মানব সভ্যতার এক কলঙ্কিত অধ্যায় জেলহত্যা

শফী আহমেদ
 | প্রকাশিত : ০২ নভেম্বর ২০১৮, ১৯:৫৩
কারাগারে নিহত জাতীয় চার নেতা

৩ নভেম্বর। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কতম অধ্যায়ের এক বেদনাবিধূর দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পরিবারবর্গকে। ঠিক একই বছরের ৩ নভেম্বর গভীর রাতে কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ এক নিষ্ঠুর বর্বরতম অধ্যায়।

কিন্তু প্রশ্ন আসে কেন এই নির্মমতম জঘন্য জিঘাংসার পথ বেছে নিল খুনিরা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে আমাদের বিগত চল্লিশ বছরের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গ নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন, যে লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল সেই লক্ষ্য থেকে পুরোপুরি উল্টো দিকে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ঠিক একই কারণেই বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত চার সহকর্মী, জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে অভ্যন্তরে হত্যা করা হয়। হত্যাকারীরা প্রথমে গুলি চালিয়ে নেতাদের হত্যা করে এবং পরে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।

জাতি ৩ নভেম্বর বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে আমাদের চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শহীদ এই চার জাতীয় নেতা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অত্যন্ত জটিল ও সংঘাতপূর্ণ ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে যে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার গঠন করা হয় সেই সরকারই মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তি ঘটায়। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি।

কিন্তু এই নয় মাসের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যাবে পরতে পরতে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের নানা উদাহরণ। কিন্তু সব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত অত্যন্ত দূরদর্শীভাবে মোকাবেলা করে প্রতিবেশী ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একাত্ম রেখে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথ প্রশস্ত করেছিলেন শহীদ এই জাতীয় চার নেতা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, খুনি মোশতাক মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার জন্য বিভিন্ন সময় উদ্যোগ গ্রহণ করে। খুনি মোশতাক কখনোই বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে আদর্শিকভাবে ও নেতৃত্বের আসনে মেনে নিতে পারেনি।

কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন বীরের বেশে নিজ দেশের মাটিতে পদার্পণ করলেন নিজেও কাঁদলেন, জাতিকেও কাঁদালেন সেই সময় থেকেই খুনি মোশতাক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিশে যায়। খুনি মোশতাক এতই ধূর্ত এবং প্রবঞ্চক ছিল যে, ১৪ আগস্ট রাতেও সে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে তোষামোদ করার চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে অন্তরীণ করা হয়। সেই সঙ্গে অন্তরীণ করা হয় হাজার হাজার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে। খুনি মোশতাকের নেতৃত্বে গঠিত হয় এক পুতুল সরকার। কিন্তু ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের প্রথম দিন থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত কার্যত বাংলাদেশে কোনো সরকার ছিল না। মোশতাকের পেছনে ছিল মূল চক্রান্তকারী জিয়া। নিজেকে সম্পূর্ণ আড়াল রেখে এ সব ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করেছেন পর্দার অন্তরালে ক্ষমতালিপ্সু খুনি জিয়া।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৪ বছরের অধিকাংশ সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন কারাগারে। আমরা যে তৃণমূলের কথা বলি সেই তৃণমূল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর এই বিশ্বস্ত চার সহকর্মীসহ অন্য নেতারা। আওয়ামী লীগ ঘোষিত মুক্তির সনদ ছয় দফা যা পরবর্তী সময় এক দফায় রূপলাভ করে। সেই আন্দোলনকে বেগবান করেছে এবং বিজয়ী করেছে এই জাতীয় নেতারা এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ।

মূলত খুনি মোশতাকের চক্রান্তেই বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে এক পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদকে পদত্যাগ করতে হয়। খুনি মোশতাক এবং পরবর্তী সময় তার সহযোগীরা ক্রান্তিকালে যারা বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং বিশ্বাসকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন এবং আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথ প্রশস্ত করেছেন তাদের অধিকাংশকে বঙ্গবন্ধুর থেকে দূরে চলে যেতে বাধ্য করা হয়।

আজ প্রশ্ন জাগে, জাতীয় চার নেতাকে অন্তরীণ করা হলেও যারা খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় শপথ নিয়েছিলেন তারা কি শুধু প্রাণের ভয়েই শপথ নিয়েছিলেন? বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার আগে ১৯৭৪ সালে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করা হয়েছিল। এই কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করে মূলত পাক-মার্কিন গোষ্ঠী এবং এ দেশে তাদের ক্রীড়নকরা। বঙ্গবন্ধু যখন দেশকে রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন তখন ওই ক্রীড়নকরা কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করে এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পথ প্রশস্ত করে। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। জাতীয় চার নেতাকে অন্তরীণ করা হলো। কিন্তু ওই ক্রীড়নকরা কেউ অন্তরীণ হননি। এই অন্তরীণ না হওয়ার মধ্যেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে।

আজ বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে নিজের নেতৃত্বকে নিরঙ্কুশ করতে দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। যারা সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেই চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে তারা অবগত আছেন।

আজ সারা বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসোপানে পা দিয়েছে। আমরা পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতাকে। যারা নিজেদের জীবন দিয়ে তাদের বিশ্বস্ততা রক্ষা করেছেন। শত্রুর সঙ্গে আপস করেননি এবং আমাদের এগিয়ে চলার পথে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। ইতিহাসে তারা কালজয়ী। মৃত্যু তাদের লোকান্তরিত করেছে বটে কিন্তু ইতিহাসে তারা রয়ে গেছেন একেকজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে। যারা রাজনীতির ছাত্র আনন্দে আত্মহারা না হয়ে, শোকে ও শ্রদ্ধায় মুহ্যমান না হয়ে চলমান বাস্তবতাকে বাস্তবতার নিরিখে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।

লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা, নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :