শিফটে আটকে মেধাবীদের ভাগ্য

প্রকাশ | ১৪ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:১৫

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস

গত বছরগুলোর মতোই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক সম্মান শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষাও ‘বিতর্কিত’ শিফট পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে পরীক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা।

বিভিন্ন অনুষদের শিফটভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে এ অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। তবে জালিয়াতি রোধ ও অধিক শিক্ষার্থীর স্থান সঙ্কুলানে শিফটের বিকল্প দেখছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, বিকল্প থাকলেও সেদিকে চিন্তা করছে না প্রশাসন।

অনুসন্ধানে ‘এ ইউনিট’ গাণিতিক ও পদার্থ বিষয়ক অনুষদের  ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দুই দিনে আট শিফটে এই ইউনিটের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে ছেলেদের ২৩৫টি ও মেয়েদের ১৭৫টি আসনের বিপরীতে উত্তীর্ণ ১০ গুণ শিক্ষার্থীর ফল প্রকাশ করা হয়েছে। ছাত্র ও ছাত্রীদের শীর্ষ ১০০ জনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ছাত্রদের ৪৭ জনই এসেছেন প্রথমদিনের ২য় শিফট থেকে। আর দ্বিতীয়দিনের ৩য় শিফট থেকে মাত্র একজন। বাকি ছয় শিফট মিলিয়ে এসেছেন ৫১ জন। একইভাবে ছাত্রীদের ৪৭ জন এসেছেন প্রথমদিনের ২য় শিফট থেকে। আর প্রথমদিনের ৩য় শিফট থেকে মাত্র দুইজন এলেও দ্বিতীয়দিনের ৩য় শিফট (ইংরেজি মাধ্যম) থেকে কেউ আসেননি।

‘ডি ইউনিট’ জীববিজ্ঞান অনুষদেও দুইদিন মিলিয়ে নয় শিফটে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে ছাত্র ও ছাত্রীদের ১৬০টি করে আসনের বিপরীতে উত্তীর্ণ ১০ গুণ শিক্ষার্থীর ফল প্রকাশ করা হয়েছে। ছাত্র ও ছাত্রীদের শীর্ষ ১০০ জনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রথমদিনের ৫ম শিফট থেকে এসেছেন সর্বোচ্চ ৩৮ জন। দ্বিতীয়দিনের ১ম ও ২য় শিফট থেকে যথাক্রমে চারজন ও দুইজন স্থান পেয়েছেন। ছাত্রীদের প্রথমদিনের পাঁচ শিফট থেকে ৭৯ জন স্থান পেলেও দ্বিতীয়দিনের চার শিফট মিলিয়ে মাত্র সাতজন স্থান পেয়েছেন। এর মধ্যে ৪র্থ শিফট (ইংরেজি মাধ্যম) থেকে থেকে কেউ আসেননি।

‘বি’ ইউনিটের ছেলে ও মেয়েদের ১৬৩টি করে আসনের বিপরীতে উত্তীর্ণ ১০ গুণ শিক্ষার্থীর ফল প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে ছাত্র ও ছাত্রীদের শীর্ষ ৫০ জনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ছাত্রদের সর্বোচ্চ ২৬ জন এসেছেন ৪র্থ শিফট থেকে। আর ২য় শিফট থেকে স্থান পেয়েছেন মাত্র দুইজন। বাকি চারটি শিফট থেকে ২৪ জন স্থান পেয়েছেন। একইভাবে ছাত্রীদেরও সর্বোচ্চ ২২ জন চতুর্থ শিফট থেকে এসেছেন। আর ২য় শিফট থেকে স্থান পেয়েছেন মাত্র তিনজন । বাকি ২৮ জন স্থান পেয়েছেন অন্য চারটি শিফট থেকে।

‘সি ইউনিট’ কলা মানবিকী অনুষদে ছয় শিফটে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে ছেলে ও মেয়েদের আলাদাভাবে ফলাফল প্রকাশ করা সহ বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা, মাদ্রাসা- কারিগরি এই চার শ্রেণীতে ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে, বিজ্ঞান শাখায় ছাত্র ও ছাত্রীদের ৭৯টি করে আসন রয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রদের সর্বোচ্চ ৩২ জন এসেছেন ১ম শিফট থেকে। ৪র্থ ও ৫ম শিফট থেকে এসেছেন যথাক্রমে এক ও ছয়জন। বাকি তিন শিফট থেকে স্থান পেয়েছেন ৫০ জন। ছাত্রীদেরও সর্বোচ্চ ৩৪ জন এসেছেন ১ম শিফট থেকে। ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শিফট থেকে এসেছেন যথাক্রমে চারজন, শূন্য এবং তিনজন।

মানবিক শাখায় ছাত্র ও ছাত্রীদের ৮০টি করে আসন রয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রদের সর্বোচ্চ ২৪ জন স্থান পেয়েছেন ১ম শিফট এবং ৬ষ্ঠ শিফট থেকে ২১ জন স্থান পেয়েছেন। ৪র্থ ও ৫ম শিফট থেকে স্থান পেয়েছেন যথাক্রমে এক ও চারজন। বাকি দুই শিফট মিলিয়ে স্থান পেয়েছেন ৩০ জন। ছাত্রীদেরও সর্বোচ্চ ৩৪ জন স্থান পেয়েছেন ১ম শিফট থেকে। ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শিফট থেকে স্থান পেয়েছেন যথাক্রমে ছয়, তিন ও দুইজন। বাকি দুই শিফট থেকে স্থান পেয়েছেন ৩৫ জন।

ব্যবসায় শিক্ষায় ছাত্র ও ছাত্রীদের ২০টি করে আসন রয়েছে। ছাত্রদের ৫ম শিফট থেকে কেউ স্থান পাননি। ৩য় ও ৪র্থ শিফট থেকে স্থান পেয়েছেন মাত্র দুইজন। এর মধ্যে ২, ১৩ ও ১৫তম স্থান ওয়েবসাইটে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ছাত্রীদের মধ্যে ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শিফট থেকে কোনো শিক্ষার্থী স্থান পাননি। ২য় শিফট থেকে মাত্র একজন এবং  ১ম ও ৬ষ্ঠ শিফট থেকে যথাক্রমে ৫ ও ১৪ জন স্থান পেয়েছেন।

মাদ্রাসা শাখায় ছাত্রদের ১৫টি ও ছাত্রীদের ১০টি আসন রয়েছে। ছাত্র ও ছাত্রীদের মধ্যে ৪র্থ ও ৫ম শিফটের কোনো শিক্ষার্থী স্থান পাননি। কিন্তু ১ম শিফটে ছাত্র ও ছাত্রীদের চারজন এবং ৬ষ্ঠ শিফট থেকে যথাক্রমে পাঁচজন ও চারজন স্থান পেয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম এ মতিন বলেন, ‘চলমান শিফট পদ্ধতিতে একজন শিক্ষককে কয়েকটি শিফটের কয়েকগুণ প্রশ্নপত্র তৈরি করতে হয়। ফলে একজন মানুষের পক্ষে একই মানসম্পন্ন ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নপত্র তৈরি করা সম্ভব নয়। ফলে বৈষম্য তৈরি হয়েছে।’

তিনি বলেন,‘ বৈষম্য কমাতে হলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের হার কমাতে হবে। শিফটের হার কমে গেলে বৈষম্যও হ্রাস পাবে। সেক্ষেত্রে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলের ভিত্তিতেই আবেদনকারীর সংখ্যা কমানো যেতে পারে। অথবা প্রত্যেকটি শিফটে আসন নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। তাহলে ভারসাম্য বজায় থাকবে।’

এই সমস্যা থেকে উত্তরণে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়ার কথা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আশেপাশের স্কুল-কলেজে পরীক্ষা নিলে একসঙ্গে সব শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া যাবে।’

তবে উপ- উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নূরুল আলম বলেন, বাইরের কেন্দ্রে পরীক্ষা নিলে জালিয়াতির আধিক্য বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে শিফটভিত্তিক আসন নির্ধারিত করলে দেখা যাবে, কোনো শিফটে প্রশ্ন সহজ হলে ওই শিফট থেকে কম মেধাবীরা চলে আসবেন। তবে ভর্তি পরীক্ষার পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার সুযোগ আছে।

(ঢাকাটাইমস/১৩অক্টোবর/প্রতিনিধি/এআর)