বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের শুরুতেই ‘হোঁচট’

বাছির জামাল
| আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০১৮, ১২:২২ | প্রকাশিত : ০৪ অক্টোবর ২০১৮, ০৯:০৮

আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিম-লে একটি কথার প্রচলন আছে, আর তা হলো: ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।’ প্রায় বেদবাক্যের মতো এই কথাটি মনে পড়লো সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারার ‘নতুন সিদ্ধান্ত’ শুনে। বি. চৌধুরীর বারিধারার বাসায় ২৬ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার দিবাগত রাতে অনুষ্ঠিত যুক্তফ্র্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের বৈঠকে একটি লিখিত প্রস্তাবনায় নতুন শর্ত দিয়েছে বিকল্পধারা। দলটির পক্ষ থেকে বিএনপিসহ বৃহত্তর ঐক্যের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি দল ও শীর্ষ নেতাদের লিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে হলে বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে আসতে হবে।

বৈঠক শেষে অধ্যাপক বি. চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘কথা পরিষ্কার, আমাদের বৃহত্তর এই ঐক্যে স্বাধীনতাবিরোধী কেউ থাকতে পারবে না। কেবলমাত্র স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষের সবাইকে নিয়ে এই ঐক্য হবে। এ ব্যাপারে বৈঠকে আমাদের মধ্যে মতৈক্য হয়েছে।’ বিকল্পধারার এমন শর্তে বলা চলে, আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর মাত্র চারদিনের মাথায় হোঁচট খেল বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য।

বাড়ির দোতলায় বি. চৌধুরীর উপস্থিতিতে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও বিএনপি নেতাদের বৈঠকের আগে নিচতলায় একটি সভা করেন মাহি বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে বিকল্পধারার একদল নেতা। ওই সভায় ‘জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি বিকল্পধারা বাংলাদেশ এবং অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দের আহ্বান’ শীর্ষক প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই বৈঠকে মাহি বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ঐক্য থাকলে তাদের সঙ্গে আমরা নাই।’ বিএনপির এক সময়ের সংসদ সদস্য মাহি বলেন, ‘বিএনপির শতকরা ৯০ ভাগ নেতা-কর্মী জামায়াতের বিরোধী, কিন্তু মুখে বলতে পারে না। আমরা যদি শক্ত অবস্থান নিই, তাহলে বিএনপি তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে জামায়াতকে ছেড়ে আসতে বাধ্য হবে।’ স্বাধীনতাবিরোধী দল বা ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত বিএনপিকে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত না করা এবং বিএনপির সঙ্গে কোনো অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে না বসতেও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের অনুরোধ জানান মাহি।

‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’কে যৌথ নেতৃত্বে পরিচালনা এবং সমন্বয়হীনতা কাটাতে একটি কেন্দ্রীয় লিয়াজোঁ কমিটি গঠনের লক্ষ্যে বি. চৌধুরীর বাসায় এই বৈঠকটি হয়, যদিও এটি হওয়ার কথা ছিল গণফোরাম সভাপতি ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাড়িতে। তবে সেখানে বি. চৌধুরীর উপস্থিত থাকতে অস্বীকৃতিসহ কয়েকটি বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত বৈঠকটি সন্ধ্যার পর অনুষ্ঠিত হয় বি. চৌধুরীর বাসায়। অসুস্থতার কথা জানিয়ে ড. কামাল বৈঠকে যাননি। বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও ছিলেন শুধু দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। বৈঠকে বি. চৌধুরী ছাড়াও জেএসডি সভাপতি ও যুক্তফ্রন্ট নেতা আ স ম আবদুর রব এবং তার স্ত্রী মিসেস তানিয়া রব, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও যুক্তফ্রন্ট নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না, গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার ওমর ফারুক, নাগরিক ঐক্যের ডা. জাহেদ উর রহমান এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব আ ব ম মোস্তফা আমীন ছাড়াও গণফোরামের দুই নেতা উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে ক্ষমতাসীন জোটের বাইরে বৃহত্তর এই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে শনিবার গুলিস্তানের ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চে ড. কামাল হোসেন, বি. চৌধুরী ও বিএনপির নেতারা একই মঞ্চে ওঠলে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখায় ক্ষমতাসীনরা। নিউইয়র্কে সেখানকার আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঐক্য প্রক্রিয়াকে অভিহিত করেন ‘খুনি, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, দলছুটদের জাতীয় ঐক্য’ বলে। মঙ্গলবার রাতে পেশাজীবীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ১৪ দলের নেতারা বলেছেন, এই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া হয়েছে নির্বাচন বানচালের উদ্দেশে।

ক্ষমতাসীন দলের এমন অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় অন্তর্র্ভুক্তির ব্যাপারে নতুন শর্তারোপে জামায়াত নিয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানায়নি বিএনপি। বি. চৌধুরীর বাসার ওই বৈঠকে বিএনপির মহাসচিবের প্রতিনিধি হিসেবে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু উপস্থিত ছিলেন। তিনি অবশ্য সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তিনি দলের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক হিসেবে বৈঠকে ছিলেন। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের লিয়াজোঁ কমিটি গঠনের বিষয়ে তিনি বৈঠকে জানিয়েছেন, শনিবারের সমাবেশের পর এই কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলে ভালো হবে। বিএনপির এই অনুরোধে সবাই একমত হয়েছেন।

উল্লেখ্য, কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্প্রতি জোট বাঁধার সিদ্ধান্ত হয় বি. চৌধুরী নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের। বিকল্পধারা, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যকে নিয়ে গঠিত এই যুক্তফ্রন্ট। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোটসহ ৫ দফা দাবিতে গত শনিবার জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশে যোগ দিয়ে একসঙ্গে আন্দোলনের কথা বলেছিলেন বিএনপি নেতারা। ওই সমাবেশে বি. চৌধুরী-কামাল হোসেনের হাতে হাত রেখে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে হটাতে যেকোনো মূল্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চান তারা এবং তার কারাবন্দি নেত্রীও সেই নির্দেশনা দিয়েছেন। বি. চৌধুরীর জোট যুক্তফ্রন্টের সদস্য সচিব মান্নাও সেদিন বলেছিলেন, বিএনপির সঙ্গে ঐক্য হয়েই গেছে। বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনের কথাও বলেছিলেন তিনি। তবে ২৫ সেপ্টেম্বর বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে মান্না বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, আমরা স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি বা সংগঠনকে ঐক্যে আনছি না।’

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, আসছে অক্টোবরে একাদশ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দেশের রাজনীতি আরো ‘টালমাটাল’ হবে। তখন ক্ষমতাসীনদের বাইরের দলগুলো আসলেই কোন দিকে যাচ্ছে তা আরো স্পষ্ট হবে। একমঞ্চে ওঠে পরস্পর হাত ধরাধরি করে আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের নেতারা। তবে বিকল্পধারা ‘জামায়াত’ নিয়ে নতুন শর্ত দেওয়ায় বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য শুরুতেই যে হোঁচট খেল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

বাছির জামাল: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :