গ্রিল

প্রকাশ | ১৪ অক্টোবর ২০১৮, ১৩:৩০

মনদীপ ঘরাই

সকাল সকাল উঠেই ছোট্ট ফাহিম চিৎকার করে কাঁদছে।

সে গ্রীল খাবে।

ব্যাপারটা ভাবনার। টাকা থাকলে নাকি ঢাকায় বাঘের দুধও মেলে কিন্তু সকাল বেলায় গ্রীল? উহু। একদম সম্ভব না।

এ বিষয়টি আগে মাথায় আসে নি। সকালের নাস্তায় গ্রিল খেতে চাওয়া মানুষ কি ফাহিমই প্রথম? ৬ বছর বয়সী ছোট্ট ছেলেটা আবার রেকর্ড টেকর্ড করে বসলো না তো!

কান্না থামছেই না।আরও বাড়ছে। চিৎকার শুনে বারান্দায় ছুটে এসেছে ফাহিমের দাদী

- ও দাদুভাই, হলো টা কি?

ফাহিম কাঁদার মাঝেই বললো,

- আমি গ্রিল খাবো!

মুহূর্তে চোখ বড় বড় করে তার দাদী বললো,

- বলিস কি রে। তোর বাপে তো তবু লোহা আর বিষ্ঠা ছাড়া বাকি সব খায় আর তুই লোহার গ্রিলও ছাড়লি না। হায়রে কপাল! ও বৌমা, এই বজ্জাত ছেলেরে আমার রুমের জানালার গ্রিলটা কাইট্টা দাও।বইসা খাক্।

ফাহিমের মা দৌঁড়ে এসে বললো,

- এ কেমন কথা মা! ও লোহার গ্রিল খাবে কেন? ওর বায়না তো চিকেন গ্রিল খাওয়ার জন্য!

- কি জানি বাবা। এসব আমি বুঝি না!

- গ্রিল চিকেন মানে ঝলসানো মুরগি,মা। বলতে বলতে রান্নাঘরে গেল ফাহিমের মা।

এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যর্থ বাবা কে? চোখ বুজে বলে দেয়া যায়: ফাহিমের বাবা।

শুক্রবার সকাল সকাল গ্রিল খোঁজার মিশনে বেরিয়েছে সে। গলির রাজ্জাক হোটেল থেকে বেইলি রোডের বাহারি দোকান; কিছুই বাদ যাচ্ছে না তার তালিকা থেকে।মনে মনে সে একটা কথাই ভাবছে গত ঘন্টাখানেক ধরে।

- ২৪ ঘন্টা ফার্মেসির মতো ২৪ ঘন্টা গ্রিলের দোকান যদি থাকতো। আফসোস।তা নেই।

ছোট্ট এক দোকানের বাইরে চিকেন গ্রিলের মেশিনটা দেখে দৌঁড়ে ঢুকলো ফাহিমের বাবা সিদ্দিক।

-গ্রিলড চিকেন আছে?

-অবশ্যই আছে

-পুরো একটা মুরগির গ্রিল দাও তো

-বিকেল ৫ টার পরে আসেন

-এই বেয়াদব, তাহলে আছে বললে কেন?

-আছেই তো।তয় ৫টার পরে আছে।

রাগে গজগজ করতে করতে দোকান থেকে বের হয় সিদ্দিক।

ব্যর্থ মন আর শূণ্য হাতে বাসায় ফেরে সিদ্দিক।

এ কি কান্ড?বাসায় মনে হয় উৎসব লেগেছে। গ্রিল উৎসব। তার শ্যালক প্রমিজ কোত্থেকে জানি গ্রিলড চিকেন নিয়ে এসেছে। সে এখন বাসার হিরো।

ফাহিম মজা করে গ্রিল খাচ্ছে।

যাক বাবা। বাঁচা তো গেলো। কিন্ত এত দোকান সে খুঁজলো সে তো পেল না!

প্রমিজ বুক ফুলিয়ে বলে, ও আপনি বুঝবেন না দুলাভাই। গলির মাথার রাজ্জাক হোটেল থেকে এনেছি। আমার সাথে সম্পর্ক ভালো তো, তাই...

রহস্যটা বোঝে না সিদ্দিক। সে তো কত অনুনয় বিনয় করলো। তার কাছে তো বললো না যে গ্রিল আছে!

দুপুরটা পেরিয়ে বিকেল নামে এ শহরে। সিদ্দিকের মাথায় এখনও শুধু গ্রিল ঘুরছে। এই বিকেলটাতে হাজার হাজার মুরগির ভেতর দিয়ে বাইপাস করে শিক ঢুকিয়ে মেশিনে দেয়া হচ্ছে। নির্মম এই মানব জাতি।

মেশিনটাও কি আজব রে বাবা! মুরগি গুলো সারিবদ্ধ ভাবে ঘুরছে। পেছনে আগুনের শিখা। হঠাৎ সব ছাপিয়ে মুরগিগুলোর জন্য কষ্ট হতে থাকে। আহারে। এই গ্রিল করার মেশিন আবিষ্কার না হলে কতগুলো মুরগি যে প্রাণে বাঁচতো।

হঠাৎ মনের মধ্যে অন্য চিন্তা ঢোকে। মুরগিগুলো কি একাই গ্রিল হচ্ছে? আমরাও কি তাই হচ্ছি না? কর্মজীবনটাই তো একটা গ্রিল মেশিন। পেছনে একগাদা কাজের আগুনের শিখা আর সামনে নিজেদের দক্ষতার মশলা আর অদক্ষতার তৈল মেখে ঘুরতে থাকি আমরা। পরিবেশনের অপেক্ষায়.....

এবার মুরগিগুলোকে মোটামোটি ভাগ্যবান বলে মনে হয় সিদ্দিকের। ওদের এই এফোঁড়-ওফোঁড় হওয়া একদিনের। আর সিদ্দিকের মতো যারা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে, তাদের দহনটা রোজকার।

বাহ্ কত মিল। প্রাইভেট ফার্ম!

মুরগিও ফার্মের। সিদ্দিকও। জীবনে এই উপমাটা খাঁটি বলে মনে হয় এতক্ষণে। মুরগিগুলো ঘুরেই চলছে একদিনের অফিসে...

মাথাটা আরেকটা চক্কর দিলো।দ্বিতীয় সারির মুরগিগুলো একটু ছোট সাইজের। ফাহিমের কথা মনে পড়লো। মাঠের অভাবে বাচ্চাগুলো তো ফার্মের মুরগিতে রূপান্তর হচ্ছে দিনদিন। ওদের গায়ের মসলাগুলো অন্য। কোচিং, আর্ট,গান,কবিতা শেখার ক্লাসের মসলা।

তৃতীয় সারিতে প্রমিজকে দেখতে পায় সিদ্দিক। এরা ঘুরছে। তেল মশলা নেই। বেকার। তবে এরাই আবার কখনও কখনও ব্যাপক কাজের হয়ে দেখা দেয়। এই যেমন আজ সকালে...

পরিবারটা পুরো হলো না দেখে একটু খচখচ করছে সিদ্দিকের মনে। পাশেই একটা শর্মা বানানোর মেশিন। নিজের স্ত্রী আর মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল। এলোমেলো হয়ে পরিবারের জন্য অবদান রেখে চলছে আজীবন। কিন্তু নিজের সত্ত্বাটাকে বিলিয়ে দিতে হয়েছে দায়িত্ব নামক মেয়োনিজ আর সালাদে। চারপাশে পেঁচিয়ে ধরে আছে পরিবার নামক রুটির বেষ্টনী। আমাদের জীবনটা গ্রিল,তাদেরটা শর্মা। দহন আছে দু' দিকেই।

শহরে রাত নামে। গভীর রাত। সিদ্দিকেরা ঘরে ফেরে। অবিক্রিত মুরগিগুলোর ভাগ্যে কি জোটে? জবাব মেলে না। এসব চিন্তা করতে করতেই ঘুমের সাগরে ডুব দেয় সিদ্দিক।

পরদিন ঘুম ভাঙ্গে ফাহিমের দাদীর চিৎকারে।

- বৌমা। তাড়াতাড়ি এসো। দেখো তোমার ছেলের কান্ড। ওতো সত্যি সত্যি বারান্দার গ্রিল খেয়ে ফেলেছে! কি ছেলেরে বাবা।

সবাই দৌঁড়ে আসে। ফাহিমও। সত্যিই তো জানালার গ্রিল একটা বাঁকানো। আরও একটা নেই।

ফাহিম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

সবাই চমকে ওঠে প্রমিজের চিৎকারে।

- আপুরে, আমার মোবাইল চোরে নিয়া গেছে।

বাসার সবার মোবাইল গায়েব। ফাহিমের দাদীর রেডিওটাও নেই। ফাহিম বারান্দার গ্রিল খায় নি। গ্রিল কেটে চোর ঢুকে সবার মোবাইল নিয়ে গেছে।

সবার মন খারাপ। কিন্তু গা থেকে লোহার গ্রিল খাওয়ার অপবাদ ঝেড়ে ফেলতে পেরে ফাহিম কিন্তু খুশি!

ঘন্টাখানেক পর থানায় যায় সিদ্দিক আর প্রমিজ। পুলিশী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এ কি কান্ড থানার গারদে বন্দী রাজ্জাক হোটেলের মালিক! হচ্ছে টা কি?

হোটেল মালিকের অপরাধ শুনবেন? মুরগিগুলোকে চাকরি দিয়েছিল সে। বুঝতে কষ্ট হচ্ছে? সিদ্দিকের চিন্তাটা মনে করুন। মুরগিগুলোর গ্রিল হওয়াটা একদিনের হওয়ার কথা! দিনের পর দিন অবিক্রিত গ্রিলড চিকেন ফ্রিজ থেকে বের করে আবার আগুনে ঝলসাতো সে। অর্থাৎ প্রায় পার্মানেন্ট চাকরি...

এজন্যই গতকাল প্রমিজ সকাল সকাল গ্রিল কিনতে পেরেছে! এখন গা গুলোচ্ছে সিদ্দিকের।

চুরির সমাধান হয়েছে। চোর ধরা পড়েছে। ততক্ষণে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। বাসায় ফেরার পথে গলির মুখে এসে থমকে দাঁড়ায় সিদ্দিক। সাথে প্রমিজ। মালিক থানায়। কিন্তু ধুমসে চলছে রাজ্জাক হোটেল।

মুরগিগুলো আজও ঘুরছে মেশিনে। পেছনে আগুন....