গ্রেনেড হামলা

বাবা লিটন মুন্সির খুনিদের ফাঁসি চান মিথিলা

মাদারীপুর প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:৩৯ | প্রকাশিত : ০৯ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:২৮

‘আমার প্রথম জন্মবার্ষিকী ছিলো ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর। মায়ের মুখে শুনেছি, ঢাকা থেকে বাবার নতুন জামা নিয়ে আসার কথা ছিল। সেই জামা পরে কেক কাটার কথা ছিল আমার। কিন্তু বাবা আর আসেননি। জন্মদিনের আগেই ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আমার বাবা মারা গেছেন। তখন কিছুই বুঝিনি। বড় হবার পর আস্তে আস্তে সব বুঝতে পেরেছি।’

কথাগুলো ঢাকাটাইমসকে বলছিলেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের নিহত লিটন মুন্সির মেয়ে নুসরাত জাহান মিথিলা। একুশে আগস্টের নারকীয় গ্রেনেড হামলায় নিহত হন এই যুবলীগ নেতা। ১৪ বছর পরে ওই হামলা মামলার রায় ঘোষিত হবে আগামী বুধবার।

রায়ের দিনটিকে সামনে রেখে এখনকার কিশোরী মিথিলার দাবি, তার বাবাসহ ওই ঘটনায় নিহতদের খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি। বলেন, ‘গত ১ সেপ্টেম্বর আমার ১৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এতো বছর পার হলেও বাবাসহ বহু মানুষের অকাল মৃত্যুর কোনো বিচার হয়নি। আজও অপরাধীরা নির্ভয়ে এই দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাই সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপরাধীদের সঠিক বিচার যেন নিশ্চিত করেন। তাহলে এই ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের আত্মা শান্তি পাবে।’

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে থাকার সময় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা হয়। শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য চালানো এই হামলায় প্রাণ হারান ২৩ জন। আহত হন কয়েকশ’।

সে সময় বিএনপি সরকার এই মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। হামলাকারীদেরকে বাঁচিয়ে নিরীহ জজ মিয়াকে ফাঁসানোর চেষ্টা প্রকাশ হয়ে পড়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ওই সরকারের সময় পুলিশের তদন্তে জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান এবং জোট সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিণ্টুসহ ২২ জনের বিচার শুরু হয়।

তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর অধিকতর তদন্তে তারেক রহমানসহ নতুন করে ৩০ জনকে আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে মুফতি হান্নান এবং জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ তিন জনের ফাঁসি হয়েছে অন্য মামলায়।

শেখ হাসিনার ওই শান্তি সমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় নিহত ২৩ জনের মধ্যে মাদারীপুরেরই ছিলেন চারজন। লিটন মুন্সি ছাড়া অন্য তিনজনের মধ্যে শ্রমিক লীগ নেতা নাসিরউদ্দিনের বাড়ি কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের রামপোল, অপর যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহম্মেদ ওরফে কালা সেন্টুর বাড়ি একই উপজেলার ক্রোকিরচর এবং মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী সুফিয়া বেগমের বাড়ি রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের মহিষমারি গ্রামে।আহতদের মধ্যেও এ জেলায় বাড়ি বেশ কয়েকজনের।

নিহত চার পরিবারের সদস্যরা কেউই ভালো নেই। আহতরাও পঙ্গুত্ব নিয়ে দুঃসহ জীবন-যাপন করছেন। এসব পরিবারে শোক ও আতঙ্কের ছায়াও এখনও কাটেনি। আজও সেদিনের নারকীয় দৃশ্যের কথা মনে পড়লেই আহতরা আতঙ্কিত আর নিহতদের পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

সরেজমিনে রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামে যুবলীগ নেতা নিহত লিটন মুন্সির বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, মা আছিয়া বেগম ও বাবা আইয়ুব আলী মুন্সি একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আজও কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। লিটন মুন্সির বাড়ি ফিরে মায়ের অপারেশন করানোর কথা ছিলো। সেটি সম্ভব হয়নি। সেই কষ্টে মা আজও চোখের জল ফেলেন।

বাবা আইয়ুব আলী মুন্সি ও মা আছিয়া বেগম বলেন, ‘আমাদের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে একেবারে শেষ হয়ে গেছি। এখন আমাদের চোখের জল ছাড়া আর কিছুই নেই। সরকারের কাছে আমাদের ছেলে হত্যার বিচার চাই।’

নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন মিথিলা। এছাড়াও ঢাকার মিরপুরে একটি ফ্লাট বাসা ও গত রমজানের সময় ৫ লাখ টাকা সরকারিভাবে পেয়েছে পরিবারটি। তাই সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে খুনিদের ফাঁসির দাবি করেছেন তারা।

নিহত নাছিরউদ্দিন থাকতেন ঢাকার হাজারীবাগে। তিনি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। হাজারীবাগ শ্রমিক লীগের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের অন্ধভক্ত নাসিরকে দলের মিছিল, মিটিং, কিংবা সমাবেশ হলে কেউ বেধে রাখতে পারতেন না। মিটিং,-মিছিলের আগে থাকতেন, শ্লোগান দিতেন। প্রতিবাদী সেই নাসির উদ্দিনকেও জীবন দিতে হয়েছে সেদিন।

নিহত মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী সুফিয়া বেগম সপরিবারে ঢাকায় থাকতেন। সমাবেশের দিন নারীনেত্রীদের সাথে প্রথম সারিতেই ছিলেন সুফিয়া।

আহতদের মধ্যে কালকিনি পৌরসভার বিভাগদী গ্রামের মোহাম্মাদ আলী হাওলাদারের ছেলে হালান হাওলাদারের একটি পা গ্রেনেড হামলায় নষ্ট হয়ে গেছে। আজীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাকে। বর্তমানে তিনি ঢাকায় থাকেন।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে হালান হাওলাদার বলেন, ‘২১ আগস্ট অনেক শখ করে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য শুনতে যাই। হাজারো মানুষ ঠেলে ঠেলে মঞ্চের খুব কাছাকাছি আসতেই বোমার বিকট শব্দ হয়। তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরে দেখি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এখনও দুই হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক স্প্লিন্টার নিয়ে যন্ত্রণায় বেঁচে আছি।’

কালকিনির ঝাউতলা গ্রামের ওয়াহেদ সরদারের ছেলে সাইদুল হক সরদারও শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে যন্ত্রণাকর জীবন-যাপন করছেন। বর্তমানে চোখে ঝাপসা দেখছেন তিনি। বাঁচার তাগিদে বিভিন্ন কাজকর্ম করেও ভালো থাকতে না পেরে মালয়েশিয়ায় যান। শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে বিদেশে গেলেও শরীরে স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে সেখানেও কিছু করতে পারেননি। ফিরে আসতে হয়েছে দেশে।

সাইদুল হক সরদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মহাসমাবেশ শুরু হয়। আমি ছিলাম অনেক পিছনে। নেত্রী শেখ হাসিনাকে দেখার জন্য আস্তে আস্তে মঞ্চের ১০ থেকে ১২ হাত দূরত্বের মধ্যে চলে আসি। সেখানে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে নেত্রীর বক্তব্য শুনতে থাকি। বক্তব্য প্রায় শেষ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শেষ করতে পারেননি তিনি, তার মধ্যেই বোমা ফাটানোর শব্দ। পরপর দু’টি বোমা বিষ্ফোরণের শব্দ পেলাম। চারদিকে কালো ধোঁয়া। মানুষজনের আর্তনাদ। চিৎকার আর চিৎকার। ছোটাছুটি। আমিও কোনো কিছু না বুঝে দৌঁড় দিতে যাবো। ঠিক তখনি তৃতীয় বোমাটির বিষ্ফোরণ হয়। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। বুঝতে পারি, অসংখ্য মানুষ আমার শরীরের উপর দিয়ে যাচ্ছে। তারপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ভাবিনি, বেঁচে যাবো। বর্তমানে শরীরে যে যন্ত্রণা, এর চেয়ে সেদিন মৃত্যুই ভালো ছিলো ।’

এছাড়াও গ্রেনেড হামলায় কালকিনির কৃষ্ণনগর গ্রামের কবির হোসেনের ডান হাত বাঁকা হয়ে গেছে। ঢাকার এক বস্তিতে থেকে দিনমজুরের কাজ করেন তিনি।

দুঃসহ যন্ত্রণাকাতর জীবন-যাপনের মাঝে আহতরাও সেদিনের ঘটনায় দায়ীদের বিচার দেখার অপেক্ষায় আছেন, তারাও চান, ওই খুনিদের ফাঁসি।

(ঢাকাটাইমস/০৯ অক্টোবর/প্রতিনিধি/এআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :