যানজটে রাস্তা যখন পৌঁছাবে গন্তব্যে!

আবু সাইয়ীদ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০১৮, ১৩:৩১ | প্রকাশিত : ২৪ অক্টোবর ২০১৮, ১৩:০৯

নিঃসন্দেহে বর্তমানে পৃথিবীর বেশ কিছু শহরের প্রধানতম সমস্যা যানজট এবং বায়ু দূষণ। ঢাকা শহরের যানজট এমন এক পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছে যে প্রতিদিন বার লক্ষ কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। বছরে অপচয় হচ্ছে ত্রিশ হাজার কোটি টাকা। যানজটে বসে থাকতে থাকতে মানসিক যন্ত্রণা বাড়ছে যাত্রীদের, যার প্রভাব পড়ছে তাদের ব্যক্তি জীবনেও। সমীক্ষায় বলা হচ্ছে বর্তমানে ঢাকায় যানবাহনের গতি ঘণ্টায় ৭ কিলোমিটার। এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সালে নাকি তা ৪ কিলোমিটারে দাঁড়াবে! সাধারণত মানুষ প্রতি ঘন্টায় পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতে পারে। অর্থাৎ আমাদের যানবাহনের গতি হাঁটার গতির চেয়েও কমে যাবে মাত্র ৭ বছরের মধ্যেই। হয়তো এই রকম বা এর কাছাকাছি যানজট সংকট পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে রয়েছে। হতে পারে কোন শহরের সংকট এর চাইতেও তীব্র।

যানজট সংকট নিয়ে আমরা যতটা উদ্বিগ্ন, ততটা উদ্বিগ্ন নই বায়ু দূষণ বা পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে। এর মূল কারণ আমাদের উপর এ দুইয়ের প্রত্যক্ষ এবং প্ররোক্ষ প্রভাব। যানজটের সংকট যেমন প্রতিনিয়ত সরাসরি আমরা প্রত্যক্ষ করি, পরিবেশ বিপর্যয় সেভাবে সরাসরি প্রত্যক্ষ করি না। পরিবেশ দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে অসহনীয় পর্যায়ে যাচ্ছে তা আমরা তীব্রভাবে অনুভব করি কিন্তু এর পেছনে যে অনেক কারণের এক কারণ জ্বালানী তেলে চালিত মোটরযান, বিশেষ করে শহর অঞ্চলে বায়ু দূষণের প্রধানতম কারণ মোটরযান, তা হয়তো আমরা ভেবে দেখি না। বিশেষ করে মোটর যান যখন আমাদের চলাচলে অপরিহার্য মাধ্যম হিসেবে দাঁড়িয়েছে, এই মোটর যান ছাড়া আমরা আমাদের কোন পদক্ষেপই দিতে পাচ্ছি না, তখন এর ক্ষতিকারক দিকগুলিকে আমরা বিবেচনাতেই আনছি না।

একাধিক পদ্ধতি এবং নিয়ন্ত্রণের মধ্যদিয়ে রাস্তায় যানবাহন চলাচল করে থাকে। এই পদ্ধতির ভেতরে থেকেই যানবাহন ও রাস্তাকে বিকশিত করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বিগত শত বছরে এই পদ্ধতির ব্যপক পরিবর্তন হয়েছে। আমরা বিচিত্রসব যানবাহন পেয়েছি। এই পরিবর্তন যেমন হয়েছে যানবাহন নির্মাণে তেমনি রাস্তা নির্মাণেও এসেছে ব্যপক পরিবর্তন। এই পরিবর্তন সাধন হয়েছে মানুষের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়েই। মানুষ প্রয়োজনে ঘর থেকে বেড়িয়ে পথে নেমেছে তাই পথ তৈরি করতে হয়েছে। এই সংখ্যা যখন আরও বেড়েছে তখন পথকে প্রশস্ত করতে হয়েছে। এক সময় প্রসস্থ পথেও মানুষের সঙ্কুলান না হওয়ায় মাটির নিচে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। উড়ন্ত সেতু, উড়ন্ত রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। যানজটমুক্ত থেকে মানুষের চলাচল নির্বিগ্ন করার জন্য মূলত উড়াল সড়ক, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল প্রভৃতি নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও যানজট সংকট থেকে উত্তরণে বিভিন্ন পরিকল্পনা করা এবং প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বেশ ইতিমধ্যে কয়েকটি উড়ালসেতু নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে কিছু উড়ালসড়ক ও মেট্রোরেলের নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং কাজ এগিয়ে চলছে। কিন্তু উড়াল সেতু নির্মাণের মধ্যদিয়ে যানজট সংকট উত্তরণের যে প্রত্যাশা করা হয়েছিল তা পুরণ হয়নি। বরং ঢাকা শহরে যানজট আরও বেড়েছে। উড়ালসেতু এবং উড়ালসড়ক অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং উন্নত কারিগরি ধারণা। উড়ালসেতু এবং উড়ালসড়ক নির্মাণে বিভিন্ন রাস্তার সংযোগ স্থলে প্রয়োজন হয় বিস্তীর্ন আয়তনের জায়গা। ঢাকাসহ পৃথিবীর অনেক শহরেই এই প্রয়োজনীয় জায়গা বের করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া উড়ালসেতু এবং উড়ালসড়ক নির্মাণই শেষ কথা নয়, এই সব সড়কে প্রয়োজন হয় উন্নত যানবাহনের। সব মিলিয়ে উড়ালসড়ক নির্মাণ ও গাড়ি ক্রয়সহ সড়ক পরিবহণ খাতে আবর্তিত হচ্ছে এক বিশাল অংকের অর্থ। এই পদ্ধতি জ্বালানী তেল চালিত গাড়ীকে উৎসাহিত করে বলে শহরের পরিবেশের জন্য হুমকি বয়ে আনে।

এ ছাড়া আমরা চাইলে কি সব শহরেই মাটির নিচে রাস্তা তৈরি করতে পারব? এবং পারলেও সেটা কয় স্তরে? পারব কি বিভিন্ন ক্রসিং এ ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে বা উড়াল সড়ক নির্মাণ করতে? নগর পরিকল্পনায় সেই পরিমাণ জায়গা কি জায়গা কি রাখা হয়েছে? আর জায়গা থাকলেও উড়াল সেতু বা উড়াল সড়ক আমরা কয় স্তরে নির্মাণ করতে সক্ষম হব? ৬, ৭, ৮? তারপর? এটা অনিবার্য যে এক সময় উড়াল সেতু বা উড়াল সড়ক নির্মাণের যে সম্প্রসারণ সেখান থেকে বেড়িয়ে আসতেই হবে। আমাদের মানতেই হবে যে সমস্ত অগ্রযাত্রারই সীমাবদ্ধতা আছে এবং শেষ আছে।

অনেক ক্ষেত্রেই এই পদ্ধতি আর কার্যকর ভূমিকা রাখতে পাচ্ছে না। অনেক শহরেই ট্রাফিক জ্যাম এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

বর্তমান বাস্তবতায় একটি শহরের ট্র্যাফিক জ্যাম সমস্যায় কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারবে এমন এক প্রত্যাশা থেকেই পরিবহন পদ্ধতিতে নতুন এক ধারণা উপস্থাপন করা হচ্ছে।এই ধারণাটির নাম দেয়া হয়েছে চলন্ত রাস্তা বা মুভিং রোড।

চলন্ত রাস্তাঃ পদ্ধতি

ফ্লাইওভার এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল এর জন্য পর্যাপ্ত জায়গার প্রয়োজন হয়। এ কারণে অনেক শহরেই এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না

একটি গাড়ীকে উপরে উঠানো এবং নামানো বেশ জটিল এক প্রক্রিয়া। গাড়িকে উপরে উঠাতে এবং নামাতে গিয়ে যে র্যা ম্প তৈরি করতে হয় তা অনেক সময় রাস্তার প্রায় সমপরিমাণ জায়গা নিয়ে নেয়। পাশাপাশি একজন মানুষকে উপরে ওঠানো এবং নামানো সহজ একটি প্রক্রিয়া।

সিঁড়ি, চলন্ত সিঁড়িবা লিফট, যে মাধম্যেই মানুষকে উপরে ওঠানো বা নামানো হোক না কেন তা বর্তমান সময়ে অনেক সহজ এক প্রক্রিয়া। চলন্ত রাস্তা ধারণায় একটি গাড়িকে উপরে ওঠানো এবং নামানোর পরিবর্তে একজন মানুষকে উপরে ওঠনো এবং নামানোর পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে।

বর্তমান একজিশটিং সড়কে চলন্ত রাস্তা দুইভাবে স্থাপিত হতে পারে। সড়কের মাঝ বরাবর অথবা দুইপাশ বরাবর। চলন্ত রাস্তার ধারণাগত মডেল প্রদর্শিনিতে সড়কের দুইপাশ বরাবর চলন্ত রাস্তা স্থাপন করা হয়েছিল।

মাঝ বরাবর অথবা দুইপাশ বরাবর যেখানেই স্থাপিত হোক না কেন,চলন্ত রাস্তা একজিশটিং সড়কের ২০ ফুট উপরে স্থাপিত হবে।

যদি সড়কের মাঝ বরাবর স্থাপন করা হয় তাহলে, ৬ ফুট প্রস্থের পাশাপাশি দুটি চলন্ত রাস্তা স্থাপিত হবে। একটি রাস্তা অপরটির বিপীরিত দিকের গতিতে চলবে। দুই রাস্তার দুই দিকে আনুমানিক ৮ ফুট প্রস্থের ২টি প্লাটফর্ম থাকবে। প্রতিটি রাস্তায় ২টি রেল লাইনের উপরে ৭২ ইঞ্চি বাই ৩০ ইঞ্চি একেরপর এক পাটাতন স্থাপিত হবে।

এপাশওপাশ মিলে চলন্ত রাস্তার দৈর্ঘ্য ৫ থেকে ৫০ কিলোমিটার যাই হোক না কেন, চলন্ত রাস্তা এক অখন্ড যান হিসেবে চলমান থাকবে। শহরের ভেতরে চলাচলের জন্য একটি চলন্ত রাস্তার গতি নির্ধারন হতে পারে ২০ থাকে ৬০ কিমি পার আওয়ার। নির্ধারিত গতিতে চলন্ত রাস্তা ১ থেকে ৩ মিনিট চলারপর৫থেকে১৫ সেকেন্ডের জন্য থামবে। কোন এক শহরে কোন একটি চলন্ত রাস্তার কত গতি হবে এবং কত মিনিট পর কত সেকেন্ডের জন্য থামবে তা নির্ধারিত হবে সার্বিক বাস্তবতার উপর। অর্থাৎ একটি শহরে বিভিন্ন চলন্ত রাস্তার জন্য বিভিন্ন গতি নির্ধারিত হতে পারে। একই শহরে একটি চলন্ত রাস্তার গতি হতে পারে ৫০ কিমি/আওয়ার, আবার অন্য একটি চলন্ত রাস্তার গতি হতে পারে ২০ কিমি/আওয়ার।

রাস্তার প্রতিটি জাংশন স্বাভাবিক যান চলাচলে অন্তরা হয়ে দাঁড়ায়। তাই যান চলাচলকে সচল রাখতে ফ্লাইওভার ধারণায় জাংসনে উলম্ব বরাবর রাস্তাকে কয়েক স্তরে স্থাপন করতে হয়। কোন জাংশনে দুই স্তরের চলন্ত রাস্তা হলে ওভারপাসের মত একটি চলন্ত রাস্তা অপর চলন্ত রাস্তাকে ওভারটেক করবে। আবার এক স্তরের চলন্ত রাস্তা হলে বিভিন্ন জাংশনে বিভিন্ন দিক থেকে আসা চলন্ত রাস্তা ইউটার্ন করে বিপরীত দিকে চলে যাবে। জাংশনে চলন্ত রাস্তাকে ইউটার্ন করে বিপরীত দিকে চালিয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু কোন এক গাড়ি চলাচলের রাস্তাকে ইউটার্ন করে বিপরীত দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ কোন গাড়ি সামনে যাবার জন্য রাস্তায় নেমেছে বিপরীত দিকে ফিরে যাবার জন্য নয়। যাত্রী ইউটার্ন করার আগের স্টপেজে নেমে প্লাটফর্ম দিয়ে হেঁটে গিয়ে সামনের চলন্ত রাস্তায় গিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু একটি গাড়ির পক্ষে এই প্রক্রিয়ায় রাস্তা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। এ কারণেই প্রয়োজন হয় একাধিক স্তরের ওভারপাস।

যেমন ধরা যাক, এ-বি রুটের চলন্ত রাস্তায় কোন যাত্রী উঠলেন কিন্তু তিনি এম স্থানে যাবেন। এম স্থানটি এ-বি রুটে পড়বে না, সি-ডি রুটে পড়বে। সেক্ষেত্রে এই যাত্রীকে এ-বি রুটের একটি স্থান, যাকে এন স্থান বলা যায়, যাত্রী সেই এন স্থানে নেমে সি-ডি রুটের চলন্ত রাস্তায় উঠতে হবে। এ-বি এবং সি-ডি দুটি আলাদা চলন্ত রাস্তা হলেও এই দুই রুটের প্লাটফর্মের মধ্যে সংযোগ থাকবে। যাত্রীদের সুবিধার্থে একটি শহরে যদি শতাধিক চলন্ত রাস্তার রুট থাকলেও একই সেডের নিচ দিয়ে এক প্লাটফর্ম থেকে আরেক প্লাটফর্মের যাবার সুবিধা থাকবে। প্রচলিত কোন পরিবহন পদ্ধতিতে এমন সুবিধা নেই একটি রুটের বাস বা ট্রেন থেকে নেমে অন্য একটি রুটের কোন বাস বা ট্রেনে উঠতে যাত্রীদের অনেক ঝোক্কি পোহাতে হয়। বৃষ্টির দিন হলে ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। কিন্তু চলন্ত রাস্তার যাত্রীদের এই ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে না। একটি শহরে স্থাপিত বিভিন্ন চলন্ত রাস্তা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে কিন্তু সকল রাস্তার প্লাটফর্ম একে অপরের সাথে যুক্ত থাকবে। এতে যাত্রীরা এক রাস্তা থাকে নেমে প্লাটফর্ম ধরে অন্য রাস্তায় যেতে পারবে। অতি বর্ষণে শহরের রাস্তার কিছু অংশ ডুবেই যাক অথবা অন্যকোন কারণে নিচের রাস্তা বন্ধ থাকলেও চলন্ত রাস্তা ঠিকই চলবে তার আপন গতিতে।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তা বিবেচনায় এনে নিম্ন লিখিত রুটে চলন্ত রাস্তা স্থাপন করা যাতে পারে। জয়দেবপুর-মহাখালী-বংশাল (৪৩.৬ কি.মি), বিশ্বরোড-বাসাবো-সায়েদাবাদ (২০.৩ কি.মি) কালশি-মিরপুর ১২-খামারবাড়ি-ফার্মগেট-শাহবাগ (১২.৮ কি.মি), আসাদগেট-মোহাম্মাদপুর-জিগাতলা-সায়েন্সল্যাব- মতিঝিল -যাত্রাবাড়ি-শনিরআখড়া (২১.১ কি.মি), শিশুমেলা-আগারগাও-মাহাখালি-বাড্ডা লিংক রোড (১০.৬), কাকলি-গুলশান ২-গুলশান ১ (৪ কি.মি), মিরপুর ১১-রাইনখোলা-মিরপুর ১-টেকনিক্যাল (৮ কি.মি), মিরপুর ১৪-মিরপুর ১-মাজাররোড-গাবতলী (৮.২ কি.মি), পান্থপথ-এফডিসি মোড় (২.৫ কি.মি), শ্যামলি-শিয়া মসজিদ-রেসিডেন্সিয়াল-গণভবন-তেজগাঁ (৯ কি.মি), আসাদগেট-ফার্মগেট-হলিক্রস-সাতরাস্তা(৮কি.মি), ফার্মগেইট-ল্যাবএইড (৪কি.মি), চন্দ্রা-আজিমপুর (৩০.৪ কি.মি), মিরপুর ২ (৭০ ফুট রাস্তা) ইত্যাদি। ছোটবড় বিভিন্ন দৈর্ঘের আনুমানিক ৪০০ কিমি চলন্ত রাস্তা তৈরি করলেই ঢাকা শহরের ভেতর সকল স্থানেই যোগাযোগ করা সম্ভব। সমস্যাসঙ্কুল পরিবহন পদ্ধতির বাইরে এসে চলন্ত রাস্তা ধারণায় নতুন এক পরিবহন জগৎ তৈরী করা হয়েছে। এই জগৎ একজিস্টিং পরিবহন ব্যবস্থায় নাক গলাবে না। ব্যস্ত থাকবে নিজের জগতকে নিয়েই। যাত্রীকে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয়াই হবে তার পাঁচ ব্রতের এক ব্রত। তবে চলন্ত রাস্তা ধারণা একজিস্টিং পরিবহন ব্যবস্থায় নাক না গলালেও এর অনিবার্য প্রভাব পড়বে একজিস্টিং পরিবহন ব্যবস্থায়। চলন্ত রাস্তা ধারণাটি পুর্নাংগভাবে বাস্তবায়িত হলে একজিস্টিং রাস্তায় চলাচলরত সকল গণপরিবহনের যাত্রী চলন্ত রাস্তায় চলে আসবে। সাথে এমন অনেক যাত্রী চলন্ত রাস্তায় চলে আসবে, যারা অনেকটা বাধ্য হয়েই ব্যক্তিগত গাড়ীতে অথবা ক্যাব বা অটোতে চলাফেরা করেন। তাই একজিস্টিং রাস্তার উপরে পরিবহনের চাপ কমে যাবে এবং মুক্ত থাকবে যানজট থেকে। অনেক শহরে যেমন ফ্লাইওভার এবং এলিভেটেড একপ্রেসওয়ে নির্মাণে অবকাঠামোগত সুবিধা নেই, ততদ্রুপ মেট্রো রেলও সম্ভব নয় বিস্তির্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু চলন্ত রাস্তা প্রশস্ত এবং অপ্রস্থ রাস্তায় নির্মাণ করা সম্ভব। ৩০ ফুট প্রস্থের একটি রাস্তার উপরেই চলন্ত রাস্তা নির্মাণ করা সম্ভব। চলন্ত রাস্তার নির্মাণ প্রক্রিয়াও যেমন জটিল নয়, তেমনি সার্বিক বিবেচনায় নির্মাণ ব্যয়ও এলিভেটেড একপ্রেসওয়ে এবং মেট্রোরেলের চাইতে অনেক কম। পাঁচটি বিষয়কে মাথায় রেখে চলন্ত রাস্তার ধারণাটি উপস্থাপন করা হয়েছে। চলন্ত রাস্তা স্থাপনের মধ্য দিয়ে আমরা যে পাঁচটি বিষয়ে উপকৃত হবো তা হল-

১। শহর ট্র্যাফিকজ্যাম মুক্ত হবে।

২। এই পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব।

৩। বিদ্যুৎ তথাজ্বালানী খরচ কমবে।

৪। পরিবহণ খাতের বার্ষিক সার্বিক ব্যয় কমে আসবে।

৫। বাস্তবায়ন খরচ কম এবং সাধারণ কারিগরি দক্ষতায় বাস্তবায়ন সম্ভব।

অন্যান্য সুবিধাঃ

চলন্ত রাস্তা ধারণা আরও বেশকিছু সুবিধা পাওয়া সম্ভব। চলন্ত রাস্তার প্লাটফর্ম বরাবর বাইসাইকেল লেইন এবং মানুষের চলার জন্য হাঁটার লেইনের ব্যবস্থা রাখা। এলিভেটেড কোন ওয়াকওয়ে বা সাইকেল লেইন স্বাস্থ্য বিবেচনায় মানুষকে অধিক নিরাপদ রাখবে। কারন ব্যবহারকারীরা উঁচুতে থাকবে যার ফলে তারা মটর গাড়ীর ধুয়া এবং ধুলা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে।

চলন্ত রস্তার প্লাটফর্মের নিচ দিয়ে ইলেক্টিক, টেলিফোন এবং বিভিন্ন তার বিররণের জন্য চেম্বার নির্মাণ করা সম্ভব।

চলন্ত রাস্তা নির্মাণ ব্যয় এবং তুলনামূলকচিত্রঃ

ফ্লাইওভার, উড়ন্ত রাস্তা বা মেট্রো রেলের ব্যয়ের সাথে তুলনামূলক বিবেচনায় আনলে দেখা যাবে যে চলন্ত রাস্তার স্থাপনা খরচ অনেক কম। এর প্রধান কারণ চলন্ত রাস্তার কারিগরি পদ্ধতির কারণে এর ওজন কম। একটি ফ্লাইওভার বা উড়ন্ত সড়কের উচ্চতা এবং এর উপর দিয়ে অনেক ভারি যান চলাচলের কারণে যে শক্তিশালী ভিতের উপর দাঁড় করাতে হয় তার চেয়ে কম বেশ কম শক্তিশালী ভিতের উপর চলন্ত রাস্তা স্থাপন করা সম্ভব। কারিগরি কারণে চলন্ত রাস্তার কম্পনও কম। সব মিলিয়ে উড়ন্ত সেতু বা রাস্তার মত ভারী নির্মাণে যাবার কোন কারণ নেই।

মেয়র হানিফ, মগবাজার মৌচাক, মহাখালী, খিলগাঁও, মিরপুর এ্যারপোর্ট রোড এবং কুড়িল ফ্লাইওভার নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৪ শত বিশ কোটি টাকা। এই ৬টি ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য ২৩.৫৫ কিলোমিটার। ঢাকা এলিভেটর এক্সপ্রেস, ঢাকা আশুলিয়া, যাত্রাবাড়ি-কাঁচপুর, আজিম্পুর-গাবতলি ৪টি এলিভেটর এক্সপ্রেসের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ১২ কোটি যার দৈর্ঘ ৯১.৫ কিলোমিটার। ওভারব্রিজ বা এলিভেটর এক্সপ্রেস চলাচলের জন্য একটি কাঠামো। এর উপর দিয়ে চলাচলের জন্য প্রয়োজন হাজার হাজার গাড়ী আর যার মূল্য লক্ষ কোটি টাকা। আর উত্তরা থেকে মিরপুর হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের খরচ ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার নব্বই কোটি টাকা। এর সাথে যুক্ত হবে হাজার হাজার কোটি টাকার যানবাহন। চলন্ত রাস্তা একাধারে রাস্তা ও বাহন। উত্তরা থেকে মতিঝিল ২০.১০ কিলোমিটার মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর দশ ভাগের এক ভাগ খরচে চলন্ত রাস্তা নির্মাণ করা সম্ভব।

বিদ্যুৎ বা জ্বালানি খরচ এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ

একটি যান্ত্রিক যানে বিদ্যুৎ বা জ্বালানী খরচ নির্ভর করে ধারণ ক্ষমতা বা ওজন, গতি এবং বিভিন্ন কারিগরি সুযোগসুবিধার উপর। বিভিন্ন মোটরযানে ভারী কাঠামো চলমান রাখতে অনেক শক্তি ক্ষয় হয়। একটি বাসের গড় ওজন ৭০০০ কেজি, ৪০ জন যাত্রী অর্থাৎ ২৬০০ কেজি বহন করে। চলন্ত রাস্তায় ছাদ ও মূল কাঠামো স্থির থাকবে এবং শুধুমাত্র নিচের পাটাতন, কিছু যন্ত্রাংশ, গ্রিল ও প্লাস্টিকের দেয়াল ও চেয়ার চলন্ত থাকবে, যার ওজন একই আয়তনের যান্ত্রিক যানের চাইতে অনেক কম হওয়ার কারণে চলন্ত রাস্তা পরিচালনায় জ্বালানী বা বিদ্যুৎ খরচ অনেকটা কম হবে। এ ছাড়া আমরা জানি একই ওজনের একটি যান পিচের রাস্তার উপর দিয়ে চলাচল করতে যে শক্তি ক্ষয় হয়, মসৃণতার কারণে তার চাইতে কম শক্তি খরচ হয় রেল লাইনের উপর দিয়ে চলাচল করতে। চলন্ত রাস্তা লোহার লাইনের উপর দিয়ে চলাচল এবং এর চাকা লোহার হবার কারণে এতে জ্বালানী বা বিদ্যুৎ খরচ কম হবে। বর্তমান মোটরযানে বিবিধ স্বয়ংক্রিয় সুবিধা প্রদানের কারণে তা পরিচালনায় জ্বালানী খরচ হয়ে থাকে। চলন্ত রাস্তা প্রকল্পটি যেহেতু বিদ্যুৎ চালিত হবে তাই এই প্রকল্পে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যহত রাখতে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে আলাদা একটি বিদ্যুৎ ষ্টেশন স্থাপন করা যেতে পারে। চলন্ত রাস্তার ছাদ স্থির, তাই সহজেই সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করে অনেকটা বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো যেতে পারে।

চলন্ত রাস্তার কারিগরি জটিলতা কম হবার কারণে এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ অনেক কম হবে। যন্ত্রাংশ বলতে ইলেকট্রিক মোটর, ভেরিয়েবল স্পীড ড্রাইভার, কিছু ম্যাগনেটিক সিস্টেম, বেল্ট, পুলি, পিনিয়াম, ব্রেক প্যাড ইতাদি ছাড়া তেমন কিছুই নয়। যে কোন যান্ত্রিক ত্রুটি মোকাবেলায় ১টি সিরিজ সব সময়ের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। কোন একটি সিরিজের কোন একটি ক্ষুদ্র অংশেও যদি যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয় তাহলে ঐ সিরিজ বন্ধ রেখে সংরক্ষিত সিরিজ চালু করা হবে। পাটাতন, চাকা বা অন্যকোন যন্ত্রাংশ জনিত ত্রুটি দ্রুত সমাধানের জন্য প্লাটফর্মে সর্বাধিক ১ কিমি দূরত্বের মধ্যে পাটাতন, চাকা এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশ সংরক্ষণ করা হবে। যা জরুরি প্রয়োজন মেটাবে।

আবু সাইয়ীদ: চলচ্চিত্রনির্মাতা

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :