হাম-হামে রোমাঞ্চিত একদিন

গাজী মুনছুর আজিজ
 | প্রকাশিত : ২৯ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:৫৭

আমাদের গন্তব্য হাম-হাম ঝরনা। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার একটি রেস্টুরেন্টে নাশতা সেরে তার জন্য যাত্রা করি। ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ৬টা পেরিয়ে। সঙ্গী অনুজ বন্ধু সাজেদ, গুলজার, মাসুম, মাহবুব ও জামিল। এর মধ্যে সাজেদ আমার পরিচিত। বাকিরা সাজেদের বন্ধু। আর আমি আসছি ঢাকা থেকে। বাকিরা এলো বড়লেখা থেকে। যে প্রাইভেট কারে যাচ্ছি এটি গুলজারের, চালকও তিনি।

প্রথমে আসি কমলগঞ্জ উপজেলা সদরে। এখান থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে হাম-হামের অবস্থান। কমলগঞ্জ থেকে আদমপুর বাজার হয়ে আমরা এগোই হাম-হামের দিকে। দুই পাশে সারি সারি চা-বাগান আর আঁকাবাঁকা মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে আসি চাম্পারায় চা-বাগান। এ পর্যন্ত পথটুকু ভালোই ছিল। গাড়িও চলছিল ঠিকঠাক। কিন্তু এখান থেকে শুরু হয়েছে মাটির পথ, যা গাড়ি চলার উপযুক্ত নয়। তবু গুলজার আস্তে আস্তে চালিয়ে চলল। এভাবে কুরমা বন বিটের চা-বাগান পাড়ি দিয়ে আসি কলাবন গ্রামে। কুমরা বন বিট রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের একটি। কলাবন গ্রামটি আদিবাসী চা শ্রমিকদের।

কলাবন আসার সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী কয়েকজন তরুণ-যুবক আমাদের ঘিরে ধরল। মূলত তারা হাম-হামের গাইড। আমরা বিকাশ নামের এক যুবককে নিই গাইড হিসেবে। সঙ্গে আরও ছিল টমি নামের এক কুকুর। কুকুরটি বিকাশের পরিচিত। আর স্থানীয় কিশোরদের কাছ থেকে আমরা একটা করে বাঁশের চলা কিনে নিই হাতের লাঠি হিসেবে। তারপর সবাই হাফপ্যান্ট, টি-শার্ট পরে রওনা হই। সঙ্গে আরও নিই পানির বোতল ও স্যালাইন।

প্রচ- গরমের মধ্যে হাঁটছি নির্জন পাহাড়ি বনের ভেতর দিয়ে। গাইড জানাল এ পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ৬০০ ফুট। চার পাশেই ঘন গাছ-গাছালি। তারই মাঝে হাঁটছি। কখনো নিচু থেকে ওপরে উঠছি, কখনো ওপর থেকে নিচে নামছি। আবার কখনো বা পাড়ি দিচ্ছি ছোট্ট ছড়া। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হই, বিশ্রাম নিই, তারপর আবার হাঁটা। অবশ্য উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে দলের সদস্যদের কষ্টই হচ্ছিল। কেউ কেউ তো কষ্টের ভয়ে ফিরে যেতেও চাইছে। এভাবে দেড় ঘণ্টায় প্রায় ৬ কিলোমিটার পথ হেঁটে অবশেষে পৌঁছি ঝরনার ছড়ায়। এ ছড়ায় হাম-হাম ঝরনারই পানি প্রবাহিত হয়ে চলছে। ছড়ায় এসে সাজেদ আর মাসুম শুয়ে পড়ল ক্লান্তিতে। আমরাও যোগ দিই তাদের সঙ্গে। স্বস্তির জন্য শরীরটা একটু ভিজিয়ে নিই ছড়ার পানিতে। এখানে একটু বিশ্রাম শেষে ছড়া ধরেই আবার রওনা হই ঝরনার উদ্দেশে। কিছুটা পথ আসতেই দেখতে পাই হাম-হাম। সত্যিই দারুণ বুনো পাহাড়ের এ ঝরনার পানি ঝরা।

ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী ঘেঁষা এ ঝরনার উচ্চতা হবে ১৬০ থেকে ১৭০ ফুট। ২০১০ সালের দিকে এটি আবিষ্কার করেন বাংলাদেশের একদল পর্যটক। সবাই ঝরনার শীতল পানিতে গোসল করি। ভুলে যাই কষ্ট করে আসা পথের সব ক্লান্তি। ঝরনার পাদদেশে একটি চায়ের দোকান হয়েছে এখানে আসা দর্শনার্থীদের উপলক্ষ করে। সবাই এ দোকানে চা-বিস্কুট খাই। ঝরনার নিচের পরিবেশটা সত্যিই মায়াময়। এ মায়ায় পড়ে বেশ কিছুক্ষণ শুনি ঝরনার পানি পড়ার শব্দ। ফেরার পথে গাইড বলল অন্য রাস্তা দিয়ে গেলে পাহাড় পাড়ি দিতে হবে না। তার কথায় অন্যপথ ধরি। এ পথে পাহাড় পাড়ি দিতে হলো কম, তবে পথ কম নয়। আর এ পথে রোমাঞ্চটাও ছিল একটু বেশি। কারণ পথটি ঝরনারই ছড়াপথ। মাঝখানে ছড়া আর দুই পাশে পাহাড়। নির্জন-ছমছম ভাব। বেশ উপভোগ্য। তবে পথের পানির ছড়াগুলোয় জোঁকের উপদ্রব অনেক। দলের সবাইকে জোঁকে ধরেছে, আমি ছাড়া।

কলাবন হয়ে আদমপুর আসতে আসতে বেলা প্রায় শেষ। এখানকার একটি রেস্টুরেন্টে খাই দুপুরের খাবার। তারপর ধরি কুলাউড়ার পথ। পথে থামি শমসেরনগর বধ্যভূমি ও সম্মুখযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভে। মুক্তিযুদ্ধের এ স্মৃতিস্তম্ভে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাই শহীদদের প্রতি। তারপর আবার ছুট। থামি বড়লেখায় সাজিদের গ্রামের আজিমগঞ্জ বাজারে।

লেখক: সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :