পঁচাত্তরের কুশীলবরাও মাঠে?

প্রকাশ | ০৮ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:৪৯

প্রভাষ আমিন

নির্বাচন এলেই রাজনীতিতে নানা সমীকরণ শুরু হয়। জোট-মহাজোট-ফ্রন্ট নানা নামে দলগুলো একত্র হয়। চলে দলবদল। বিশেষ করে ছোট দলগুলোর তৎপরতা বেড়ে যায়। তারা হিসাব করে কার সাথে গেলে লাভ বেশি, কার সাথে গেলে ভালো দর পাওয়া যাবে; ইতাদি ইত্যাদি। এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে গত ৫ নভেম্বর একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশ-পিপিবি নামে দলটির আহ্বায়ক রিটা রহমান। নতুন দল গঠনের সংবাদ সম্মেলনে রিটা রহমান বলেছেন, ‘মওলানা ভাসানী ও মশিয়ুর রহমান যাদু মিয়ার যে নতুন প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার সৃষ্টির লক্ষ্যে কাগমারী সম্মেলন পরবর্তীতে ন্যাপ ধারণ করে, সেই রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবে ন্যাপের মহান রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা সমুন্নত রেখে আমরা এই দলের আত্মপ্রকাশ করেছি।’

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠন নতুন কিছু নয়। বরং গণতন্ত্র মানেই শত ফুল বিকাশের সুযোগ, শত মত প্রকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। রিটা রহমান একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান। তার পিতা মশিয়ুর রহমান যাদু মিয়া জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার সিনিয়র মিনিস্টার ছিলেন। রিটা রহমানের ভাই শফিকুল গানি স্বপন এরশাদ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। শফিকুল গানি স্বপনের ছেলে ব্যারিস্টার জেবেল রহমান গানি বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান। সম্প্রতি তিনি ২০ দলীয় জোট ছেড়ে বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টে যোগ দিয়েছেন। বাংলাদেশ ন্যাপও নিশ্চয়ই মওলানা ভাসানীর আদর্শ ধারণ করতে চায়। কিন্তু রিটা রহমান ভাতিজার দলে যোগ না দিয়ে একই আদর্শ বাস্তবায়নে নতুন দল গড়েছেন।

একই আদর্শ নিয়ে একাধিক দল করা নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু রিটা রহমানের আরেকটি পরিচয় আমাকে শঙ্কিত করেছে। রিটা রহমান মশিয়ুর রহমান যাদু মিয়ার কন্যা। আর তার স্বামী মেজর (অব.) খায়রুজ্জামান। এই মেজর পঁচাত্তরের খুনি চক্রের অন্যতম সদস্য। ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এবং ৩ নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যার পর খায়রুজ্জামানও দেশ ছাড়ে। ফারুক-রশীদের সঙ্গে পাড়ি জমায় লিবিয়া। পরে জিয়াউর রহমানের আনুকূল্যে আরও অনেকের সাথে চাকরি পায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

৭৫ থেকে ৯৬- এই ২১ বছর বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর তার খুনিরা ছিল সূর্যসন্তান। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করারও সুযোগ ছিল না এই দেশে। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে তারা রাজনীতিতেও পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা করেছে। খুনিদের গড়া ফ্রিডম পার্টি একসময় বাংলাদেশে সন্ত্রাসী দল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সংসদকেও কলঙ্কিত করেছিল। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের বাধা দূর হয়। তখনই দায়ের হয় জেলহত্যা মামলাও। আর জেলহত্যা মামলার অন্যতম আসামি এই মেজর (অব.) খায়রুজ্জামান। তাকে প্রেপ্তারও করা হয়েছিল। বিএনপি ক্ষমতায় এলে জামিনে মুক্তি পায় খায়রুজ্জামান। আসামি থাকা অবস্থায়ও বিএনপি সরকার খায়রুজ্জামানকে প্রমোশন দেয়। তখন বিএনপির আনুকূল্যে জেলহত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি পায় খায়রুজ্জামান। এরপর বিএনপি সরকার তাকে মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে। ১/১১ সরকারের সময় খায়রুজ্জামান নিয়োগ পান মালয়েশিয়ায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাকে দেশে ফিরে আসতে বলে। কিন্তু খায়রুজ্জামান দেশে না এসে পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে ৬০ লাখ টাকার তহবিল তসরুপেরও অভিযোগ ছিল। খায়রুজ্জামান মালয়েশিয়াকে সেকেন্ড হোম বানিয়েছিলেন। কিন্তু মালয়েশিয়াকেও নিজের জন্য নিরাপদ মনে না করে খায়রুজ্জামান পালিয়ে যান কানাডায়।
এই পলাতক খায়রুজ্জামানের স্ত্রী রিটা রহমান এখন নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। আর পিপিবির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঐক্যফ্রন্ট নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। সরকারের পতন ঘটাতে মান্নারা বৃহত্তর ঐক্য করেছেন। সেটাতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু নির্বাচনী ডামাডোলে পঁচাত্তরের কুশীলবরাও মাঠে সক্রিয় হচ্ছে কি না, শঙ্কা সেটা নিয়েই।

প্রভাষ আমিন: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ