মাদ্রাসা নিয়ে শহুরে শিক্ষিতজনের এত ভয় কিসের?

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৭ নভেম্বর ২০১৮, ১৩:০০

মাদ্রাসার লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষককে কোনভাবেই সহ্য করতে পারছে না একশ্রেণির ‘শিক্ষিত’ মানুষ। সীমাহীন দারিদ্র আর কষ্টের মাঝে বসবাস করা মাদ্রাসার সদস্যদের একটু উপার্জনক্ষম করার কোনো চেষ্টাও আজ পর্যন্ত দেশের ‘উচ্চশিক্ষিত’ ও ‘আলোকিত’ সম্প্রদায় করেনি।

যখনই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ইতিহাসে প্রথমবারের মত কওমি মাদ্রাসা-পড়ুয়া মানুষগুলোকে মূলধারায় আনার প্রয়াস চালিয়েছেন, তখন এই স্বার্থপর শহুরে শিক্ষিত শ্রেণির গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। মনে প্রশ্ন জাগে, যে শিক্ষা ঘৃণা করতে শেখায়, সেটি কি প্রকৃত সুশিক্ষা?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যেদিন কওমি আলেম ও শিক্ষার্থীরা রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংবর্ধনা দিলেন সেদিন থেকে ফেসবুকে এক শ্রেণির মানুষকে হাসি-তামাশা করতে দেখা গেছে। হাসি-তামাশা করা মানুষগুলো কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ বা বড় সাংবাদিক। বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকগণও খুব গোস্বা করে আছেন কওমি আলেম ও শিক্ষার্থীদের উপর। আল্লামা শফি হুজুরের সঙ্গে শেখ হাসিনার ছবি নিয়ে ফেসবুকে ট্রল করার চেষ্টা করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মাদ্রাসার সরল শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে ইসলামবিরোধী বলে অপপ্রচার করা হয়েছে বছরের পর বছর। জামায়াত আর ইসলামকে আলাদা করে ভাবতে না পারা সাধারণ মুসলমানদের একটা বড় অংশ সে অপপ্রচার বিশ্বাস করে এসেছে। মূলত মুক্তিযুদ্ধ আর ইসলামকে দুই বিপরীত মেরুতে দাঁড় করানোর ভয়াবহ ষড়যন্ত্র হিসেবেই এই অপপ্রচার চালিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। দেশের সুশীল সমাজের একটি অংশ বুঝে হোক, না বুঝে হোক সে ষড়যন্ত্র সফলে ভূমিকা রেখেছে।

জেনে হোক, না জেনে হোক দেশের ‘বুদ্ধিজীবী’ সমাজের একটা অংশ আম আদমির মত জামায়াত আর কওমি মাদ্রাসার সদস্যদের আলাদা করে ভাবতে পারছে না। অথচ জামায়াতকে ইসলামের শত্রু বলে উপমহাদেশের কওমি আলেমরা অভিহিত করে বহু বিবৃতি দিয়েছেন। গত কয়েক দশকে মাদ্রাসা কমিউনিটিকে দূরে সরিয়ে রাখাতে তাদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পায় ছদ্মবেশী জামায়াত। দেখতে অনেকক্ষেত্রে একইরকম হলেও একজন জামায়াত নেতা আর কওমি আলেম এর মধ্যে চিন্তা-চেতনার বিস্তর তফাৎ রয়েছে। সেই ব্রিটিশ আমলে জামায়াতের জন্ম হয়েছিল হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দূরত্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে জন্ম হয়েছিল জামায়াতের। জন্মলগ্নেই উপমহাদেশের দেওবন্দি আলেমগণ জামায়াতকে ইসলামের বিকৃতি আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্ম দেয়া হয় হিন্দু মহাসভা নামের আরেক সাম্প্রদায়িক সংগঠনের। দুই দিকে দুই কট্টরপন্থী সংগঠনের নানা কর্মকাণ্ডে হিন্দু-মুসলমানদের দূরত্ব বাড়তে থাকে, দাঙ্গা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশরা উপমহাদেশকে ভাগ করে দিয়ে চলে যায়। ২০০ বছর লুটপাট করে এমনভাবে উপমহাদেশকে ভাগ করে দিয়ে যায় যে এখনো কাশ্মির নিয়ে যুদ্ধ চলছে। ব্রিটিশরা বাংলা, পাঞ্জাব সব ভাগ করে দিয়ে যায়।

ব্রিটিশদের কূটকৌশলের ঐতিহাসিক প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে হয়। আর ব্রিটিশদের এই কৌশলের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, জহরলাল নেহেরু আর মোহনচাঁদ করমচাঁদ গান্ধী। ১৯৪৭ সালেই বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারত। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের ৭৩ ও ৭৪ নং পৃষ্ঠায় ১৯৪৭ সালে বাঙালির বাংলাদেশ রাষ্ট্র কেন হল না সে বিষয়ে বিশদ বর্ণনা আছে। বলা বাহুল্য যে, জামায়াত সফলভাবে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার জীবাণু ইঞ্জেক্ট করতে পেরেছিল। অন্যদিকে হিন্দু মহাসভার মত কট্টরপন্থী সংগঠন হিন্দু সম্প্রদায়কে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলেছিল।

হিন্দুত্ববাদের অভিশাপে ভারতে সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য আজ বিলীন হওয়ার পথে। বাংলাদেশেও জঙ্গিবাদ আর সাম্প্রদায়িক অপশক্তির দুঃশাসন জাতি দেখেছে। ১৯৭১ সালে এই জামায়াতের লোকজন হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হয়ে কাজ করেছে। মেয়েদেরকে তুলে দিয়েছে পাক হায়েনাদের হাতে, জামায়াতের লোকজন নিজেরা ধর্ষণ করেছে, গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে, গণহত্যা চালিয়েছে।

অবশেষে ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ যখন টেকসই অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে জয়যাত্রা করেছে, তখন কওমি সনদের স্বীকৃতি প্রদান অত্যন্ত গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে। দেশের সবাই ভালো থাকবে, ভালো পড়বে, ভালো খাবে; কিন্তু মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীরা গরিব হয়ে থাকবে সেটি কোনোমতেই হতে পারে না। দুনিয়ার সব আনন্দ, সব আরাম, আয়েশ করার অধিকার এদের আছে। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে পৃথিবীর বুকে ভালো থাকার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা অর্জনের পরিবেশ পাওয়ার অধিকার হুজুরদের রয়েছে।

সমালোচকরা যদি সেদিন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটাও মন ও মগজ দিয়ে শুনতেন তাহলে হয়ত দেশের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কিছুটা জ্ঞান অর্জন করতে পারতেন। বাংলাদেশে এই মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেছিলেন কারা? কেন করেছিলেন? ব্রিটিশ আমলে শোষকদের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ করেছে আলেম-ওলামারা। ব্রিটিশ ও তাদের ঘনিষ্ঠ শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলমানদের পড়তে দেয়া হত না। অন্যদিকে ইংরেজদের প্রতি বিদ্রোহ মনোভাবসম্পন্ন আলেম-ওলামাগণ ইংরেজি শিক্ষার উপরও ক্ষুব্ধ ছিলেন। ফলে মুসলমানদের পড়ালেখার স্থান হিসেবে গড়ে উঠে মক্তব, মসজিদ, মাদ্রাসা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাবিহীন এসব প্রতিষ্ঠান সমাজের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দান-খয়রাতের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে।

পাড়ার একটি মক্তব, মাদ্রাসা কী হালতে চলে, মাদ্রাসার ছাত্ররা কী পরিমাণ দারিদ্রের ভেতর দিয়ে দিন পার করে সেটি নাক সিটকানো শহুরে বুদ্ধিজীবী সমাজের জানার কথা নয়। টুপি-দাঁড়িওয়ালা সবাইকে জঙ্গি মনে করে মুখে প্রগতি, অন্তরে ঘৃণা নিয়ে নিজেরা আরাম আয়েশে দিন পার করে দিলেও দেশের অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনে কী পদক্ষেপ নিয়েছে তথাকথিত সুশীল সমাজ? টুপি-দাঁড়ি দেখলেই জঙ্গিবাদের কলঙ্ক দেয়া চরম সাম্পদায়িকতা আর মানবাধিকার লঙ্ঘন।

বরং বাংলাদেশ দেখেছে, ইংরেজি জানা, হলিউডের স্টাইলে জীবন যাপন করা ছেলে-মেয়েরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে বেশি সংখ্যায়। এই শহুরে গোষ্ঠী ইংরেজি মিডিয়াম নিয়ে কিছু বলবে না, কিন্তু মাদ্রাসা হলেই নাক সিটকাবে! অথচ এটা প্রমাণিত যে, ইংরেজি মিডিয়াম এ পড়েও আইএস এর ভয়াবহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে অনেকে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম নির্দেশদাতা জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি বাতিল করে দিয়ে জামায়াত নেতা গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে এনে দেশে পুনর্বাসিত করেছিলেন। কওমি শিক্ষার্থীদের সেই স্বীকৃতি ফিরিয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা।

এই স্বীকৃতির ফলে সমাজের মূলধারার সাথে কওমি সনদধারীদের প্রতিযোগিতায় আসার সুযোগ আসবে। সমাজের অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে যখন হুজুররা কর্মসংস্থানের প্রতিযোগিতায় করবেন, তখন নিজেদের সবল ও দুর্বলদিকগুলো সম্পর্কে জানতে পারবেন। ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি অংক, বিজ্ঞান, ইংরেজি, সাহিত্য, সমাজ নিয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করলে যেকোনো ক্ষতি নেই, বরং বহুবিধ ফায়দা আছে সেটি যেদিন এদেশের হুজুর সমাজ বুঝতে পারবেন, সেদিনই শুরু হবে আসল পরিবর্তন।

একটি ছবি সেদিন শোকরানা মাহফিলের সময় ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। রাজু ভাস্কর্যের সামনে সেলফি তুলছে কয়েকজন মাদ্রাসা ছাত্র। কত মানুষ যে সে ছবি শেয়ার করেছে ইয়ত্তা নেই। ঢাকার যারা বড় বড় কথা বলা বুদ্ধিজীবী আছেন, তারা পারবেন মনের ঘৃণা দিয়ে এই অবিস্মরণীয় ছবির জন্ম দিতে? শেখ হাসিনা পেরেছেন ভালোবাসা দিয়ে, প্রজ্ঞা দিয়ে। ঘৃণা শুধু ঘৃণার জন্ম দিতে পারে, ভালোবাসা জন্ম দিতে পারে ভালোবাসার। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক একা একা চলতে পারেন, একজন সাংবাদিকও তার নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে চলতে পারেন, একজন সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক সব কিছু এড়িয়ে শুধু নিজের মত করে জীবন যাপন করতে পারেন। কিন্তু একজন রাষ্ট্রনেতাকে সবাইকে নিয়ে ভাবতে হয়, চলতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শুধু কিছু শহুরে শিক্ষিত মানুষের নন, তিনি রাষ্ট্রের সকলের। বাংলাদেশের সামাজিক স্থিতি অর্জনের প্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনার এই ভূমিকা বাঙালি জাতি আজীবন স্মরণ রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :