় শক্তির তুমুল আলোচনা ছিল। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. মুহম্মদ ইউনূস তার নাগরিক শক্তি নামে দল গঠনের চেষ্টা করেও ক্ষ্যান্ত দেন। তবে আরও কিছু দল তখন আলোচিত হয়ে উঠে যা কিংস পার্টি নামে পরিচিতি পায়। কিন্তু তারাও পরে হারিয়ে যায়।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক আফসান চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যে যাই বলুক না কেন, আওয়ামী লীগ বিএনপির বাইরে মানুষ অন্য কাউকে পাত্তাই দেয় না। অন্য কারও কথা চিন্তাও করে না। তৃতীয় শক্তি হিসেবে যাদের কথা বলা হচ্ছে তাদের কোনো জনপ্রিয়তাই নেই। তারা সবাই প্রাক্তন।’

‘আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে যারা তৃতীয় শক্তি হওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে তাদেরকে মানুষ কখনও সিরিয়াসভাবে নেয় না। কারণ, তাদের কোনো জনভিত্তি নেই। তাদের জনসম্পৃক্ত হওয়ার চেষ্টাও নেই।’ 

সম্প্রতি আলোচিত হয়ে উঠা কয়েকজনের বিষয়ে এই বিশ্লেষক বলেন, ‘বি. চৌধুরী, কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, জাফরুল্লাহ- এদের বয়স ৮০-৯০ হয়ে গেছে, সাম্প্রতিক নেতা হিসেবে তাদের আর কোনো প্রভাব নেই। তাদের কিছুটা জনইমেজ আছে কিন্তু কোনো জনসমর্থন নেই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন,  ‘দেশের দুই বড় দলের বাইরে উত্তম বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি। যে কারণে তারা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে না। আমরা যে যাহাই বলি না কেন-আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বড় দুই দলের প্রতিই সাধারণ মানুষের আকর্ষণ বেশি। যতক্ষণ না উত্তম বিকল্প তৈরি না হবে সে সময় পর্যন্ত শুধু তত্ত্বগতভাবে বিকল্প শব্দটি বলা যাবে, বাস্তবতায় নয়।’

ভোটের ফল কী বলছে

বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭৩.২ শতাংশ ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) ৮.৩ শতাংশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ ৬.৫ শতাংশ, জাতীয় আওয়ামী পার্টি (ভাসানী) ৫.৩ শতাংশ, বামপন্থীদের জোট ১.১ শতাংশ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৫.৩ শতাংশ ভোট পান।

অর্থাৎ তখনও স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কার্যযত কোনো বিরোধী দল গড়ে উঠেনি।

তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে প্রতিষ্ঠা করেন তার দল বিএনপি। আর ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে সেই দলটি ৪১.২ শতাংশ ভোট পায়।

২৪.৫ শতাংশ ভোট নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হয় আওয়ামী লীগ। মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের আরেক অংশ পায় ২.৮ শতাংশ ভোট। এর বাইরে মুসলিম লীগ ১০.১ শতাংশ, জাসদ ৪.৮ শতাংশ, কমিউনিস্ট পার্টি ৪.৮ শতাংশ, জাতীয় আওয়ামী পার্টি ২.২ শতাংশ, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১০.২ শতাংশ ভোট পায়।

১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনেও সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের বাইরে জামায়াত ৪.৬ শতাংশ, জাসদের দুই অংশ ৩.৪, মুসলিম লীগ ১.৪, জাতীয় আওয়ামী পার্টির দুই অংশ ২ শতাংশ, এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৬.৩ শতাংশ ভোট পান।

জিয়াউর রহমানের পথ ধরেই সেনাপ্রধান থাকাকালে হুসেইন এরশাদ ক্ষমতা দখল করে নিজের দল জাতীয় পার্টি গঠন করেন। আর ১৯৮৬ সালে প্রথমবার অংশ নিয়েই জিতে যায় দলটি। প্রশ্নবিদ্ধ এই নির্বাচনে দলটির বাক্সে ৪২.৩ শতাংশ ভোট পরে বলে নির্বাচন কমিশনে তথ্য রয়েছে।

এই নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে। আর আওয়ামী লীগ ২৬.২ শতাংশ ভোট পায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে অস্ত্র ধরা জামায়াতে ইসলামী জিয়াউর রহমানের আমলে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়ে এই নির্বাচনেই প্রথম দাঁড়ায়। তারা ৪.৬ শতাংশ ভোট পায়, আসন পায় চারটি।

১৯৮৮ সালে আরও একটি জাতীয় নির্বাচন হয় যেটি আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ মূলধারার বেশিরভাগ দলই বর্জন করে। জামায়াতও যায়নি ওই নির্বাচনে।

এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আসনের দিক থেকে তৃতীয় হয়। তবে ভোট সংখ্যার দিক দিয়ে তাদের অবস্থান ছিল চতুর্থ।

জাতীয় পার্টি ওই বছর আসন পায় ৩৫টি, আর ভোট পায় ১১.৯ শতাংশ।

আরেক আলোচিত দল জামায়াতে ইসলামী আসন পায় ১৮টি, আর তাদের ভোট ছিল ১২.১ শতাংশ।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি তখন নৌকা প্রতীক নিয়ে ১.২ শতাংশ ভোট পায়। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোট পান ৪.৪ শতাংশ। কোনো আসন পায়নি, এমন ৬৩টি অন্যান্য দল ভোট পাঢ ৪.৯ শতাংশ।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একতরফা নির্বাচন করে দুই মাসের মধ্যে পদত্যাগ করে এবং ওই বছরের জুনে আরও একটি নির্বাচন হয়।

আগের নির্বাচনের তুলনায় সে সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভোট বেশি পেলেও কমেছে জামায়াতের। প্রায় চার শতাংশ কমে তাদের ভোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৮.৬ শতাংশ। আর আসন ১৫টি কমে হয় তিন শতাংশ।

এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আগেরবারের চেয়ে বেশি ভোট পেলেও তাদের আসন সংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে যায়। ১৬.৪ শতাংশ ভোট পেয়ে তারা আসন পায় ৩২টি।

এ নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি কোনো আসন পায়নি আর তাদের ভোটের সংখ্যা ছিল অনুল্লেখযোগ্য। আসন পায়নি এমন ৭৪টি দল মিলে ভোট পায় ১.৬ শতাংশ। স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভোট সংখ্যাও কমে হয় ১.১ শতাংশ।

২০০১ সালে জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী-ভোট কমে দুই দলেররই। লাঙ্গল প্রতীকে তখন ভোট পড়ে ৭.২২ শতাংশ, আসন ১৮টি কমে হয় ১৪টি।

আর জামায়াতের ভোট আরও প্রায় চার শতাংশ কমে হয় ৪.২৮ শতাংশ। তবে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার সুফল পায় দলটি, তাদের আসন ১৪টি বেড়ে হয় ১৭টি।

আসন পায়নি এমন দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে ভোট পায় ৪.০৬ শতাংশ।

পরের নবম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোট আরও খানিকটা কমে ৭ শতাংশে দাঁড়ায়। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করার সুফল পায় তারা। আসন সংখ্যা বেড়ে হয় ২৭টি।

জামায়াতের ভোট এই নির্বাচনে সামান্য বেড়ে হয় ৪.৬ শতাংশ। তবে আসন সংখ্যা ১৫টি কমে হয় দুইটি।

দুই দলের মনোনয়নবঞ্চিত ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীরা এই নির্বাচনে ভোট পায় মোট ৪.৯ শতাংশ। ছোটছোট অন্যান্য দলগুলো এই নির্বাচনে কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ‘না’ ভোট এবং অন্যান্য দল মিলে ভোট পায় ০.১ শতাংশ।

২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট বর্জন করে এবং সেখানে সহজ জয় পায় আওয়ামী লীগ। তবে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির বাইরে মনোনয়নবঞ্চিত দুই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেশ কিছু আসনে উল্লেখ করার মতো ভোট পেয়েছেন।

ঢাকাটাইমস/২০সেপ্টেম্বর/টিএ/ডব্লিউবি