‘টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে খাম কিনতাম’

প্রকাশ | ০৬ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:৩৯ | আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৮, ২১:২১

অনলাইন ডেস্ক

সংবাদপত্রে লেখার মধ্য দিয়েই শুরু করেছিলেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। শুরুতে কবিতা লিখতেন। পরে বেছে নিয়েছিলেন গদ্যের পথ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বেশকিছু গল্প লিখেছিলেন। সেগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘উৎস থেকে নিরন্তর’। প্রথম বই। প্রথম গল্পের বই।

দৈনিক ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপে বলছিলেন ষাটের দশকে ছাত্রজীবনের কথা। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে খাম কিনতেন। কবিতা লিখতেন। বাবা-মাকে না জানিয়েই পাঠিয়ে দিতেন পত্রিকার পাতায়। তারপর একদিন যখন বেগম পত্রিকায় কবিতা বের হলো, মা জানতে পারলেন, মেয়ের কথা। দুই টাকা হাতে দিয়ে বললেন, ‘টিফিনের পয়সা বাঁচাতে হবে না। এই দিয়ে খাম কিনে রাখিস।’
আলাপে ছিলেন- হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

আপনার কথাসাহিত্যের প্রস্তুতিতে সংবাদপত্রের ভূমিকা কী ছিল?

কথাসাহিত্যের প্রস্তুতিতে সংবাদপত্র একটি বড় জায়গা ছিল। আব্বার চাকরির জন্য ১৯৫৮ সাল থেকে ৬৮ সাল পর্যন্ত আমাকে রাজশাহী থাকতে হয়েছে। লেখালেখির সূচনা হয়েছিল কবিতা দিয়ে। পরে অবশ্য কবিতায় থাকিনি। লিখে তখন ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতাম। ডাকে।

কোন কোন পত্রিকা ছিল তখন?  

‘দৈনিক পূর্বদেশে’ পাঠাতাম। সেখানে ছাপা হচ্ছিল। ‘পূবালী’ একটা সাহিত্য পত্রিকা ছিল। মো. মাহফুজুল্লাহ সম্পাদনা করতেন। ‘বেগম’ পত্রিকায় কবিতা ছাপা হয়েছিল। এটা ছিল বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সময়। আর ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায় স্বাধীনতার পরে ছাপা হয়েছিল। ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকাতেও।

ওগুলো কি কবিতা ছিল?

না, পরে আমি সিদ্ধান্ত নিই গদ্য লিখব। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে থাকতে, তখন আমি অনেকগুলো গল্প লিখেছি।
 
মাস্টার্স শেষ করলেন কবে?

১৯৬৮ সালে মাস্টার শেষ করলাম। আমার একজন শিক্ষক আমাকে বললেন, তুমি যে এসব গল্প লিখেছো, তুমি যদি একটা বই করো তাহলে চাকরি পেতে সুবিধা হবে। এটা তোমার জীবন-বৃত্তান্তের মান বাড়াবে। প্রকাশিত একটা বই থাকলে তুমি একজন লেখক হিসেবেও মূল্যায়ন পাবে।

আমি বললাম, আমার বই কে ছাপাবে? আমাকে তো কেউ চেনে না। স্যার বললেন, কোনো প্রকাশক অবশ্য ছাপাবে না। তুমি নিজেই বের কর। আমি বাবা-মাকে বললাম, দুজনেই বললেন, যদি বই ছাপানোর কারণে তোমার চাকরি হয়, তাহলে তুমি কর।

তারপর কি টাকা দিলেন তারা?

হ্যাঁ, বাবা-মা টাকা দিলেন। আমার প্রথম গল্পের বই- ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ ছাপা হলো। এইভাবে শুরু।

কোন সালের কথা এটা?

১৯৬৯ সাল। ওই বছরই আমার প্রথম গল্পের বই ছাপা হলো। ১৯৭০ সালে আমি বাংলা একাডেমিতে চাকরি পেলাম। ঢাকা তখন আমার জন্য অজানা অচেনা শহর। আমি তো কখনো ঢাকায় থাকিনি। পড়ালেখা করিনি। কাউকে চিনি না। আমার কোনো পরিচিত শিক্ষক ছিলেন না। কিন্তু আমার প্রতিটি চাকরি ইন্টারভিউ দিয়ে হয়ে গেল। বোধ হয় ওই বইটি ছিল বলে।

ইন্টারভিউ বোর্ডের কোনো অভিজ্ঞতা কি পাঠককে জানাতে চান?

আমি যখন পাবলিক সার্ভিস কমিশনে ইন্টারভিউ দিলাম, তখন শহীদ অধ্যাপক মুনির চৌধুরী বোর্ডে ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, তোমার একটা বই বেরিয়েছে। আমি আমার টেলিভিশন অনুষ্ঠানে এনিয়ে আলোচনা করেছি। স্যার তখন বিটিভিতে একটা অনুষ্ঠান করতেন। বিভিন্ন বইয়ের ওপর আলোচনা হতো।

তিনি আপনার বইটি কী করে পেয়েছিলেন?

আমার যে শিক্ষক আমাকে বই প্রকাশ করতে বলেছিলেন তিনিই মূলত বইটি তাকে দিয়েছিলেন। তারা দুজন বন্ধু ছিলেন। বলেছিলেন যে, মেয়েটা ভালোই লেখে। আপনি যদি তাকে একটু রিভিউ করে দিতে পারেন। তিনি সেই কথাটিই আমাকে বোর্ডে বলেছিলেন।

পাবলিক সার্ভিস কমিশনে কোন চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন?

ও আচ্ছা। বলা হয়নি। ১৯৭০ সালে আমি একসাথে দুটো চাকরির জন্য ইন্টাভিউয়ের চিঠি পাই। একটি বাংলা একাডেমিতে। অন্যটি পাবলিক সার্ভিস কমিশনে সরকারি কলেজের জন্য।

তাহলে শুরু করেছিলেন বাংলা একাডেমিতে?

হ্যাঁ, এখানকার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলি। বাংলা একাডেমিতে আমার ইন্টারভিউ। তখন বাংলা একাডেমির পরিচালক অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, আব্দুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন বোর্ডে ছিলেন। আমি তাদের নাম জানি। ভয়ে তটস্থ। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ইন্টারভিউ বোর্ডে গেলাম। ওই চাকরিটা আমার হলো।

এখানে কোন পদে যোগ দিলেন?

বাংলা একাডেমি বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, গবেষণা সহকারী ও পা-ুলিপি পাঠক পদে। আমি গবেষণা সহকারী হিসেবে আবেদন করেছিলাম।

আপনি যাদের নাম বললেন তারা বেশি প্রতিষ্ঠিত মানুষ। তারা বাংলা একাডেমির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।  

হ্যাঁ, বাংলা একাডেমিতে কিন্তু একটা সময় অনুবাদের একটা বড় জায়গা ছিল। আমি যখন ১৯৭০ সালে একাডেমিতে যোগ দিই, তখন দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্টে’র বাংলা অনুবাদ কিনেছিলাম। বইটা পড়ার পর আমার লেখার ধরণ অনেক বদলেছে। কীভাবে উপন্যাসের মধ্যে ঘটনার বর্ণনা করতে হয়। এখনো বইটা আমাকে উৎসাহিত করে। অনুবাদের সেই জায়গাটা এখন আর বাংলা একাডেমিতে নেই।

চাকরির জন্যই বই প্রকাশের সূচনা হয়েছিল আপনার...

হ্যাঁ, কিন্তু ১৯৬৪ সালে আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। তখন আমার একটি গল্প সাহিত্য প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল। ষাটের দশকে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের পড়ার সময় অনেক গল্প লিখেছি।

তখন পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন কীভাবে?

আমি টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে পত্রিকায় লেখা পাঠাতাম। বাবা-মাকে লুকিয়ে। একদিন বেগম পত্রিকায় আমার একটা কবিতা দেখে মা বললেন, এটা কি তোর লেখা নাকিরে? সেলিনা হোসেন আর কোনো লেখক আছে কিনা? আমি কবিতাটা দেখে বললাম, না, এটা আমার লেখা।

তারপর মা কী বললেন?

মা সেদিন এক টাকা নাকি দুই টাকা দিয়েছিলেন। তখন তো চার আনা করে খামের দাম ছিল। পয়ষট্টি-ছিষট্টি সালের কথা। বললেন, টিফিনের পয়সা বাঁচাতে হবে না। খাম কিনে রাখিস। যখন লেখাটা ঠিক মনে হবে, পাঠাস।

সংবাদপত্রে এখনকার সাপ্তাহিক সাহিত্য আয়োজন বা তরুণ লেখকদের বিষয়টি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

আমি কিন্তু একটা জিনিস দেখেছি, এখন অনেকেই তরুণরা সম্পাদককে দায়ী করে। হ্যাঁ, সম্পাদক আমার লেখাটা ছাপেনি। ওর লেখাÑ ওকে চেনে বেশি তাই ছাপে। এরকম অভিযোগ এনে কথা বলে। আমি কিন্তু সব সময় মনে করেছিÑ যখন পূর্বদেশ আমার লেখা ছেপেছেÑতখন মনে করেছি আমার এই লেখাটা বোধ হয় ভালো হয়েছে। আবার যেই লেখাটা অন্য কাগজে ছাপেনি, ধরে নিয়েছি ওই লেখাটা খারাপ লেখা। আমাকে আরও ভালো করে লিখে পাঠাতে হবে। কখনো কাউকে দায়ী করিনি। দায়টা নিজেই নিয়েছি যে, আমি ভালো লিখতে পারিনি, তাই ছাপা হয়নি।

সংবাদপত্র কথাসাহিত্য চর্চার একটা নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ছিল, তাই তো?

একদম। কারণ স্বাধীনতার পরে আমি সংবাদ পত্রিকায় অনেক বছর লিখেছি। একটা ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছি। বিভিন্ন লেখা লিখিছি। এটা একটা অনুপ্রেরণা জায়গা ছিল। তারপর ইত্তেফাকে লিখেছি। তখন তো এগুলোই ছিল। আমার তরুণ বয়সের কথা।

আপনাদের তরুণ সময়ে সংবাদপত্রের সাহিত্যপাতা কারা সম্পাদনা করতেন?

আহসান হাবীব ছিলেন দৈনিক বাংলায়। সংবাদ পত্রিকায় ছিলেন আবুল হাসনাত। যিনি এখন কালি ও কলম সম্পাদনা করেন। আমি যখন এসব করেছি। সত্তর দশকের দিকে। শামসুর রাহমান এলেন আহসান ভাইয়ের পরে দৈনিক বাংলাতে।

যারা সাহিত্য সাময়িকী বা পাতা সম্পাদনা করতেন তারা নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত ছিলেন...

আবুল হাসনাত ভাই অবশ্য আমাদের সমসাময়িক হবেন। তিনি খুব যতœ নিয়ে পাতাটি করতেন। বিষয় নির্বাচন করে, লেখা বাছাই করে, খুব ভালো হতো। ইত্তেফাকের পাতাটিও খুব ভালো হতো।

লেখালেখির জন্য প্রস্তুতিটা কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

বড়গল্প, উপন্যাস বা কবিতা যাই হোক, প্রস্তুতিটা একটা বড় জিনিস। কারণ নিজেকে তৈরি করতে হবে। কোথা থেকে গল্পটা এলো এটা বড় বিষয় নয়। এটা নিজের ভেতর থেকেও আসতে পারে। অভিজ্ঞতা থেকে আসতে পারে। কোনো কিছু দেখা থেকেও হতে পারে। কিন্তু লেখক যদি হুবহু সেটা লেখে তাহলে তা ফিচার হয়ে যাবে। লেখকের নিজস্ব কল্পনা বা কাহিনী যুক্ত হবে। তা না হলে সেটা সাহিত্যে শিল্প মূল্য পাবে না।

দৈনিক ঢাকা টাইমস পত্রিকার কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?

যেন শিল্প-সাহিত্যের জন্য একটা ভালো পাতা করা হয়। বিনোদনের চিত্রে ভালো চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতের খবর থাকে।