গল্প

ক্যালেন্ডার

মনদীপ ঘরাই
 | প্রকাশিত : ০৪ নভেম্বর ২০১৮, ১৩:৩২

দিন পনেরো বাকি বিয়ের। মেঘলার মনে অনেক অনেক মেঘ। ছোট থেকে বড় হওয়া এই বাসা ছেড়ে যেতে হবে।অচেনা কোনো ঘরে। মন মানছে না।

দিন পনেরো বাকি অবসরের। মেঘলার বাবা গফুর সাহেব একই দিনে চাকরি আর মেয়ে এই দুই কেই বিদায় বলবেন। কষ্টটা বোঝানো যাচ্ছে না কাউকে। তাই সবার সাথে রাগারাগি করছেন।

দিন পনেরো বাকি পরীক্ষার। সোহান ভাবে, আপুর বিয়ে, বাবার অবসর আর পরীক্ষা! এই তিনখানা পাহাড়ের মতো বিপদ একসাথে সইবে কিভাবে?বাবার অবসরের পর তাকেই তো পরিবারের হাল ধরতে হবে।

দিন পনেরো বাকি রান্নার গ্যাস শেষ হতে। হাতে টাকা খুব কম আছে। সুফিয়া কিভাবে সামাল দেবে এত্তসব? মেয়েটাকে পরের বাড়ি পাঠানো, স্বামীর অবসর, ছেলের পরীক্ষা আর গ্যাস! এমনিতেই মেয়ের বিয়েতে যা খরচ হচ্ছে! এবার মাস ফুরোলে না খেয়ে থাকতে হতে পারে।

ড্রইংরুমের দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের পাতায় দিন পনেরো আগে পরিবারের সবাই যার যার মতো নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টের কথা লিখে গেছে।লালকালির গোল দাগ দিয়ে মেঘলা লিখেছে, "ঘর বদল"।গফুর সাহেব লিখেছেন, "অফিস শেষ "।সোহান হলদে মার্কার দিয়ে দাগিয়ে লিখেছে, "পরীক্ষা শুরু" আর সুফিয়া লিখেছেন, "গ্যাস"

২রা নভেম্বর। সেই "দিন পনেরো" পরের দিনটা আজকেই।সকালের সূর্যটাও কি গফুর সাহেবের পরিবারের ক্যালেন্ডারটায় কিছু লিখে গিয়েছিল? বড্ড অচেনা লাগছে আজকের সূর্যটাকে। তেজের কমতি নেই, কিন্তু মন খারাপ করা গুমোট ভাব।

সকালে সবাই আজ সব ভিন্ন ভিন্ন মনের অবস্থা নিয়ে ঘুম থেকে উঠলো। নাহ্। ঘুম থেকে উঠলো না বলে

বিছানা ছাড়লো বললে ভালো হয়।

মেঘলা কাল সারারাত কেঁদেছে। সুমন বেকার। সুমনের বয়স হয় নি।সবই সত্যি।সেই সাথে এটাও সত্যি যে, ভালোবাসার কোন কমতি তো ছিল না! এই জগতে অযোগ্যরাই বেশি ভালোবাসতে পারে বোধ হয়। যখন সুমন চাকরি পাবে,সফল হবে, তখন কি এই দিন থাকবে? চিৎকার করে কাঁদলেও কি মেঘলাকে পাবে?

এই জগতটা একটা বড় বধ্যভূমি। এখানে প্রতিদিন মাটিচাপা পড়ছে সুমন আর মেঘলার মতো মানুষের চাপা কান্না আর ভারী শ্বাস। সবাই তারপরেও বেঁচে আছে। ভাগ্যিস কষ্টগুলোর শরীর নেই। তা না হলে কত লক্ষ লক্ষ লাশ যে চোখের সামনে দেখতে হতো!

বাবাকে কষ্ট না দিতে বিয়েতে রাজি হয়েছে মেঘলা। কিন্তু এ জগত তো তাকেই দোষ দেবে সুমনের একাকীত্বের জন্য। সে দোষও নেবে, নিজের কষ্টটাও সাথে নেবে। এরপর যাবে সম্পূর্ণ অচেনা কোনো রান্নাঘরে।

সোহানও ঘুমায় নি সারারাত।পড়েছে ভাঁজ না খোলা নতুন এক বই। গল্পের না। রসায়ন বই। এই বইটা কঠিন। তাই পড়াও হয় নি। এখন নাক-চোখ-মুখ এক করে বুঝে না বুঝে চলছে সাজেশনের প্রশ্নগুলো মুখস্ত করা। পাশের ঘরে আপুর কান্না সে ও টের পেয়েছে। কিছু বলে নি। সুমন ভাইটা কতো ভালো ছিল। আর এখনকার হবু দুলাভাইটাকে দুচোখে দেখতে পারে না সে। গম্ভীর, কালো, মোটা কিন্তু বড় চাকরি করে...

থেকে থেকে সারারাত বুকটা ব্যথা করেছে গফুর সাহেবের। কালকের পর আর অফিস নেই! কি করবে সে পরশু থেকে? একদম বেকার। বেকার শব্দটা মাথায় আসতেই মন থেকেই একটু বিব্রত হলেন গফুর সাহেব। বেকার! মেঘলার পছন্দের ছেলেটাও তো বেকার বলেই... পরশু থেকে ওই ছেলেটা আর সে তো সমানই! শুধু সময়ের পার্থক্য।

সকাল সকাল বিছানা ছেড়ে অফিসের পথে গফুর সাহেব। বিয়েটা ঘরোয়ােভাবে হচ্ছে। কাউকেই তেমন বলা হয় নি। তাই প্রস্তুতির তেমন কিছু নেই। চেয়েছিলেন অন্তত আজকের দিনটা বাদ দিয়ে বিয়েটা হোক। ছেলেপক্ষ মানে নি। তাই বাধ্য হয়েই....

অফিসে সাদামাটা একটা বিদায় অনুষ্ঠান। সবসময়ে সবার বিদায়ে বলা একই কথা আর ছোট্ট একটা প্যাকেট। ওই প্যাকেটে একটা কলম আর একটা টাই যে আছে তা র‍্যাপিং না খুলে গফুর সাহেব বলে দিতে পারেন। কারণ, এ প্রচলনটা অফিসে তিনিই করেছেন। অঝরে কাঁদলেন গফুর সাহেব। সাধারণত এমন করে কোনো কর্মচারিই কাঁদে নি। হয়তো মেঘলাকে অনেকটা জোর করে বিয়ে দেয়ার অপরাধবোধ থেকেই। বাসায় ফিরতেই সবার আচরণকে অবহেলা মনে হতে লাগলো...

সুফিয়া। বাসার হালটা ধরে আছে এই মহিলাই।জীবনে চাওয়া পাওয়া বলতে সন্তান দুটো।আজ বড় কষ্ট হচ্ছে। আজ তার মেয়েটার বিয়ে। বুকে পাথর নিয়ে বিদায় দেবেন মেঘলাকে। এমনি করে তিনিও এসেছিলেন একদিন। তারও তো কাউকে ছেড়ে আসার দুঃখ ছিল! একটা প্রাণীকেও বুঝতেও দেন নি তা।জীবনটা এমনই।ছেড়ে আসার খেলা।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ। পরিস্থিতি বিচারে আজই শ্বশুর বাড়ী যাচ্ছে মেঘলা। শেষবারের মতো নিজের ঘরটায় আসলো একবার। এই ঘরটা কাল থেকে আর তার না। সোহান দখল করবে। করুক। আমি সুমনকে ভুলে থাকবো কিভাবে? একটা চিঠি লিখলো তাড়াহুড়া করে: সুমন, আমি হেরে গেলাম। তোমার হতে পারলাম না। তুমি জানতেও পারলে না, আজ বিকেলেও সেজেছিলাম তোমারই জন্য। চললাম।

ইতি, মেঘ।

চিঠিটা কাউকে দিয়ে পৌঁছে দেয়া হলো না। স্থান পেলো মেঘলার ড্রেসিং টেবিলের মেকআপ বক্সে।

রাত নেমেছে আজ গফুর সাহেবের বাড়িতে। অচেনা রাত।

দখিনা বাতাসে থরো থরো কাঁপছে দেয়ালে টানানো ক্যালেন্ডারটা।

মেঘলার বদল, সোহানের শুরু, গফুরের শেষ নিয়েই জীবন চলে। আর সুফিয়ার ক্যালেন্ডারে লেখা গ্যাসের মতই বায়বীয় জীবনের সুখ-দুঃখ গুলো। আটকে রাখলে থাকে।ছেড়ে দিলে উড়ে যায়। আর একগাদা আগুন জ্বালায়।

ওই এক ক্যালেন্ডারেই লেখা থাকে মধ্যবিত্তের যাপিত জীবন, সবটুকু ইতিহাস। সুবিধা হলো, বছর শেষে বইয়ের মলাট, ঝালমুড়ির ঠোঙ্গা কিংবা ময়লার বালতিতে স্থান নেয় ক্যালেন্ডার। ধুয়ে মুছে সাথে নিয়ে যায় ওই বছরের সবটুকু গল্প।ঠিক এজন্যই: "মধ্যবিত্তের ঠাঁই নেই পৃথিবীর ইতিহাসে।

এরা হারায় ক্যালেন্ডার থেকে ক্যালেন্ডারে।"

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :