সমরেশ আবেশিত একটি দুপুর

প্রকাশ | ০১ ডিসেম্বর ২০১৮, ২৩:০৬ | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ১১:৩১

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা বেলা ১১টায়। তার দুই ঘণ্টা আগে থেকে আসতে শুরু করে ভক্ত-পাঠকরা। ১০টার মধ্যেই সব আসন পূর্ণ। দাঁড়িয়ে কয়েকশ তরুণ-তরুণী। সুচ রাখার জায়গা নেই। আয়োজকরা জানালেন, ৫০০ চেয়ার পাতা হয়েছিল। এখন আর জায়গা নেই। 

শনিবার রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইয়ের দোকান বাতিঘরে এসেছিলেন সমরেশ মজুমদার। এক দিন আগে সন্ধ্যায় বিমানে উড়ে ঢাকায় পৌঁছেছেন। ব্যক্তিগত ভ্রমণ। তার মধ্যে পাঠকদের সঙ্গে এই আয়োজনটি আগে থেকেই ঠিক ছিল। সাহিত্যপিপাসুরাও প্রিয় লেখকের মুখ থেকে তার জীবন ও রচনার কথা শুনতে ভিড় করেছেন বাতিঘরে।

শুরুতেই নিজের লেখকজীবন তুলে ধরলেন বর্তমান বাংলা সাহিত্যের এই অগ্রগণ্য লেখক। লেখার মতো কথাতেও তার রস চুইয়ে পড়ে। কথার ফাঁকে ফাঁকে একটু-আধটু রসিকতা ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন বাতাসার মতো। উন্মুখ দর্শকরাও তা লুফে নিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছিলেন। মঞ্চনাটক করতেন। বন্ধুদের একটা বড় দল ছিল নাটকের। পড়তেনও খুব। রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ- বাদ দেননি কিছুই। একদিন বন্ধুরা বলল, ‘তুই তো অনেক পড়েছিস। তো নিজেই একটা নাটক লিখে ফেল।’ 

সমরেশের ভাষায়, ব্যাপারটা এমন ছিল যে, তুই তো কত কিছুই খাস, এটাও খেয়ে ফেল। 

সে যাই হোক, বন্ধুদের আবদার রাখতে তিনি নাটক লিখলেন। আর তা দিয়েই শুরু হলো লেখালেখি। শুরুতে ছোটগল্পে ঝোঁক ছিল। আস্তে আস্তে সমরেশের ছোটগল্প পাঠকদের কাছে জায়গা করে নিল। তারপর যখন উপন্যাসে হাত দিলেন তখন আর ছোটগল্প লেখা হয়ে ওঠেনি দীর্ঘকাল। তখন একটার পর একটা উপন্যাসই লিখেছেন। 

তবে লেখক হওয়ার জন্য নিজের তেমন কোনো প্রস্তুতিই ছিল না সমরেশ মজুমদারের। তার ভাষায়, ‘লেখক হতে চাইনি। কী করে, কেমন করে হয়ে গেলাম জানি না।’

কোনো লেখা শুরুর আগে ভাবনার কাজটা কি সেরে নেন? কোনো পরিকল্পনার ছক কি থাকে? নাকি কলমের ওপর ছেড়ে দেন নিয়তি? কালজয়ী উপন্যাস ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’-এর ¯্রষ্টা বলেন, ‘আমি আগে থেকে ভেবেচিন্তে লিখতে পারি না। কেউ কখনো যদি বলে, আমার জীবনের গল্প লিখুন। আমি পারি না। আমার ভেতরে গল্প আসলে আমি লিখি। পরিকল্পিত কোনো লেখা লিখতে পারি না।’   

জানালেন, ‘উত্তরাধিকার’ লেখার আগেও তার কোনো ছক ছিল না কী লিখবেন, কীভাবে লিখবেন। বললেন, ‘জলপাইগুড়ির চা-বাগানে গেলাম। সেখানে একটা বাংলোর জানালার পাশে লিখতে বসেছি। বিকেল গিয়ে সন্ধ্যা হয় হয়। দেখলাম আকাশে মেঘ। হিম বাতাস বইছে। কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়ে গেছে। কিন্তু এখানটায় বৃষ্টি হচ্ছে না। পরিবেশের এই বর্ণনা দিয়েই শুরু করলাম। তারপর গল্পটা এসে গেল।’ 

অগ্রহায়ণ চলছে। সন্ধ্যার পর থেকেই হিম হিম পরিবেশ। দুপুরের রোদ তেতে ওঠার আগেও শীতল রেশটা থেকে যায়। তার মধ্যেও বাতিঘরে কৃত্রিম শীতের যন্ত্রটা চলছে। কাজ হচ্ছে না। ঘামতে হচ্ছে। তবে তার চেয়েও বিরক্তিকর ছিল অপর্যাপ্ত শব্দসঞ্চালন ব্যবস্থা। মঞ্চ ছাড়া বিকল্প কোনো পর্দা ছিল না, যেখানটায় চোখ রেখে প্রিয় লেখককে একবার দেখা যায়। 

তারপরও সাহিত্যের পাঠকের আপ্রাণ চেষ্টা। কান খাড়া। যদি একটু শোনা যায় লেখকের কথা। দু-একজন আবার ওখানে বসেই ফেসবুকের পাতায় চোখ রাখছিলেন। লাইভ হচ্ছিল। কিন্তু লেখকের কাছাকাছি এসে কি ফেসবুকে মনের আশ মেটে? 

নিজের কথা শেষ করে পাঠকের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন লেখক। এর মাঝে এলেন বিশ^সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও আলোর দিশারী আব্দুল্লাহ আবু সাইয়ীদ। সমরেশ মজুমদার তাকে দেখেই হাসিমুখে মঞ্চে আমন্ত্রণ জানালেন। বললেন, রাজা এলেন রাজপাটে।  

লেখকের বিভিন্ন রচনার চরিত্রগুলো নিয়ে পাঠকের জানার আগ্রহের কমতি ছিল না। প্রশ্ন ছিল। কেউ বলছিলেন ‘কালবেলা’র অনিমেষ ও মাধবীলতার কথা। কেউ আবার ‘সাতকাহন’-এর দীপাবলীর কথা তুলল। লেখক যদি সত্যি সত্যিই দীপাবলীকে পান তাহলে কী করবেন? তার সঙ্গে কি বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেবেন? সমরেশ একগাল হাসলেন। বললেন, ‘খুব ভালো প্রশ্ন। দীপাবলির মতো মেয়েরা তো এই সমাজে ব্যতিক্রম। শৈশব থেকেই তো আমরা নারীকে কষ্ট দিয়ে শুরু করি। তারপর বিয়ের পর চিন্তা থাকে, স্ত্রী রেঁধে দেবে, জামাকাপড় পরিষ্কার করে তৈরি করে দেবে, কারও কারও ক্ষেত্রে মানিব্যাগটা গুছিয়ে দেবে। দীপাবলি তো তার ব্যতিক্রম। পুরুষের এই ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে তো তার লড়াই। এটা আমার ভালো লাগে।’        

লেখক-সাহিত্যিকরা তো একসময় নিজের কথা লিখে যান। তিনি এমন আত্মজীবনী লিখছেন কি না? বা লেখার পরিকল্পনা কি আছে? পাঠকের এমন প্রশ্নে সমরেশ স্বভাবসুলভ রসিকতায় বললেন, ‘আত্মজীবনী লিখলে প্রচুর শত্রু তৈরি হয়। ঘরে ও বাইরে দুই জায়গাতেই। এত এত বন্ধু, সবাই শত্রু হয়ে যায়। এত মহিলা, এত পুরুষ! বন্ধুদের শত্রু বানানোর ইচ্ছে আমার নেই।’ 

হুমায়ূন আহমেদ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে তার অনুক্ষণ স্মৃতিও আওড়ালেন সমরেশ মজুমদার। বললেন, ‘হুমায়ূনের সঙ্গে আমার আলাপ ১৯৮৭ সালে। তখনো হুমায়ূন হুমায়ূন হয়ে ওঠেনি। তারপর কতবার দেখা হয়েছে। আমেরিকাতে এক অনুষ্ঠানে একই হোটেলের পাশাপাশি ঘরে ছিলাম। ঢাকায় এসেও তার বাসায় বহুবার গিয়েছি। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু পরে হুমায়ূন আহমেদ একবার আমায় বলেছিলেন, তিনি ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখতে চান। আমি তাকে বললাম, ওখানে লিখতে তো একটা উপন্যাসের জন্য এক লাখের বেশি পাবেন না। বাংলাদেশের প্রকাশকরা তো আপনাকে একটা উপন্যাসের জন্য দশ লাখ টাকা দেয়। তিনি বলেছিলেন, টাকা না দিলেও আমি লিখতে চাই। যেখানে রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর লিখেছেন, আমি সেখানে লিখতে চাই। পরে তিনি দেশ পত্রিকায় উপন্যাস লিখেছিলেন।’ 

আগন্তুকদের সিংহভাগই ছিলেন তরুণ-তরুণী। এর বাইরে যারা এসেছেন, বয়সে জ্যেষ্ঠ হলেও মনটা তরুণদেরই। তাই দীর্ঘ সময় বসে লেখকের কথা শুনতে এতটুকু খারাপ লাগেনি কারও। শেষটায় অটোগ্রাফের লম্বা লাইন তারই প্রমাণ দিচ্ছিল। পাঠকের ভালোবাসায় সিক্ত সমরেশ মজুমদার। বললেন, ‘অবাক লাগে, এত মানুষ আমায় ভালোবাসে। এই ভালোবাসা আমি ভুলব না।