আসন সমঝোতায় ‘মহাজোটে’ দ্বন্দ্ব

তানিম আহমেদ
| আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০১৮, ১১:৩৮ | প্রকাশিত : ০২ ডিসেম্বর ২০১৮, ১১:৩৩
ফাইল ছবি: শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগ

২০০৮ সালের মতো মহাজোট করে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে চাওয়া আওয়ামী লীগ শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতা করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়েছে। বিশেষ করে জাতীয় পার্টির সঙ্গে একমত হতে পারছে না ক্ষমতাসীন দল।

৩০০ আসনের মধ্যে ২৬৬টিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। বাকি ৩৬টির মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ পাচ্ছে পাঁচটি করে। তরীকত ফেডারেশনের নিশ্চিত দুটি আসন। জেপি ও যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন করতে চায়, এমন একটি আসনেও নেই নৌকার প্রার্থী। বাকি ২২টি আসন জাতীয় পার্টির জন্য রাখা হয়েছে। তবে দলটি অন্তত ৪৭টি আসন দাবি করছে। আওয়ামী লীগ চাইছে ৪০টির মতো দিতে।

আর ফাঁকা রাখা ২৩টির বাইরে যে ২৪টি আসন রয়েছে, তার সিংহভাগেই আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্তিশালী। জাতীয় পার্টির এগুলোতে বলার মতো কোনো ভোট নেই। কিন্তু জাতীয় পার্টির শক্তিশালী অবস্থান থাকা উত্তরবঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিয়েছে। এগুলোতে আওয়ামী লীগের অবস্থানও জোরাল এবং নবম সংসদ নির্বাচনে ভোটে জিতে ক্ষমতাসীন দল প্রমাণ করেছে, জাতীয় পার্টির দুর্গ বলে এখন আর ওই সব আসনকে বলা যায় না।

কিন্তু আসন কম দেয়া হচ্ছে, এই বিষয়টি জানতে পেয়ে রীতিমতো ক্ষুব্ধ জাতীয় পার্টির নেতারা। দলের মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতাদের নিয়ে নানা আপত্তিকর কথা তারা বলছেন প্রকাশ্যেই।

আবার জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে পটুয়াখালী-১ এবং সাবেক মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে কক্সবাজার-৩ আসন যেন ছেড়ে দেয়া না হয়, সে জন্য নিজ নিজ এলাকায় বিক্ষোভ করছে আওয়ামী লীগও।

আবার ঢাকা-১৭ আসনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে এখনো ছাড় দেয়নি আওয়ামী লীগ। ময়মনসিংহ-৭ আসনে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি প্রার্থী হয়েছেন রওশন এরশাদ। দুই দলের প্রার্থী আছে ময়মনসিংহ-৫ আসনেও।

জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে এমন আসনগুলোর মধ্যে কেবল ময়মনসিংহেই তিনটিতে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। আরও বেশ কিছু এলাকায় একই চিত্র।

এবার জাতীয় পার্টির নেতারা সারা দেশে প্রার্থী হয়েছেন ২৩৩ জন। গত কয়েক বছর ধরেই দলের চেয়ারম্যান এরশাদ বলে আসছিলেন তারা ৩০০ আসনে নির্বাচন করবেন এবং ধারণা করা হচ্ছে এ কারণে এবার প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। আবার আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে, তারা ৬৫ থেকে ৭০টি আসনে ছাড় দেবে শরিকদের। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৪ দলের শরিকদের ১৩টি আসন দিয়েছে। আর যুক্তফ্রন্টকে চারটি বা পাঁচটি দিতে চাইছে। জাতীয় পার্টি বলছে, তাহলে বাকিগুলো তারা পেতে পারে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রস্তুতি স্পষ্টতই অন্যান্য দলের চেয়ে এগিয়ে। তারপরেও কেন আসন ভাগাভাগি নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে- জানতে চাইলে শরিক একটি দলের নেতা বলেন, ‘এ নির্বাচন আমাদের অস্তিত্বের। তাই বিরোধী জোটের প্রার্থী দেখেই আমরা আমাদের জোটের প্রার্থী চূড়ান্ত করব।’

কবে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হবে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নাই।’ ‘আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের সদস্য ও সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান বলেন, জোট শরিকদের সঙ্গে নির্বাচনী আসন নিয়েই সমঝোতা হবে। যেখানে যে দলের উইনেবল প্রার্থী থাকবে, তাকেই জোটের প্রার্থী করা হবে।’

‘সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে। সবার চাওয়া-পাওয়া শোনা হচ্ছে। আমরাও সবার সুবিধা ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তের দিকেই যাচ্ছি।’ বলেন ফারুক খান।

আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, কিছু আসন আছে যেগুলো ছেড়ে দেয়া কঠিন। যেমন রংপুর-৪ ও রংপুর-৫। ২০০৮ সালে সেখানে জাতীয় পার্টিরও প্রার্থী ছিল, নৌকারও ছিল। কিন্তু জয় এসেছে আওয়ামী লীগের। তাই জাতীয় পার্টির দাবি মানতে গিয়ে বিজয়ী সংসদ সদস্যকে বাদ দেয়ার মানে হয় না।

সমস্যার সমাধানে ১০ থেকে ১২টি আসন উন্মুক্ত করে দেয়া হতে পারে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনেও এমনটি হয়েছিল। তখন ময়মনসিংহ-৫ আসনেও উন্মুক্ত লড়াই হয়েছে। সেখানে আওয়ামী লীগ ৮৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতলেও রওশদ ভোট পান দুই হাজারের কম।

১৪ দলে ‘সন্তুষ্টি’

আসন সমঝোতা নিয়ে জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতা করতে ঝামেলা হলেও ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে তেমন কোনো আপত্তি নেই।

১৪ দলের শরিক তরীকত ফেডারেশনে সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভা-ারী তাদের পাওয়া দুটি আসন নিয়েই খুশি। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘আমরা দুটি আসনে মনোনয়নের চিঠি পেয়েছি। ১৪ দলের শরিকদের সবাই নৌকা প্রতীক নিয়ে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। আমরা সেভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছি।’

জাসদের একাংশের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, ‘নড়াইল-১ ও চট্টগ্রাম-৮ আসনে মনোনয়নের চিঠি পেয়েছি। আরও একটি আসনে মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করব।’

নড়াইল-১ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তি মনোনয়নের চিঠি পেয়েছেন, তাহলে তার (আম্বিয়া) মনোনয়নের নিশ্চিয়তা কীভাবে পেলেন, এমন প্রশ্নে আম্বিয়া বলেন, ‘না, জোট থেকে আমাকেই মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আমি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করব। উনি (কবিরুল) প্রত্যাহার করবেন।

চাঁদপুর-৫ আসনটি ফাঁকা রাখা হলেও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। সেখানে ইসলামিক ফ্রন্টের সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী জোটের সমর্থন চান। তার বিষয়টি একরকম নিশ্চিতই বলা যায়।

ফরিদপুর-২ আসনে জাকের পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা আমীর ফয়সাল মোজাদ্দেদীকে সমর্থন দেয়ার বিষয়টি নিয়ে হঠাৎ প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, ছাড় দেয়া আসনটির জন্য গণভবনে নিজে এসে মনোনয়নের চিঠি নিয়ে গেছেন প্রবীণ নেত্রী সাজেদা চৌধুরী।

ইসলামিক ঐক্যজোটকে আওয়ামী লীগ দিতে চেয়েছে একটি আসন। কিন্তু তারা চেয়েছিল তিনটি। সমঝোতা না হওয়ায় আলাদা নির্বাচনের কথা জানিয়েছে ঐক্যজোট। তবে এখনো আলোচনা চলছে।

চূড়ান্ত হয়নি যুক্তফ্রন্টের বিষয়টিও

সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট শুরুতে ৩৮টি আসনের দাবি করলেও পরে কমিয়ে ১০টি এবং এরপর আটটি করা হয়। পরে আরও কমিয়ে করা হয় পাঁচটি। আওয়ামী লীগ দিতে চাইছে চারটি। তবে শেষ পর্যন্ত পাঁচটিও দেয়া হতে পারে। আর এই দাবি পূরণ করতে গিয়ে বাদ পড়ে যেতে পারেন একজন মন্ত্রীও।

নিজের দলেও নানা প্রতিক্রিয়া

শুধু জোটের শরিকদের নয়, নিজের দলেও নানা ঘটনা সামলাতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। বেশ কিছু আসনে প্রার্থী পাল্টাতে হয়েছে আইনি জটিলতা বা স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধিতার কারণে।

গত ২৫ নভেম্বর দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে চিঠি দেয়ার সময় ফাঁকা রাখা বেশ কিছু আসনেও দিতে হয়েছে প্রার্থী। ফরিদপুর-২ আসনে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, হবিগঞ্জ-১ আসনে দেওয়ান শাহনেওয়াজ মিল্লাত গাজী, কুমিল্লা-৮ আসনে নাছিমুল আলম চৌধুরী এবং কুড়িগ্রাম-৩ আসনে এম এ মতিনকে নৌকার চিঠি দেয়া হয়।

আবার বরিশাল-২ আসনের তালুকদার মো. ইউনুছের মনোনয়ন পাল্টে দেয়া হয় ছাত্রলীগের সাবেক কার্যকরী সভাপতি শাহে আলমকে।

নড়াইল-১ আসনে নিজের দলের কবিরুল হক মুক্তির পাশাপাশি জাসদের একাংশের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়াকেও দেয়া হয়েছে মনোনয়ন।

চাঁদপুর-২ আসনে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার আসনে মনোনয়ন দেয়া হয় নুরুল আমিন রুহুলকেও। চাঁদপুর-৪ আসনে শামসুল হক ভুঁইয়ার পাশাপাশি মনোনয়ন দেয়া হয়েছে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিকুল ইসলামকে।

ঢাকা-১৭ আসনে আকবর হোসেন পাঠানের (নায়ক ফারুক) পাশাপাশি মনোনয়ন দেয়া হয়েছে আবদুল কাদের খানকেও। ফারুক সরাসরি বলে দিয়েছেন, ‘নৌকা আমার।’

এ ছাড়া চাঁদপুর-১, বরিশাল-৫, কিশোরগঞ্জ-১, বরগুনা-১, ঢাকা-৫, ঢাকা-৭, টাঙ্গাইল-২, জামালপুর-১, জামালপুর-৫, রংপুর-৬ আসনেও দুজনের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে ক্ষমতাসীন দলকে। কিন্তু মনোনয়ন পাওয়া নেতারা কেউ ছাড় দিতে রাজি হচ্ছেন না।

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজনীতি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :