মাদকাসক্তি, বিয়ে আর আদালতের রুল
আমাদের এই বাংলাদেশের আদালত মাঝে মধ্যে দারুণ কিছু কাজ করে। এমন কিছু আদেশ দেয়, যা দেখে সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের আশার সঞ্চার হয়। তারা ভাবে, তাদের মনের কথা বলার মতোও কেউ না কেউ আছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। গেল সপ্তাহে এমনই একটা আদেশ পাওয়া গেল।
গত ৫ নভেম্বর এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি খাইরুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ একটা রুল জারি করেন। সেখানে তাঁরা জানতে চান-বাংলাদেশের সব চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে কেন ডোপ টেস্ট নেওয়া হবে না? আরও জানতে চান বিয়ের কাবিন রেজিস্ট্রির আগে বর-কনের রক্তে মাদক বা থ্যালাসেমিয়ার নমুনা আছে কি না-তার পরীক্ষা কেন বাধ্যতামূলক নয়? আদালত এসব প্রশ্নের উত্তর চেয়েছেন সরকারের কাছে। সরকার শেষ পর্যন্ত কি উত্তর দেবেন জানি না। সরকার কি বিষয়টার গুরুত্ব সাধারণ জনগণের মতো করেই উপলব্ধি করবেন? এবং তা করে সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইন পাস করবেন? নাকি বিষয়টাকে তেমন কিছু গুরুত্বই দেবেন না? হয়তো বলবেন-ওই সব চেষ্টা করতে গেলে অহেতুক ঝামেলা বাড়বে, তাই বিয়ে এবং চাকরির ক্ষেত্রে নতুন করে কিছু নিয়ম প্রচলনের দরকার নেই।
আসলে কি হবে, না হবে-সেসব হয়তো সময়েই টের পাওয়া যাবে। তবে অতদূর অপেক্ষার আগেই এতটুকু অন্তত বলা যায়, আদালতের এই রুলটা খুবই সময়োপযোগী হয়েছে। বিয়ের কাবিন রেজিস্ট্রেশন নিয়ে আগে থেকেই নানা ঝামেলা চলছিল। সারা দেশকে যখন ডিজিটাল করার জন্য সরকার উঠেপড়ে লেগেছে, তখন বিয়ের কাবিন রেজিস্ট্রেশনটাও ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইনে করা দরকার। এভাবে অনলাইনে নিবন্ধন করলে কাবিনের সকল তথ্যই সরকারের ডাটাবেইজে থেকে যাবে। ফলে অনেক প্রতারক যে আগের বিয়ের কথা গোপন করে মেয়েদেরকে বিয়ের ফাঁদে ফেলে, সেটা সহজ হবে না। এটা অবশ্য পুরনো একটা দাবি।
তবে বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষার বিষয়টি অনেক দিন ধরেই আলোচনায় ছিল। এটা বৈজ্ঞানিক কারণেই দরকার। যেমন ধরা যাক থ্যালাসেমিয়ার কথা। এটা এমন একটা মরণঘাতী রোগ, যেটি কারও হলে, আর সে যদি মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য হয়, তাহলে তার চিকিৎসা করাতে গিয়ে পুরো পরিবারটিরই পথে বসার উপক্রম হয়। অথচ বিয়ের আগে যদি রক্তের কিছু সহজ পরীক্ষা করা যায়, তাহলেই এই বিপদ থেকে বাঁচা যায়। থ্যালাসেমিয়া রোগটি এমন যে, এই রোগটির বাহক হয়েও যেকোনো মানুষ পুরো জীবন স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারেন। কিন্তু বাবা-মা দুজনেই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, তাহলে তাদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। তাই বিয়ের আগে ছেলেমেয়ে দুজনেরই রক্ত পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় যে, উভয়ই থ্যালাসেমিয়ার বাহক, সেক্ষেত্রে উভয় পক্ষই সতর্ক হতে পারবেন। তারা বুঝতে পারবেন, এই বিয়েটি হলে তাদের যে সন্তান হবে সে থ্যালাসেমিয়া নিয়েই জন্ম নিতে পারে। আগে থেকে জেনে গেলে হয়তো বিরাট একটা দুর্ভোগ থেকে দুটি পরিবারই বেঁচে যাবে।
অথবা ধরা যাক, মরণঘাতী এইচআইভি পজেটিভ বা এইডস রোগের কথা। এ রোগের চিকিৎসা এখনো আবিষ্কার হয়নি। এইডস হওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। এই রোগটি ছড়ায় মূলত রক্ত এবং যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে। কাজেই বর-কনের কোনো একজন যদি এইচআইভি পজেটিভ হয়, তাহলে তার পার্টনার তো বটেই, হয়তো পরবর্তী প্রজন্মও একই মারাত্মক রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে। অথচ বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করে নিলে এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
এসব বিষয় আগেই জানা ছিল, হয়তো বা আলোচনাও হতো। কিন্তু ভদ্রতা বা চক্ষুলজ্জার খাতিরে বিয়ের সময় কেউ অপর পক্ষের কাছে সেসব জানতে চাইতো না। কিন্তু একটা আইন হয়ে গেলে, কাবিনের সময় যদি কোনো একটি ধারায় এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার নিয়ম থাকে, তাহলে এই বিষয়গুলো হয়তো জানা যাবে। পরিবারগুলো বাঁচবে মহাবিপদ থেকে।
নতুন যে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে সেটা হচ্ছে- মাদক। বলা হচ্ছে, কেবল রক্তবাহিত রোগের বিষয়টা জানার জন্যই নয়, বর-কনের কেউ একজন মাদকাসক্ত কি না সেটাও বিয়ের আগে জেনে নেওয়া দরকার। আর সে জন্যই বিয়ের আগে উভয়ের রক্ত পরীক্ষা করতে হবে, কাবিন রেজিস্ট্রেশনের কোনো এক ধারায় সেটি যুক্ত করতে হবে। বর বা কনে মাদকাসক্ত জেনেও যদি অপর পক্ষ বিয়েতে রাজি হয়, তবে সেটি হবে তাদের ব্যাপার। কিন্তু বিষয়টি জেনে নিতে হবে, গোপন রাখা যাবে না।
আসলে ডোপটেস্টের বিষয়টি এসেছে দেশের ক্রমবর্ধমান মাদকাসক্তির কথা বিবেচনা করেই। মাদকের করাল গ্রাস এখন ছেয়ে ফেলেছে পুরো জাতিকে। সরকারের এক হিসাব অনুযায়ী, দেশে এই মুহূর্তে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭৫ লাখ! দেশে মোট জনসংখ্যা যদি ১৮ কোটি ধরি, তাহলে প্রতি বিশজনে একজন। কি ভয়ঙ্কর!
বিচারপতিগণ যে রুল জারি করেছেন সেখানে এই মাদকাসক্তি মানুষের বিবাহিত ও পারিবারিক জীবনে কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, সে বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। দেখা গেছে ইদানীং যে বিবাহবিচ্ছেদের হার অনেকটাই বেড়ে গেছে, তার পিছনেও রয়েছে এই মাদকাসক্তি। বিবাহ বিচ্ছেদের সময় স্বামী-স্ত্রী দুই পক্ষকেই যেতে হয় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদের সালিশ কেন্দ্রে। সেখানে উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করার চেষ্টা হয়। এই সালিশ কেন্দ্রগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যেও দেখা যায়, অধিকাংশ বিয়ে ভাঙার পিছনে কারণ হিসেবে রয়েছে এই মাদকাসক্তি।
মাদক বলতে দেশে এই মুহূর্তে ইয়াবার কথাই বলতে হবে। অন্য সব মাদককে ছাড়িয়ে গেছে এখন ইয়াবার আগ্রাসন। এটা আসে মূলত মিয়ানমার থেকে। এই শতকের শুরুতেও ইয়াবার প্রকোপ তেমন দেখা যেত না। ২০০৩-০৪ সাল থেকে বাংলাদেশে এর প্রচলন দেখা যায়। শুরুতে এটি মূলত একটু অভিজাত শ্রেণিতে দেখা যেত। তারপর ধীরে ধীরে সর্বব্যাপী এবং সর্বগ্রাসী হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে তরুণ শ্রেণি, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ইয়াবা গ্রহণের প্রবণতা আতঙ্কজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ইয়াবা গ্রহণ করলে শুরুর দিকে ঘুম কমে যায়, দীর্ঘক্ষণ একটানা কাজ করা যায়। সম্ভবত এটিই প্রধান কারণ হয়ে থাকবে এর প্রতি ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহের। কিন্তু এভাবে শুরুর পর ধীরে ধীরে এটি পুরো জীবনকেই খেতে শুরু করে, শারীরিক-মানসিক সকল দিক দিয়েই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। তার স্বাভাবিক চিন্তার ক্ষমতা আর থাকে না। মানুষ পরিণত হয় পশুতে। ভাঙতে থাকে পরিবার, আপত্য বন্ধন।
আদালত অবশ্য বিয়ের পাশাপাশি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রেও এই ডোপ টেস্টের কথা বলেছেন। এটিও আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। আসলেই তো, কোনো চাকরি অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ কাজে যিনি থাকবেন, তিনি যদি হন মাদকাসক্ত, স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি বা বিবেকবোধ যদি না থাকে তার মধ্যে, তাহলে তো বিপদ। কাজেই চাকরি হওয়ার সময় কেবল নয়, আমার তো মনে হয় এমন নিয়ম করা দরকার, যাতে চাকরি হওয়ার পরও প্রতিবছর এই ডোপ টেস্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় সবাইকে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলোয়াড়দের মধ্যে তো এই ধারা প্রচলিতই। প্রতিটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আগে-পরে ডোপ টেস্ট করা হয়। তাহলে চাকরি ক্ষেত্রে করতে অসুবিধা কোথায়?
মাদকের প্রকোপ নিয়ে আমরা খুব চিন্তা করি। সরকারের মধ্যেও কিছুদিন পরপর নানা হুঙ্কার শোনা যায়। কিছুদিন আগেও দেখলাম মাদক নিয়ন্ত্রণের নামে সারা দেশে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। একের পর এক মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে ধরে মেরে ফেলা হচ্ছে। তখন বেশ একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল মাদকসেবীদের মধ্যে। কিন্তু তারপর হঠাৎ করেই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক ডামাডোল শুরু হওয়ায় থেমে গেছে সবকিছুই। মাদক চোরাচালান, ব্যবসায়, সেবন- সবই চলছে আবার অবাধে। এর মাঝে মাদক নিয়ে কঠোর একটা আইনও প্রণীত হলো। কিন্তু তার কোনো ইতিবাচক প্রভাব সমাজে আদৌ পড়েছে বলে মনে হয় না।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কিভাবে? প্রথমত উৎসে আঘাত করতে হবে, সরবরাহটা বন্ধ করতে হবে। আর দ্বিতীয়ত ব্যবহারকারীদের থামাতে হবে। এর একটি অপরটির বিকল্প নয় বরং পরিপূরক। একদিকে বন্ধ করে অপরদিক খোলা রাখলে কাজের কাজ কিছু হবে না। চাহিদা থাকলে সরবরাহ হবেই। আর এই দুই পক্ষের মাঝখানে রয়েছে পেডলার বা খুচরা বিক্রেতা। এরা গডফাদারদের কাছ থেকে মাদক সংগ্রহ করে, তারপর সেগুলো বিক্রি করে ব্যবহারকারীদের কাছে। কিছুদিন আগে যে মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালিত হলো, তখন এই খুচরা বিক্রেতাদেরই ধরা হয়েছে। এদের অনেকের মৃত্যুও হয়েছে ‘বন্দুকযুদ্ধে।’ হাতেগোনা দু-একজন ব্যবহারকারী ধরা পড়লেও গডফাদারদের কাউকেই আটক করা যায়নি। তবে ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, সাধারণ মানুষের কাছে কিন্তু ব্যবহারকারী আর খুচরা বিক্রেতাদের চেয়ে গডফাদাররাই বেশি পরিচিত। এরকম দু-একজনের নাম তো সারা দেশের মানুষের মুখে মুখে প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হতে শোনা যায়।
তবে আশার কথা আদালতের রুল অনুসরণ করে বিয়ে বা চাকরির ক্ষেত্রে রক্ত পরীক্ষা শুরু হলে হয়তো মাদকের প্রান্তিক ব্যবহারে একটা ঝাঁকুনি পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারের কেবল আইন প্রণয়ন করলেই দায়িত্ব শেষ হবে না; আন্তরিকতা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থারও। নয়তো কেবল আইনই হবে, তার আর কোনো প্রয়োগ দেখা যাবে না। বছর কয়েক আগে উচ্চ আদালত থেকে একটা আদেশ এসেছিল-রাজধানীর ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানো যাবে না। রাস্তায় আমরা অনেকেই চলাচল করি, ফুটপাতের দিকেও চোখ যায়। কারো কি কখনো মনে হয়েছে-আদালতের সেই আদেশটি আদৌ পালিত হচ্ছে? আদেশটি বাস্তবায়নে আদৌ আন্তরিক আছে আমাদের পুলিশ বাহিনী?
তাই বেশি আশা করে আর কি হবে!
মাসুদ কামাল: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক