সমাবর্তনে পূর্ণ হোক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
| আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:৪০ | প্রকাশিত : ২১ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:৩৭

২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে পাসকৃত ২৮নং আইন বলে ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়। ১৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অতিক্রম করে আজ ১৪তম বর্ষে পা রেখেছে এই বিদ্যাপীঠ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এদেশে। তবে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই এত অল্প সময়ে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠ হিসেবে স্থান করে নিতে পারেনি। এক ঝাঁক তরুণ মেধাবী শিক্ষক; আর জীবনের নানা বাঁকে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ডালা সাজিয়ে বসা খ্যাতিমান অধ্যাপকের পদভারে মুখরিত এই বিদ্যাপীঠ অল্পসময়েই ভর্তিচ্ছুকদের প্রথমদিকের পছন্দের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। তাই প্রতি বছরই মেধাবী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে এই বিদ্যাপীঠে।

প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে ভর্তি পরীক্ষায় এ বছর থেকে এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে লিখিত পরীক্ষা চালু হলেও ভর্তিচ্ছুকদের কাছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আকর্ষণ একটুও কমেনি। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আগত ভর্তিচ্ছুকদের পদভারে এই বিদ্যাপীঠের ক্যাম্পাস মুখরিত হওয়াই প্রমাণ করছে শিক্ষার্থীদের প্রথম দিকের অন্যতম পছন্দ তালিকায় এখনও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছে জ্যামিতিক হারে। এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করেও স্নাতক সম্মান শেষেই চাকরির বাজারে অভাবনীয় সফলতা পেয়েছে। বিসিএস পরীক্ষায়ও তাদের সাফল্যের হার ঈর্ষণীয়। চারুকলার কার্যক্রম চালু, পয়লা বৈশাখ উদযাপন, বসন্ত উৎসব এবং ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রগতিশীল দিবসগুলো উদযাপনের মাধ্যমে জগন্নাথকে কেন্দ্র করে পুরোনো ঢাকায় একটি সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে উঠেছে। যা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রগতিশীলতা চর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত করেছে।

দুই.

অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শূন্য থেকেই পথচলা শুরু করেনি। এর রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। পাঠশালা থেকেই যার যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ১৮৬৮ সালে। বর্তমান জগন্নাথ ক্যাম্পাস যেখানে অবস্থিত সেই জায়গায় এই পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বালিয়াটির জমিদার জগন্নাথ রায় চৌধুরী। জগবাবুর পাঠশালাকে ১৮৮৪ সালে কলেজে উন্নীত করেন জমিদার জগন্নাথ রায় চৌধুরীর সুযোগ্য পুত্র জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী। এবার ব্রিটিশ সরকারের নেক নজর পড়ল এই বিদ্যাপীঠের উপর। ওই বছরই এই বিদ্যাপীঠকে ‘ঢাকা জগন্নাথ কলেজ’ হিসেবে স্বীকৃত দেয় ব্রিটিশ সরকার। অচিরেই ভারতে খ্যাতিমান বিদ্যাপীঠগুলোর মধ্যে এই কলেজ নিজের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়। ১৮৮৭ সালে স্কুল ও কলেজ শাখাকে পৃথক করা হয়। তখন স্কুলের নাম হয় ‘কিশোরী লাল জুবিলী স্কুল’। শিক্ষাক্ষেত্রে ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে ১৯২০ সালে ইন্ডিয়ান লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ‘জগন্নাথ কলেজ আইন’ পাস করে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘর পুড়েছিল ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে। ১৯২১ সালে জগন্নাথ কলেজকে অবনমন করা হয় ভারতীয় লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ‘জগন্নাথ কলেজ অ্যাক্ট’ পাস করে। এই আইনের ফলে এই বিদ্যাপীঠকে ‘জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ’ নামকরণ করে এর স্নাতক পর্যায়ে পাঠদানের ক্ষমতা রহিত করা হয়। এই বন্ধ দুয়ার খুলেছিল ওই ঘটনার ২৮ বছর পর। ১৯৪৯ সালে এই বিদ্যাপীঠে পুনরায় স্নাতক পর্যায়ে পাঠদান শুরু হয়।

ভাষা আন্দোলনসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি স্তরে এই বিদ্যাপীঠের অসামান্য অবদান রয়েছে। জগন্নাথ কলেজের ছাত্র শিক্ষকদের আন্দোলনে, মিছিলে-মিটিংএ শ্লোগানে পাকিস্তানিদের দোসর মোনেম খানের গদি টলমল করছিল। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খানও কম যান না। তিনিও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। ফন্দি আঁটছিলেন কীভাবে শায়েস্তা করা যায় এই বিদ্যাপীঠের ছাত্র-শিক্ষকদের। ১৯৬৮ সালে এক দূরভিসন্ধিমূলক চক্রান্তে আর তৎকালীন অধ্যক্ষ ইরশাদুল্লাহর বুদ্ধিহীনতায় জগন্নাথ কলেজকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা জুতসই মওকা পেয়ে গেল সরকার। সরকার সমর্থিত গুন্ডণ্ডা ছাত্র সংগঠন এনএসএফ এর সাথে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়েনের সংঘাতে শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায় জগন্নাথ কলেজ। খুলল মাস ছয়েক পরে একেবারে সরকারি কলেজ হয়ে। সরকারিকরণের মাধ্যমে স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম পাদপীঠ এই বিদ্যাপীঠে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর ডিগ্রি স্তরকে ছাঁটাই করে নিয়ে যাওয়া হলো মহাখালীতে, নবীন কলেজের নাম দেয়া হল ‘জিন্নাহ কলেজ’ (বর্তমান তিতুমীর কলেজ)। স্বাধীন বাংলাদেশে আবার মাঁথা উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগ পেয়েছিল এই বিদ্যাপীঠ।

সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই বিদ্যাপীঠের ছাত্র-শিক্ষকরা অসামান্য অবদান রেখেছিল। ১৯৭২ সালে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলীর বদন্যতায় পুনরায় এই বিদ্যাপীঠে উচ্চস্তরের পড়ালেখা চালু হয়েছিল। ওই সময়ে অর্নাস ও মাস্টাস কোর্স খোলার অনুমতি পায় এই বিদ্যাপীঠ। বাংলাদেশের অন্য অনেক কলেজের মতো এই কলেজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। ১৯৯১-৯২ শিক্ষাবর্ষ থেকে একে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়।

সর্বশেষ ইতিহাস প্রায় সবার জানা: ২০০৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উদ্যোগে মহান জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন (২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৫) পাস হয়। জগবাবুর পাঠশালা থেকে এই বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে পরীক্ষামূলকভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্য আরও তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় মডেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে সাজানো হয়েছিল। নিজস্ব আয়ে চলবে বলে একটি ধারা সংযুক্ত ছিল বিশ্ববিদ্যালয় আইনে। সর্বশেষ ছাত্র-শিক্ষকদের যুগপৎ আন্দোলনের ফলে সেই ধারাও বিলুপ্ত হয়েছে। সরকারও রাজি হয়েছে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে।

তবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে হল না থাকায় এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের ব্যয় বহুল ঢাকা শহরের নানা মেস-বাসা-বাড়িতে কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়। প্রিয় মেধাবী শিক্ষার্থীদের দিকে তা’কালে বড্ড কষ্ট হয়। কাক ডাকা ভোরে উঠে যাদেরকে ক্যাম্পাসের বাস ধরতে হয়। আর ক্লাস থাক আর না থাক কাঠফাটা রোদে এখানে সেখানে ঘুরে-ফিরে ফিরতে হয় পড়ন্ত বিকেলে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ক্লান্ত দেহ-মন পড়তে বসতে সায় দেয় না। হল না থাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও তাদের বাড়তি খরচ করতে হয়। তাই সেই টাকা যোগাড় থেকে গরিব পিতাকে নিষ্কৃতি দিতে ক্লাস শেষে ছুটতে হয় টিউশনি পানে। এভাবে রচিত হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর দিনলিপি। যদিও কয়েকদিন আগেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেকের ১৪৬ তম সভায় এক হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন: ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে।

এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হলে থাকার স্বপ্ন পূরণ হবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মাত্র ১১ দিন পূর্বে এমন প্রকল্প অনুমোদিত হওয়াই এ বছরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হবে ভিন্ন আবহে। বিশ্ববদ্যিালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্রাবাস, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থার যে দাবি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা দীর্ঘদিন করে আসছে তা পূরণ হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় এমনিতেই তাদের মনে আনন্দ বিরাজ করছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে এবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উৎসব।

তবে এই আনন্দের পরিপূর্ণতা এনে দেবে ছাত্র-শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের সমাবর্তনের দাবি পূরণ হলে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করছে। তাদের দীর্ঘদিনের মনোবাসনা সমাবর্তনের গাউন পরে মাথায় টুপি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, সিনিয়র-জুনিয়রদের সাথে আনন্দে মেতে উঠবে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর পার হলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনের আয়োজন করতে পারেনি। যদিও সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য সমাবর্তনের স্থান ও সময় নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছেন। ইতোমধ্যে উক্ত কমিটি সভা করলেও সমাবর্তনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষিত হয়নি। প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর বক্তৃতায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় মাননীয় উপাচার্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করে নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণ এবং প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনন্দের পরিপূর্ণ এনে দেবে বলে এ বিদ্যাপীঠের ছাত্র-শিক্ষকরা আশা করে।

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :