এর চেয়ে বেশি আর কী করতে পারি?

প্রকাশ | ০৪ নভেম্বর ২০১৮, ১১:২১

প্রভাষ আমিন

তুষার ইমরানের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। মানে আমি তাকে চিনি, কিন্তু তিনি আমাকে চেনেন না। তুষার ইমরানকে আমি কখনো দেখিনি, এমনকি তার খেলার কথাও মনে নেই। লোকাল ক্রিকেট দেখা হয় না বহুদিন। আর তুষার ইমরান সর্বশেষ জাতীয় দলে খেলেছেন ২০০৭ সালে। মনে রাখার মতো তেমন কিছু করতে পারেননি। তাই মনেও নেই। কেমন ব্যাটিং করেন, ব্যাটিং স্টাইল কী, ফিল্ডিং কেমন করেন; কিছুই আসলে মনে নেই। তাই তুষার ইমরান আমার কাছে অচেনা এক ক্রিকেটার।

লোকাল ক্রিকেট না দেখলেও পত্রিকার সূত্রে খোঁজখবর রাখি। সেই সূত্রেই দেখছি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মনে রাখার মতো কিছু করতে না পারলেও লোকাল ক্রিকেটে বছরের পর বছর মেশিনের মতো শত শত নয়, হাজার হাজার রান করে যাচ্ছেন। এই ৩৪ বছর বয়সে এসে তুষার ইমরান যেন ফর্মের চ‚ড়ায় উঠে আছেন। সত্যি সত্যি চ‚ড়ায় উঠে বসে আছেন তুষার ইমরান। বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১১ হাজার রান করেছেন, সেঞ্চুরি করেছেন ৩১টি, হাফ সেঞ্চুরি ৫৭টি। আর কিছু না জানলেও, শুধু এই পরিসংখ্যান দেখেই আফসোস হয়, মন খারাপ হয়; এমন একজন ব্যাটসম্যানের সার্ভিস জাতীয় দল পেল না কেন?

তুষার ইমরান যখন ১১ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন, তখন আমি ফেসবুকে লিখেছিলাম, ‘আমি বাংলাদেশ ক্রিকেটের একজন নিয়মিত দর্শক, নিজেকে দাবি করি সাপোর্টার নাম্বার ওয়ান বলে। কিন্তু ক্রিকেট অত ভালো বুঝি না, ক্রিকেট প্রশাসন বা রাজনীতিটা বুঝি না বললেই চলে। একজন ব্যাটসম্যানের জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার ক্রাইটেরিয়াও ঠিক জানি না। সহজ-সরল একটা ব্যাপার বুঝি লোকাল ক্রিকেটে রান করলে জাতীয় দলে সুযোগ পাবে, এটাই বেসিক ক্রাইটেরিয়া হওয়ার কথা। কিন্তু এইখানেই খটকা লাগে। তুষার ইমরান নামে একজন ব্যাটসম্যান আছেন বাংলাদেশে। তাকে আমি কখনো দেখিনি। খেলা দেখেছি বলেও মনে পড়ে না।

কিন্তু গত কয়েক বছরে পত্রিকার পাতায় তার নাম পড়তে পড়তে আমি ক্লান্ত, বিরক্ত। কিসের আশায় তুষার সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করে যাচ্ছেন। তুষার ইমরান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১১ হাজার রানের মাইলফলক পেরিয়েছেন। আর কী করলে তিনি জাতীয় দলে ডাক পাবেন? রান করা ছাড়া কী-ই বা করতে পারেন তিনি? শুনেছি বয়স নাকি তার বড় বাধা। বয়স যদি সমস্যা হয়; তাহলে সাকিব, তামিম, মুশফিক, রিয়াদ, মাশরাফিকে বাদ দিয়ে দিন। সুযোগ পেয়েও প্রমাণ করতে পারেননি, এ যুক্তি মানলে কিন্তু আমরা তামিমকেও পেতাম না। অবশ্যই আপনি তরুণদের পেছনে বিনিয়োগ করবেন। কিন্তু বুড়ো হওয়ার অপরাধে তুষার ইমরানকে ডাকবেনই না; এ অন্যায়, ভারি, অন্যায়।’

এই স্ট্যাটাসের মন্তব্য এবং সংশ্লিষ্ট অনেকের ফোনে তুষার সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য পাই। জানতে পারি তার সম্পর্কে অনেক অভিযোগও। তুষার নাকি পুরোপুরি ফিট নন। ফিল্ডিংয়ে একদম আলসে। লোকাল ক্রিকেটে হাজার হাজার রান করা আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রান করায় আকাশ-পাতাল ফারাক। মানলাম তিনি পুরোপুরি ফিট নন। আনফিট ব্যাটসম্যানই যদি সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করতে পারে, তাহলে পুরো ফিট হলে কী করবেন? কিন্তু তুষারকে ফিট রাখা কি বিসিবির দায়িত্ব নয়? আর একটা দলের ১১ জন একই মানের ফিল্ডার নন। জন্টি রোডস একজনই হয়। তবে একটা ন্যূনতম মানের ফিল্ডিং দক্ষতা থাকতে হবে। আর ফিল্ডিং দক্ষতা বাড়ানোর একটাই উপায়, টানা এবং কঠোর অনুশীলন। সেটা যদি কেউ করতে না চায়, বোর্ড তাকে বাধ্য করবে। বোর্ডের দায়িত্ব কি শুধু জাতীয় দলে থাকা বা চুক্তিতে থাকা ক্রিকেটারদেরই আগলে রাখা? পাইপলাইনে থাকা খেলোয়াড়রা তাহলে গড়ে উঠবে কীভাবে?

মাশরাফি বা মোস্তাফিজ তো আল্লাহর দান। বাকি খেলোয়াড়দের তো বোর্ড ঘসে-মেজে তৈরি করার কথা। সেটা কি তারা ঠিকমতো করছে। একটা ছেলে যখন বছরের পর বছর সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করে যাবে, তখন অবশ্যই বোর্ডের উচিত তার ব্যাপারে স্পেশাল কেয়ার নেয়া। সেটা তো করেইনি, বরং তাদের আচরণে মনে হয়, তাদের কাজই হলো তুষার ইমরানকে ভুলে যাওয়া। কেউ যখন লোকাল ক্রিকেটকে খাটো করেন, পিচ নিয়ে বাজে কথা বলেন, প্রতিপক্ষের বোলারদের খাটো করেন; তখন আমার খুব রাগ লাগে। অভিযোগ না করে ভালো পিচ বানান, ভালো বোলার তৈরি করুন। এসব অভিযোগ করে আসলে তুষারের অর্জনকে খাটো করা হয়। আর লোকাল ক্রিকেটকে শক্তিশালী ও প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ করার দায়িত্ব তো তুষার ইমরানের নয়।

এখন যারা বাংলাদেশের তারকা, তারা নিশ্চয়ই জন্মেই জাতীয় দলে খেলছেন না। তাদেরও তো লোকাল ক্রিকেটে নিজেদের প্রমাণ করেই জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন। লোকাল ক্রিকেটে ভালো করলে জাতীয় দলে ডাক পাবেনÑ এটাই তো স্বাভাবিক। জাতীয় দলে ডাক পেতে হলে তুষার ইমরানকে কোথায় সেঞ্চুরি করে দেখাতে হবে? প্র্যাকটিস ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছেন বলেই না সৌম্যকে খেলার মাঝখান থেকে ডেকে নিয়ে নামানো হয়েছে। আর নামানো হয়েছে বলেই না তিনি সেঞ্চুরি করতে পেরেছেন।

অনেকে বলছেন, তুষারকে সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটের সাফল্যকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে টেনে নিতে পারেননি। এ অভিযোগের সঙ্গে আমি আংশিকভাবে একমত। তুষার ৫টি টেস্ট আর ৪১টি ওয়ানডে খেলেছেন। তারপরও আমি মনে করি তাকে পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়া হয়নি। আমরা যারা আমজনতা, কেউ একটি সেঞ্চুরি করলেই আমরা তাকে মাথায় তুলে নাচি, ২ ম্যাচ রান না পেলেই; কে কার ভাতিজা, কে কার ভায়রা, কে কোন কোটায় চান্স পেয়েছে ইত্যাদি গবেষণায় মেতে উঠি। আমাদের কথায় কান দিলে বাংলাদেশ তামিমকে পেত না। এশিয়া কাপের ফাইনালে সেঞ্চুরিটা না পেলে লিটন দাসকেও হয়তো বিস্মৃতির অতল গহŸরে হারিয়ে যেতে হতো। আমরা না হয় বুঝি না। বোর্ড বা নির্বাচকরা তো জানেন কার মধ্যে সম্ভাবনা আছে, তার পেছনে একটু সময় তো আপনাদের দিতেই হবে।

তুষার ইমরানের সবচেয়ে বড় শত্রæ তার বয়স। ৩৪ হয়ে গেছে। চান্স পেলেও ১-২ বছরের বেশি সার্ভিস পাওয়া যাবে না। তাই যাদের কাছ থেকে লম্বা সার্ভিস পাওয়া যাবে; তাদের পেছনে বোর্ড বিনিয়াগ করবে, সুযোগ দেবে। নির্বাচকরাও বারবার তাকে না ডাকার পেছনে এই বুড়িয়ে যাওয়াকে ঢাল হিসেবে অপব্যবহার করেছেন। কিন্তু তুষারের বয়স তো জন্মের পরই ৩৪ হয়ে যায়নি। তিনি তো সবার সামনেই ধীরে ধীরে বড় হয়েছেনÑ বয়সে ও পারফরম্যান্স। তুষার সর্বশেষ টেস্ট ও ওয়ানডে খেলেছেন ২০০৭ সালে, মানে ১১ বছর আগে। আর এই ১১ বছর ধরে তুষার দৈত্যের মতো রান করে যাচ্ছেন। কই ৫ বছর আগে তো তাকে ডাকেননি, ১০ বছর আগে তো ডাকেননি। যথেষ্ট বুড়ো বানিয়ে তারপর বলবেন, যতই রান আর সেঞ্চুরি করুন, চান্স পাবেন না। সেটা অন্যায়, ভীষণ অন্যয়। আর ক্রিকেটে কখনো কখনো বয়স একটু সংখ্যা মাত্র।

অস্ট্রেলিয়ায় অনেকের অভিষেক হয় ৩০-এর পর। পাকিস্তানের মিসবাউল হক বুড়ো বয়সে ফিরে এসে যা করেছেন; তা যুগ যুগ মানুষ মনে রাখবে। আজ যিনি প্রধান নির্বাচক, সেই নান্নু তার সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হয়েও টেস্ট খেলার সুযোগ পাননি, বুড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগে। তখন নিশ্চয়ই বোর্ড আর নির্বাচকদের ওপর ক্ষেপেছিলেন নান্নু। আজ সেই নান্নু প্রধান নির্বাচক। সেই বুড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগে ডাকা হচ্ছে না দেশের সেরা পারফরমারকে। তুষারের বেদনাটা সবচেয়ে বেশি বুঝবেন নান্নুই।

তুষারের ১১ হাজার রানের রেকর্ডের পর অনেকে বলছিলেন, এবার ওয়ানডে না হলেও টেস্টে ডাক পাবেনই তুষার। কিন্তু পাননি। রেকর্ডের পর রেকর্ড, সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করেও নির্বাচকদের দিল নরম করতে পারলেন না। এখন তিনি খেলা ছেড়ে গান ধরতে পারেন, ‘এর চেয়ে বেশি আর আমি কী করতে পারি?’

তবে আমি নিশ্চিত তুষার খেলা ছাড়বেন না। রানের পর রান করেই যাবেন। এই একটি কারণেই আমি তার ভক্ত। বারবার উপেক্ষিত থেকেও বছরের পর বছর রান করে যাওয়ার অনুপ্রেরণা তিনি কোত্থেকে পান, কে জানে। এই দৃঢ় মনোবলটাই নতুনদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার দরকার। তুষার নতুন ক্রিকেটারদের জন্য আইডল হতে পারেন। শুধু ক্রিকেটার কেন; সব মানুষই ধৈর্য ধরে লেগে থাকার শিক্ষাটা পেতে পারেন তুষারের কাছ থেকে।

তুষারকে না চিনে, তার খেলা না দেখেও আমি তার পক্ষে দাঁড়াচ্ছি; কারণ আমার মনে হয়েছে বছরের পর বছর তার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেই এ লেখা। দেশের সেরা ১১ জন পারফরমার জাতীয় দলে খেলবে; আমি এটুকুই বুঝি।

তুষারের প্লে লিস্টে আরেকটা গান তুলে দিয়ে শেষ করি লেখাটা, ‘হয়তো কিছুই নাহি পাবো, তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভালোবেসে যাবো...। ক্রিকেট বোর্ড আর নির্বাচকদের দেখলেই এ দুটি গান গাইতে পারেন তিনি।

প্রভাষ আমিন: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ