‘সম্পাদকরা রাস্তায় এটা সরকারের জন্য শুভলক্ষণ নয়’

প্রকাশ | ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ১২:৫৭

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নয়টি ধারা সংশোধনের দাবিতে সম্পাদক পরিষদের মানববন্ধনকে ‘নজিরবিহীন’ হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম। স্বাধীনতার পর সম্পাদকরা এভাবে আর কখনও রাস্তায় নামেননি বলে জানান তিনি। তবে সম্পাদনার টেবিল ছেড়ে সম্পাদকদের এভাবে রাস্তায় নেমে আসা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য ‘শুভলক্ষণ’ নয় বলে মনে করেন তিনি। এটা বিশ্বকে ভালো বার্তা দেবে না বলে মন্তব্য করেছেন এই সম্পাদক।

সোমবার মধ্যরাতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের সংবাদপত্র পর্যালোচনামূলক অনুষ্ঠান ‘আজকের সংবাদপত্রে’ আলোচক হিসেবে অংশ নিয়ে নঈম নিজাম এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানটির উপস্থাপনায় ছিলেন দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী।

সোমবার সকালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নয়টি ধারা সংশোধনের বিষয়ে ছয় দফা দাবিতে মানববন্ধন করে সম্পাদক পরিষদ। এই আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়ার পর থেকে এর বিভিন্ন ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিল সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। তাদের আপত্তির সুরাহা না করেই গত ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে ওই আইন পাস করা হয়।

সোমবারের মানববন্ধন সম্পর্কে নঈম নিজাম বলেন, ‘সম্পাদকদের এই মানববন্ধন আসলেই নজিরবিহীন। ষাটের দশকে সম্পাদকরা বলিষ্ঠ ভূমিকায় অবস্থান নিতেন। মাওলানা আকরাম খাঁ ৮০ বছর বয়সে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলেন। স্বাধীনতার পর এই প্রথম সম্পাদকরা মানববন্ধন করেছেন, এর আগে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন।’

নঈম নিজাম বলেন, ‘কোনো বিষয়ে একটি পেশাজীবী গ্রুপ যখন তাদের অবস্থান থেকে বক্তব্য দেয়, তখন যে সংকট তৈরি হয়, এই সংকট নিরসন করা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব, এটা আমরা প্রত্যাশা করে থাকি।’

‘তিনজন মন্ত্রী যখন আমাদের সঙ্গে বৈঠক করলেন তখন আমাদের একটা আশাবাদের জায়গা তৈরি হয়েছিল। মনে করেছিলাম সংকটের সমাধান এবার হবে। আমরা যে নয়টি ধারা সংশোধনের কথা বলেছিলাম, এর কমবেশি তারা মানবেন হয়তো।’

‘পুলিশকে অ্যাবসুলুট পাওয়ার দিয়ে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা, সেটি একটি বিষয়। অনেকগুলো অখ্যাত অনলাইন গণমাধ্যম বিভ্রান্তমূলক সংবাদ পরিবেশ করে সরকারকে বিব্রত করছে। এটা কি সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। এই আইন দিয়ে কি সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’

বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক বলেন, ‘আমরা সাইবার ক্রাইমের বিপক্ষে। আমরা চাই কঠোরভাবে সাইবার ক্রাইমকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যাতে নারী-শিশুসহ যেকোনো ব্যক্তি অপমানিত না হন। আমাদের কনসার্ন ছিল মূলধারার গণমাধ্যম যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, এদের ওপর কোনো আঘাত যেন না আসে।’

নঈম নিজাম বলেন, ‘সরকারের সব মানুষ কি ধোয়া তুলসি পাতা! সরকারের নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে, ড্রাগ ডিলারি করছে, সরকারের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করছে, মাদক ব্যবসা করছে। আমরা যদি তার বিরুদ্ধে সংবাদ পরিবেশন করি, পরে সে যদি পুলিশকে কনভেন্স করে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়। পুলিশ আমার কম্পিউটার জব্দ করে, সার্ভার নিয়ে চলে যায় অথবা আমাকে আটকও করতে পারে। এ জায়গাগুলোতে সরকার স্পষ্ট করলে সমস্যা কোথায়। আমাদের বক্তব্য হলো সরকার বলে দিক এই আইনটা শুধু সাইবার ক্রাইমের বিষয়ে থাকবে, গণমাধ্যমের ওপর কোনো আঘাত আসবে না। এটা সরকারের গুরুত্বের সঙ্গে ভাবার দরকার, সবকিছু খামখেয়ালির বিষয় থাকতে পারে না। আপনি কোনো কিছু আপনার গায়ে লাগালেন না, স্পর্শ লাগলো না এটাতো ঠিক নয়।’

আইন পাসের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারের চাইলে যেকোনো কিছু সম্ভব, কারণ সরকারের চেয়ে শক্তিশালী কেউ নয়। আগামী অধিবেশনে যদি সরকার তা সংশোধনের চিন্তা করে তা সম্ভব।’

সম্প্রচার আইন নিয়ে তিনি বলেন, ‘এই আইনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তারা অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক। আমাদের অনেক সিনিয়র সাংবাদিকও ছিলেন । তারা কী করে এই শব্দগুলো যোগ করলেন!’

‘ইতিহাসের পরতে পরতে নানা রকম সমস্যা থাকে, একেকটা সরকারের নানারকম দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। আজকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, কিন্তু কোনো রকম সমস্যা তৈরি হলে! ৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপব্যবহার হয়েছিল, যে সংকটের তৈরি হয়েছিল, নতুন আইনে কি তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। শিক্ষক ও সাংবাদিকরা কী সুপারিশ করেছিলেন তা পরিষ্কার হওয়া দরকার। অপরাধ, সাইবার ক্রাইমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রচলিত আইনে অনেক ধারা রয়েছে।’

নঈম নিজাম বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশ আমার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমার, জাতির জনক আমার সাহস শক্তি অর্জনের বিষয়। আমি মনে করি শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শেষ ঠিকানা। আরেকজন তা নাও মনে করতে পারেন। সেই আমার বিরুদ্ধে মামলাও করে দিতে পারে।’

‘আইনতো একটা ক্ষণস্থায়ী কিংবা একদিনের বিষয় নয়, এটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। আমি জানি না, মূলধারার গণমাধ্যমের সঙ্গে কারা এই ঝামেলা তৈরি করেছে। এগুলো দরকার নাই। আমরাও বর্তমান সরকারের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। সরকারের ধারাবাহিকতা থাকুন, দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা চলুক। কিন্তু আর্থিক খাতে অনিয়ম হলে আমরা বলব। রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গিবাদ সৃষ্টি হলে তা আমরা বলবো। অনিয়ম, লুটপাট, নৈরাজ্যের বিষয়ে আপনি আমি কি বলব না, লিখব না?  সেই জায়গাগুলো না থাকলে মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসবে, নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। আমরা গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে গণতান্ত্রিক পরিবেশ আশা করি।’

জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের সঙ্গে গণমাধ্যমের একটা বৈরীভাব তৈরির চেষ্টা চলছে, এটা কোনোভাবে ঠিক নয়। আজকে দেশের সম্পাদকরা রাস্তায়, এটা সারা বিশ্বের সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে, তা কিন্তু শুভলক্ষণ নয় সরকার, দেশ এবং সমাজের জন্য। এটা সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে। আমরা সমাজে অস্থিরতা দেখতে চাই না।’

‘যদি এই আইন করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে ভালো। কিন্তু বিদেশ থেকে অনেকই অনেক কথা বলছেন, তা তো বন্ধ করতে পারছেন না। বাঁশের কেল্লাতো বন্ধ করতে পারছেন না। যারা আপনার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে তাদের ধরতে পারছেন না, আপনি ধরছেন মূলধারার গণমাধ্যমকে। দুই একজনের জন্য আপনি কেন একটা পেশাজীবী শ্রেণিকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। এই পেশার প্রায় শতভাগ মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, এটা দূর করতে হবে।’

(ঢাকাটাইমস/১৬অক্টোবর/টিএ/জেবি)