সিলেট-১ আসনে কে পাবেন নৌকা?

প্রকাশ | ১৩ নভেম্বর ২০১৮, ২২:৪২

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু

সিলেট আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একসময়ে নেতৃত্বদানকারী ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ, ফরিদ গাজী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এই তিন জন নেতাই মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

তবে স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সিলেট জেলার নেতৃত্ব নিয়ে ফরিদ গাজী ও আব্দুস সামাদ আজাদ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এই সময় অবশ্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সিলেট মোজাফফরপন্থি ন্যাপের নেতা ছিলেন এবং ১৯৭৩ নির্বাচনে ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।

ফরিদ গাজী ছিলেন সিলেট শহরের নেতা আর সামাদ আজাদ ছিলেন সুনামগঞ্জের নেতা। এই দুইজনের দ্বন্দ্বের কথা বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই অবগত ছিলেন। পরে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আওয়ামী লীগে যোগদান করলে সামাদ আজাদের সাথে তারও মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। কারণ, সুরঞ্জিত সেনও ছিলেন সুনামগঞ্জের বাসিন্দা।

আবদুস সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে আমার কোনোদিন দেখা হয়নি। তবে দেওয়ান ফরিদ গাজী যখন বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তখন একদিন সকালে তার বাসায় গিয়েছিলাম। আমি তখন ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর কমিটির সমাজকল্যাণ সম্পাদক।

মন্ত্রীর বাসায় প্রবেশ করতেই দেখি মাঠে একটি সাধারণ চেয়ারে লুঙ্গি আর শার্ট পরে আরেকটি চেয়ারে আয়না রেখে শেভ করছেন। আমাকে দেখে বসতে বললেন।

মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর কাছে আমার যাওয়ার প্রধান কারণ ছিল ঢাকা আইডিয়াল কলেজে শহীদ মিনার নির্মাণে সরকারি মূল্যে সিমেন্ট ক্রয়ে ছাড়পত্রে সহযোগিতা। সেদিন তিনি আমার কাজ করে দিয়েছিলেন এবং পরে আইডিয়াল কলেজে শহীদ মিনার তৈরি  করা হয়েছিল। এর উদ্বোধন করেন আজকের মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।

সেদিনের একান্ত আলোচনায় সিলেটের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে তার (গাজী) পরিকল্পনার অনেক কথা শুনেছিলাম। সিলেটের প্রতি তার ভালোবাসা ও একটি সহজ সাধারণ জীবন ধারণের প্রমাণ সেদিন পেলাম।

বঙ্গবন্ধুর পরে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের হাত ধরলেও এই তিন নেতার দ্বন্দ্ব মেটানো সম্ভব হয়নি। ৯৬ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আব্দুস সামাদ আজাদকে শেখ হাসিনা পররাষ্ট্র মন্ত্রী করেন। ফলে সিলেটের রাজনীতিতে দেওয়ান ফরিদ গাজী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কিছুটা হলেও কোণঠাসা হয়ে পড়েন।

আবদুস সামাদ আজাদ ও দেওয়ান ফরিদ গাজীর মৃত্যু হলে সুরঞ্জিত সেন সিলেট আওয়ামী লীগের একক শীর্ষ নেতা হিসেবে নিজেকে খুব সহজেই প্রতিষ্ঠিত করেন। যদিও সিলেট শহরে দেওয়ান ফরিদ গাজী ও সুনামগঞ্জে সামাদ আজাদের সমর্থকেরা কখনো তাকে সহজভাবে গ্রহণ করেনি।

এইসময় অনেকে ধারণা করেছিলেন সিলেটে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে সামনে আসছেন ডাকসুর সাবেক সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। কিন্তু ফকরুদ্দিন আহমেদের অস্থায়ী সরকারের সময় তার ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন আসে। পরে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে ছিটকে পড়েন। বারবার চেষ্টা করেও আর ফিরে আসতে পারেননি। সিলেট তথা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুলতান মনসুরের অধ্যায় এখন শেষ প্রায়।

একসময়ের দক্ষ সরকারি আমলা এম এ মুহিত মন্ত্রী হয়ে সিলেট আওয়ামী লীগের কর্ণধার হন। পরপর দুইবার শেখ হাসিনা সরকারের একজন সফল অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার অগ্রযাত্রাকে কেউ  আটকাতে পারেনি। বারবার মিডিয়ায় এম এ মুহিতের বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা হলেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রিয়।

একটি সূত্রে জানা যায় মুহিতের সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাকে তাহলে আরেকজন মুহিত এনে দেন।’

বয়সের কারণে কখনো কখনো মুহিত কিছু কথা বললেও তার যোগ্যতার সীমা নেই। তাই হয়তো দলের মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতারা তার পদত্যাগ দাবি করা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী কারো কোথায় কর্ণপাত করেননি।  মুহিত মুহিতের জায়গায় আছেন, কেউ তাকে অর্থমন্ত্রী পদ থেকে সরাতে পারেনি।

কিন্তু আসছে নির্বাচনে তিনি প্রথমে প্রার্থী না হওয়ার কথা বললেও পরে প্রার্থী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার লক্ষ্যে ফর্ম ক্রয় করে সবাইকে অবাক করেছেন। আগামী ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে কে আসছেন এনিয়ে সিলেটে চলছে নানা গুজব।

সিলেট-১ আসনের গুরুত্ব অনেক। কারণ, অতীতে এই আসন থেকে যে দলের প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছে তারাই সরকার গঠন করেছে। এম এ মুহিতের পূর্বে বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান মৌলভীবাজারের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও সিলেট-১ আসনে প্রার্থী হয়ে বার বার জয়লাভ করেন। তিনি আজ না ফেরার দেশে চলে গেলেও সিলেটের উন্নয়নে তার অবদানের কথা সিলেটবাসী চিরদিন  মনে রাখবে।

আগামী ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে শিক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীর নাম আসার সম্ভবনা  রয়েছে। আসছে নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কে মনোনয়ন পাবেন এনিয়ে সিলেটে  চলছে জল্পনা  কল্পনা।

এপর্যন্ত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি এ কে আবদুল মোমেন ছাড়াও দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এবার সিলেট-১ আসনের মনোনয়ন নিয়ে লড়াই হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাস উদ্দিন হয়তো বা এখানেও প্রার্থী হতে পারেন। তাহলে  জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড. মোমেন অথবা ফরাস উদ্দিনের মধ্যে একজনকে  মনোনয়ন দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

অর্থমন্ত্রী মুহিত, সাবেক মেয়র কামরান সম্ভবত ড.মোমেনের সমর্থনে সময়মতো প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। তবে যতটুকু জানা যায় এই আসনে মোমেনকেই নমিনেশন দেওয়ার সম্ভবনা বেশি।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ  এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইনের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে সিলেটের অন্য কোনো  আসন থেকে তাদের মনোনয়ন পাওয়ার  সম্ভাবনা থাকতে পারে।

অন্যদিকে ফরাস উদ্দিন সিলেট-১ আসন থেকে না দাঁড়িয়ে হবিগঞ্জ থেকে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, তার বাড়ি হবিগঞ্জ। এমনও হতে পারে ড. মোমেন সিলেট-১ ও ড. ফরাসউদ্দিন হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে মনোনয়ন পেতে পারেন।

যদিও অনেকে বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এম এ মুহিতকে পুনরায়  সিলেট-১ আসনে নমিনেশন দিতে পারেন। কিন্তু সূত্র বলছে অন্য কথা। শেষ মুহূর্তে তিনি তার প্রার্থী পদ প্রত্যাহার  করবেন।

একসময় মিডিয়ায় আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে সরিয়ে দিয়ে ড ফরাস উদ্দিনকে অর্থমন্ত্রী  করার কথা প্রকাশিত হয়। অনেকেই তখন মনে করেছিলেন, এবার হয়তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থমন্ত্রী পদে পরিবর্তন আনবেন। কিন্তু তিনি তা না করে  মুহিতের  প্রতি  তার  বিশ্বাস ও আস্থা প্রকাশ করেছেন। আবুল মাল আব্দুল মুহিত প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রিয় ব্যক্তি, এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন নেই।

আন্তর্জাতিক  দিক  থেকে বিবেচনা করলে  ড. মোমেন ও ড. ফরাসউদ্দিন দুইজনই নিজ নিজ অভিজ্ঞতায় সুপরিচিত। ফরাস উদ্দিন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। পরে শেখ হাসিনার সরকারে ১৯৯৮-২০০১ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন।

ড. মোমেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। সরকার তার দায়িত্ব পালনের প্রতি সন্তুষ্ট। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আসছে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে পুনরায় সরকার গঠন করলে সিলেট থেকে এই দুই ব্যক্তিকে মন্ত্রিপরিষদে নেওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। সম্ভবত. বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনকে নুতন সরকারে অর্থমন্ত্রীর পদে রাখা হতে পারে।