সন্তানদের জন্য শুভকামনা বৃদ্ধাশ্রমের বাবা-মা’দের

ফয়সাল আহমেদ, শ্রীপুর (গাজীপুর)
 | প্রকাশিত : ০১ অক্টোবর ২০১৮, ১২:৫০

সিরাজুল ইসলাম। তিনি একসময় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার ছিলেন। বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুরের প্রহলাদপুরে। সংসারে তার স্ত্রী ও চার মেয়ে থাকলেও কোন ছেলে সন্তান ছিল না। সুখেই কাটছিল তার চাকরি জীবন। কিন্তু অবসরে যাওয়ার কয়েক বছর পরই দেখা দেয় সংসারে নানা বিপত্তি। দরিদ্রতা ও পারিবারিক ভালবাসার অভাবে তিনি স্ত্রী ও সন্তানদের রোষানলে পড়েন। একসময়ে তারা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং তার মৃত্যুসনদ বানিয়ে ব্যাংকে রাখা জীবনের সব সঞ্চয়টুকু তুলে নিয়ে যায়। সাথে সাথে নিজের মাসিক পেনশনের টাকাও উত্তোলনের ক্ষমতা নিয়ে নেয়। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেও জীবিত ও মৃতের কোন প্রতিকার না পেয়ে সব হারিয়ে আজ তিনি গাজীপুরের বিকে বাড়ির বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। তিনি বৃদ্ধাশ্রমে বসে সেই সোনালি অতীতের কথা ভাবেন আর কেঁদে বুক ভাসান।

গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার মনোরঞ্জন। বয়স ৬৮। ছিলেন সরকারি একটি দপ্তরের কার্পেন্টার। দুই ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। অবসরের বয়স সীমার আগেই ইস্তফা দেন চাকরি থেকে। গ্রামে বিশাল পুকুরে মাছ চাষসহ সহায় সম্বল সবই ছিল তার। হঠাৎ এলোমেলো হয়ে পড়ে সব। এক ছেলে জুয়ায় আসক্ত হয়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন। ছেলের ঋণ পরিশোধে সমাজপতিদের হুমকিতে নিজের সহায় সম্বল সবই বিক্রি করতে বাধ্য হন। চোখের সামনে সবকিছু শেষের দৃশ্য নিজে মেনে নিতে পারলেন না। স্বজনদের আড়ালেই এসে আশ্রয় নেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। গত ছয়মাস ধরেই এখানেই আছেন।

তার মতো বৃদ্ধাশ্রমে থাকা কুমিল্লার জাহানারা বেগমও (৭৫) জানান, তার অতীত জীবনের নানা স্মৃতির কথা। তিনি এখন ডাযাবেটিস, হৃদরোগসহ নানা রোগে ভুগছেন। বলেন, তার স্বামীও বিমান বাহিনীতে চাকরি করতেন। ৪০ বছর আগে তার স্বামী চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ে রেখে মারা গেছেন। সকলের বিয়ে হওয়ার পর যে যার মত আলাদা হয়ে গেছে। একদিন আমার ছোট ছেলে আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। সেখানেই চলছিল আমার জীবনযাপন। একদিন আমার ছোট ছেলে ও তার স্ত্রী খুব প্রয়োজনের কথা বলে পাঁচ লাখ টাকা চেক স্বাক্ষর করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়। বেশ কিছুদিন পর তারা আবারও আট লাখ টাকা চেক দিতে বলে। কিন্তু তাতে রাজি না হওয়ায় তাকে বকাঝকা শুরু করে এবং বাড়ি থেকে বের করে দেয়। অন্যদের না দিয়ে শুধু ছোট ছেলেকে টাকা দেয়ায় অন্য সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত তার ঠাঁই হয় গাজীপুরের বৃদ্ধাশ্রমে।

তিনি বলেন, এখানে চার বছর ধরে আছি। সন্তানেরা আমাকে ভুলে থাকলেও আমি তো তাদের ভুলতে পারি না। একদিন যেই সন্তানদের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছি, রক্ত পানি করে বড় করেছি। মাটিতে রাখিনি পোকায় কামড়াবে, শীতে সারা রাত জেগে থেকে পায়ের উপর রেখে ঘুম পাড়িয়েছি। কিন্তু তারপরও তারা কেন পাল্টে যায়? শুধু আইন করে সন্তান ও বাবা-মায়ের সম্পর্ক টিকে থাকে না। আমি মনে করি- সন্তানদের আজ মানবিক শিক্ষায় দীক্ষিত করা খুব প্রয়োজন। তার সন্তানরাও সমাজে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, এক মেয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার মনিপুর বিশিয়া কুড়িবাড়ি এলাকায় অসহায় মানুষের কল্যাণে এক মানবপ্রেমী শিল্পপতির গড়ে তোলা বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে এভাবেই আছেন সামাজিকভাবে নিগৃহীত, দরিদ্র ও পারিবারিক নির্যাতনের শিকার অসহায় প্রবীণ মানুষগুলো। জীবনের সোনালি সময় অতিবাহিত করে যেখানে পড়ন্ত বয়সে আশ্রয়স্থলে স্বজনদের সুনজর ও ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের ভালবাসা পাওয়ার কথা- সেখানে আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে তাদের স্থান হয়েছে ভিন্ন এক পরিবেশে।

তিনি আরো বলেন, কর্তৃপক্ষের আদর যত্নে কোন ঘাটতি না থাকলেও মনের ভালবাসার অভাবটা বারবার উঁকি মারে। একাকী কেঁদে চোখের কোণের জলে যে সময় অতিবাহিত হচ্ছে- তা বুঝায় যায় না। তবে তাদের কোন অভিশাপ নেই- পরম মমতায় লালন করা সন্তানদের প্রতি। নিয়তিকেই মেনে নিয়ে শেষ দিনের অপেক্ষায় এই প্রবীন মানুষগুলো।

বর্তমান সরকার প্রবীন মা-বাবার ভরণপোষনের জন্য পারিবারিক আইন করলেও বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেয়া মা বাবারা সন্তানদের আইনের ঝামেলায় ফেলতে চায় না। কারণ শত দুঃখের মধ্যেও তারা সন্তানদের মঙ্গল কামনা করেন। নিজের মত ছেলে মেয়েকেও এমন আশ্রমে দিন কাটাতে না হয়, সে দোয়াও করেন।

গাজীপুর সদর উপজেলায় বিকে বাড়ি বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা খতিব মো. জাহিদ হোসেন মুকুল জানান, বাংলাদেশে ৭০-৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে দরিদ্রতা মানুষকে নিষ্ঠুর করে দেয়। ১০-২০ শতাংশ ক্ষেত্রে ঘরের নারীদের কারণে শেষ বয়সে আনেককে নানা সমস্যা কিংবা অসহায় অবস্থায় পড়তে হয়। যান্ত্রিকতা দিন দিন মানুষকে মমতা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। একসময় তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে পরিবার ছেড়ে অনেকেই বিকল্প অবলম্বন হিসেবে, শেষ আশ্রয় হিসেবে এ বৃদ্ধাশ্রমে চলে আসেন।

এই কেন্দ্রে রয়েছেন ২০৬ জন। তাদের মধ্যে ১০৬ জন পুরুষ এবং ১০০ জন নারী।

কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আবু শরিফ জানান, ছায়া-সবুজেঘেরা পরিবেশে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে নারী-পুরুষদের বসবাসের জন্য আলাদা আলাদা ভবন রয়েছে। এখানে যারা আছেন, তাদের জন্য কোন খরচ দিতে হয় না। নিবাসীদের বিনামূল্যে কাপড় ও চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়, যার যার ধর্ম পালনের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানকার নিবাসীদের জন্য বিনোদনের জন্য খেলাধুলা ও টেলিভিশন এবং পত্রিকা ও বই পড়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। তবে যারা এখানে আসতে চান তারা চলাফেরায় সক্ষম ও বয়স ৬০ বছর বা বেশি হতে হবে। বছরের বিশেষ দিনগুলোতে এবং খুব প্রয়োজন হলে কেউ চাইলে স্বজনদের কাছে যেতে পারবেন। মৃত্যুর পর এখানেই তাদের দাফন ও সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়।

(ঢাকাটাইমস/১অক্টোবর/প্রতিনিধি/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :