তাজমহল: প্রেম যখন নৃশংস

প্রকাশ | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২১:৩৬ | আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২৩:০৯

হাসান মাসুম

ক্যান্সার চিকিৎসায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে লেসথো থেকে ভারতের দিল্লিতে এসেছি প্রায় দু’সপ্তাহ আগে। হাসপাতালে কাজের চাপ ও লেখাপড়া মিলিয়ে একটু স্বস্তির আশায় ভাবছিলাম ছুটির দিনে দূরে কোথাও ঘুরে আসা যায় কিনা। এমন সময় প্রস্তাব এলো অন্যান্য বিভাগে কর্মরত আফ্রিকার অন্যান্য চিকিৎসক সহকর্মীদের কাছ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর রবিবার ছুটির দিন আগ্রা তাজমহলে যাওয়া- ব্যস রাজি হয়ে গেলাম।

সকাল ছ’টায় আমরা ১৭ জন চিকিৎসক বাসে চেপে বসলাম। বাস ছুটে চলল দিল্লি থেকে আগ্রার উদ্দেশ্যে, রাস্তা মসৃন, পুলিশ কর্তৃক যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রিত। দিল্লি থেকে আগ্রার দূরত্ব সড়কপথে ২৫৩ কিমি, প্রাক্কলিত সময় প্রায় তিন ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট। পথে যাত্রাবিরতি ও কফি পান করা হলো।

আমার সাথে থাকা চিকিৎসকদের সকলে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা। কেউ এসেছেন ক্যামেরুন থেকে, আবার কেউবা ঘানা, মালাউয়ি ও কঙ্গো থেকে। আগ্রা পৌছুলে আমরা তাজমহলের প্রবেশপথে বাস থেকে নেমে গেলাম। এখানে বিরক্তিকর বিষয় হলো গাইড নেয়ার জন্য স্থানীয় লোকজনের চাপাচাপি। এখানে উল্লেখ্য, আমি ছাড়া আমার দলের সকলের এটা প্রথমবার আগ্রা আসা। কিন্তু আমার দ্বিতীয়বার আগ্রা আসা। প্রথমবার এসেছিলাম বাবা-মায়ের সাথে যখন আমি স্কুলের ছাত্র। আমার অনেকটাই মনে আছে পথ ঘাট। যাহোক সর্বসম্মতিক্রমে একজন গাইড ভাড়া করা হলো যিনি আমাদের তাজমহল ঘুরে দেখাবেন এবং যথাযথ ইতিহাস বর্ণনা করবেন। তাজমহলে স্থানীয়দের টিকিট ক্রয়মূল্য প্রতিজন চল্লিশ রুপি, কিন্তু ভিনদেশিদের জন্য টিকিটের ক্রয়মূল্য প্রতিজন এগারশ’ রুপি।

আমরা টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে পড়লাম এবং ধীরে ধীরে তাজমহলের মূল চৌহদ্দির ভেতরে প্রবেশ করলাম যেখানে মেটাল ডিটেক্টারে সকলকে পরীক্ষা করা হচ্ছে। ভেতরে ঢুকার সময় কেউ খাবার বা  কাগজ নিতে পারবে না কঠিন নিয়ম। চোখে পড়ল ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব ও পর্যটন কর্তৃপক্ষ নিরলস কাজ করে চলেছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় যাতে তাজমহলে সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করে। কিছুটা দূরত্বে পানি পান করার ব্যবস্থা চোখে পড়ল এবং সেইসাথে আছে পরিষ্কার টয়লেট।

তারপর মূল রাজদেউড়ি পেরোতেই আমাদের চোখে পড়ল সফেদ শুভ্র তাজমহল-মুঘল সম্রাট শাহজাহানের  অমর কীর্তি- যা তিনি নির্মাণ করেছিলেন এখন থেকে প্রায় চারশ বছর আগে সেই খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে।

মুঘল ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট শাহজাহানের তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন বেগম মমতাজ মহল যাকে সম্রাট সবচাইতে বেশি ভালবাসতেন। বেগম মমতাজ যেমন রূপসী তেমন নানা গুণে গুণান্বিতা ছিলেন। শোনা যায়, যুদ্ধক্ষেত্রে বেগম মমতাজ সম্রাট শাহজাহানের সফরসঙ্গিনী হতেন। সম্রাট শাহজাহানের ঔরসে ১৪তম সন্তানের জন্মের সময় প্রসবজনিত জটিলতায় বেগম মমতাজ মহল মারা যান।

বেগম মমতাজ মহলের মৃত্যুর পরে সম্রাট শাহজাহান মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং তার প্রয়তমা স্ত্রীর স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে তাজমহল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় বিশ হাজার শ্রমিক বাইশ বছর কাজ করে তাজমহলের নির্মাণকাজ সম্পাদন করেন। তাজমহল মূলত শ্বেত পাথরে তৈরি এবং এর মূল ইমারতের চারদিকে একটি করে মোট চারটি সুউচ্চ মিনার রয়েছে। তাজমহলের স্থাপত্য অদ্ভুত- এটি একটি চতুর্ভুজ আকৃতির সুউচ্চ ইমারত যাকে যেদিক থেকেই দেখেন সেদিক থেকে একি রকম মনে হবে। সফেদ মার্বেলের সাথে চুণি, পান্না, নীলা এবং নানাবর্ণের মূল্যবান লাপিস লাজুলি খচিত করে নির্মাণ করা হয়েছিল এই তাজমহল। রাত্রে যমুনা নদীর তীরে যখন ভরা পূর্ণিমা তার জ্যোৎস্না ঢেলে দিত তাজমহলের ওপর তখন সফেদ মার্বেল পাথরে খচিত মূল্যবান রত্নরাজি নানা বর্ণের আলোক ছটায় দ্যূতিময় করে তুলত তাজমহলকে, আর আগ্রা দুর্গে বসে সেই মোহনীয় দ্যূতিময় তাজমহলের সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে সম্রাট শাহজাহান ভুলতে চাইতেন তার প্রিয়তমা স্ত্রীর শোক।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট শাহজাহান তাজমহল তৈরি করতে ব্যয় করেছিলেন তৎকালীন প্রায় পচাত্তর লাখ রুপি যা আজকের বাজারে প্রায় এক বিলিয়ন ভারতীয় রুপি সমমানের। আরো শোনা যায়, যে প্রধান কারিগর তাজমহল তৈরির নকশা প্রণয়ণ করেছিলেন তাজমহল নির্মাণ সম্পন্ন হয়ে গেলে সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে তার দুই হাতের কবজি কেটে নেয়া হয়েছিল যাতে বিশ্বের আর কেউ দ্বিতীয় তাজমহল বানাতে না পারে, সত্যিই একজন প্রেমিক সম্রাটের এ কি নৃশংশতা! তাজমহল বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম। ১৯৮৬ সালে ইউনেস্কো আগ্রার তাজমহল কে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা দেয়।

(ঢাকাটাইমস/২৬সেপ্টেম্বর/এলএ)