সহিনামা আ স ম রব

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ২২ নভেম্বর ২০১৮, ১৯:১৯

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রবের রাজনীতির ঘোলাটে ভাগ্যাকাশ সপ্তাহ কয়েক আগে হঠাৎ পরিষ্কার হবার পর আবার কালো মেঘে ঢেকে যাবার উপক্রম হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে অনেকে মনে করেন, রাজনীতির অচ্ছুত অবস্থা থেকে তার উঠে আসার প্রয়াস সাফল্যের দোড়গোড়া থেকে আবার অন্ধকারে নিপতিত হতে যাচ্ছে। সামগ্রিক বাস্তবতায় হয়তো তিনি এবার সংসদ সদস্যও হতে পারবেন না, যদিও এবার স্বপ্ন তার মন্ত্রী হবার। কিন্তু উল্টোটা হতে পারে এবার। তিনি চলে যেতে পারেন রাজনীতির চূড়ান্ত আস্তাকুঁড়ে। এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।

এদিকে কারো কারো মতে, কেবল নির্বাচিত হওয়া নিয়ে নয়, অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে আ স ম রবের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হওয়া নিয়েও। কারণ, মনোনয়ন প্রশ্নে তারেক রহমান যেভাবে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন তাতে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের আবদার কতটা রাখবেন তা নিয়েও অনেকের সংশয় দেখা রয়েছে। আবার জোটের নেতারা আ স ম আবদুর রবের মনোনয়ন প্রশ্নে শক্ত অবস্থান গ্রহণের ক্ষেত্রে কতটা আন্তরিক হবেন, সে প্রশ্নও কিন্তু একেবারে ফেলনা নয়! কাজেই বিভ্রান্ত রাজনীতির ক্লান্ত পথিক আ স ম রব এবার কোন বিভ্রান্তির পথে হাটছেন তা অদূর ভবিষ্যতে পরিষ্কার হবে। তবে তার অতীত চিত্র মোটামুটি পরিষ্কার।

হিমালয়সম বঙ্গবন্ধুর ছায়াতলে থেকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় ছাত্রনেতা এবং ডাকসুর ভিপি হিসেবে আ স ম আবদুর রব রাজনীতিতে আকাশসম উচ্চতায় উঠেছিলেন। কিন্তু ৭৫-এর থিংকট্যাংকের নীলনকশায় যারা অন্যরকম পেক্ষাপট তৈরির কুশীলবদের খপ্পরে যারা পড়েছিলেন আ স ম রবও তাদের একজন। আর ১৫ আগস্টের নৃশংতার পর রবদের উপযোগ ফুরিয়ে যায়। এদের মধ্যে যারা দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম আ স ম আবদুর রব।

একপর্যায়ে জনাব রবের রাজনৈতিক ক্লান্তি এতোটাই হতাশায় পরিণত হয় যে, তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেবার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে সময় তিনি একটি চাকরিও চেয়েছিলেন প্রকাশ্যে। উল্লেখ্য, তার মতো চার খলিফা খ্যাত উত্তাল দিনের আর এক ছাত্রনেতা আবদুল কুদ্দুস মাখন রাজনীতির বলয়ের বাইরে চলে গিয়ে চাকরিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চাকরিই করেছেন। ৯১ সালে সংসদ নির্বাচনের আওয়ামী লীগের মনোনয়নের মাধ্যমে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ পেলেও আসন বণ্টনে ভ্রান্তির কারণে তাকে পরাজয় বরণ করতে হয়। ফলে তার রাজনীতিতে আর ফেরা হয়নি। চাকরিতে থাকা অবস্থায়ই দুরারোগ্য ব্যাধির কাছে পরাজিত হয়ে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান ৯৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। তখন চার খলিফা খ্যাত অপর তিনজন নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ ও আ স ম রব বেশ ধনবান ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু সেদিন আবদুল কুদ্দুস মাখনের চিকিৎসার জন্য তারা কেউ পাশে দাঁড়িয়েছেন বলে জানা যায়নি।

আবদুল কুদ্দুস মাখনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই হয়তো চাকরি করতে চেয়েছিলেন আ স ম রব। কিন্তু এ থেকে তাকে রেহাই দিয়েছেন সামরিক শাসক জেনালের এরশাদ। তবে এটি মোটেই নিঃশর্ত দান ছিল না। বিনিময়ে তাকেও কিছু করতে হয়েছে এরশাদের জন্য। তা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ-বিএনপির বর্জনের মুখে ১৯৮৮ সালের সাজানো সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আ স ম বরকে সামনে রেখে সাইনবোর্ড সর্বস্ব কয়েকটি দল নিয়ে ‘কপ’ নামে একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করা।এই জোটের ‘শীর্ষ’ নেতা হিসেবে এরশাদের রাবার স্ট্যাম্প সংসদে বিরোধী দলের নেতা করা হয়েছিল আ স ম আবদুর রবকে। তখন তাকে বলা হতো ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলীয় নেতা। তখন তিনি বেশ সরব ছিলেন সংসদের ভিতরে ও বাইরে। কিন্তু মাত্র দুই বছরের মাথায় এরশাদ সরকারের পতনের পর আবার নীরব হয়ে যান আ স ম আবদুর রব।

এরপর অনেককে অবাক করে দিয়ে অদ্ভুত এক ইকোয়েশনে ১৯৯৬ সালে হাসিনা সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় দফায় শপথ নেন আ স ম আবদুর রব। অবশ্য এ ক্ষেত্রে আবদুল আউয়াল মিন্টুর তদবির প্রধান হিসেবে কাজ করেছে বলে জানা গেছে। কিন্তু ২০০১ হাসিনা সরকারের অবসানের পর আ স ম রব রাজনীতিতে আবার অপাংতেয় হয়ে পড়েন। সেই মাজুল দশা থেকে গত প্রায় দেড় যুগধরে তিনি একাধিকবার উঠে আসার চেষ্টা করেছেন নানানভাবে। কিন্তু তেমন সুবিধা হচ্ছিল না। অবশেষে তার সামনে বিশাল এক সুযোগ এলো ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ‘বিএনপি উদ্ধার’ প্রকল্প গ্রহণ করায়। ড. কামালের মিশন কতটা কি সফল হবে তা নিশ্চিতভাবে বুঝতে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে এ সুযোগে রাজনীতির মরণ দশা থেকে আ স ম রব অনেকটাই উঠে এসেছেন, এটা মানতেই হবে। কিন্তু তার বিপদ এখনো কাটেনি, তিনি এখনও রাজনীতির আইসিউতে আছেন বলে মনে করছেন অনেকে। বরং ৩০ ডিসেম্বরের পর তাকে আবার রাজনীতির আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হতে পারে। এমনকি তখন তার অবস্থা হতে পারে আরো নাজুক। অনেকের মতে তার জন্য বৈরী পরিবেশ অপেক্ষা করছে ৩০ ডিসেম্বর ভোটে।

আবার কারো কারো মতে, তারেক রহমানে বিবেচনায় জনাব রবের মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি প্রশ্নোবিদ্ধ হয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক কুষ্ঠিনামা বিচার করার পাশাপাশি সামনে নিয়ে আসা হয়েছে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তার ভূমিকার বিষয়টি। সব মিলিয়ে এবার নির্বাচনী ইকোয়েশন আ স ম আবদুর রবের জন্য খুবই বৈরী!

আ স ম রবের নির্বাচনী এলাকা লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি ও কমলনগর)। এ আসনে তার জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। এদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মিত্রদের সঙ্গে আসন সমঝোতায় এ আসনটি যুক্তফ্রন্টকে ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে যুক্তফ্রন্টের শরিক বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান এ আসনে প্রার্থী হতে পারেন। এদিকে আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংসদ মো. আবদুল্লাহকেও প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। কারণ, ঋণখেলাপি হিসেবে মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের প্রার্থিতার বিষয়ে সমস্যা দেখা দিলে মো. আবদুল্লাহর বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে।

এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের মধ্যে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই আ স ম আবদুর রবের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ভালোভাবে দেখছে না স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াত। আর আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী থাকা অবস্থায় কর্মকাণ্ডের কারণে স্থানীয় বিএনপি আ স ম রবকে অন্তর থেকে কতটুকু গ্রহণ করবে তা নিয়েও বেশ সংশয় রয়েছে বিভিন্ন মহলে। এ আসনে বিএনপি থেকে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সহ-সম্পাদক সাবেক সাংসদ এ বি এম আশরাফ উদ্দিন নিজাম, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. হারুন-অর-রশিদ, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি শফিউল বারী বাবু ও জাতীয়তাবাদী তাঁতী দলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আবদুল মতিন। এ আসনে মনেনয়ন পাবার ব্যাপারে সাবেক বিএনপির সংসদ সদস্য আশরাফ উদ্দিন নিজাম বেশ আশাবাদী। এ অবস্থায় অন্য কেউ মনোনয়ন পেলে হয়তো তিনি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করবেন না। কিন্তু রাজনীতিতে কি সব কিছু প্রকাশ্যে হয়? তাও আবার নির্বাচনী রাজনীতিতে! ফলে বিএনপির উপর ভরসা করে ড. কামাল হোসেনের পাশে বসে নেতা হিসেবে রঙধনুর মতো একটি অবস্থান জানান দেয়া সম্ভব হলেও ৩০ ডিসেম্বর ভোটের বৈতরণী পার হয়ে তিনি সংসদে প্রবেশ করতে পারবেন কিনা, তা একটি বড় প্রশ্ন হয়েই থেকে যাচ্ছে।

আলম রায়হান, লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :